ইটভাটার আগুনে ‘পুড়ছে’ হানজেলা-আয়েশা-আমেনাদের স্বপ্ন

ইটভাটার একটি পাশে থাকার ঘরে দুই শিশুর দেখভাল করছেন চম্পা বেগম। ছবি: স্টার

বয়স তিন বা চার বছর হবে। মানিকগঞ্জের সিংগাইরের একটি জ্বলন্ত ইটভাটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কেমন আছ, কী করছ, নাম কী তোমার—এসব প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।

পাশের একজন এসে বললেন, ওর নাম হানজেলা। ওর বাবার নাম আব্দুল হাকিম সরদার, মা রাবেয়া বেগম। তারা দুজনেই এই ইটভাটার শ্রমিক।

জানা গেল, হানজেলাদের বাড়ি খুলনার পাইকগাছায়। কাজের জন্য এখানে এসেছে ওর বাবা-মা।

তিন বছর বয়সী আয়েশাকে কোলে নিয়ে ইটভাটার পাশে হাঁটাহাঁটি করছিলেন ১৭ বছর বয়সী সুমি আক্তার। স্বামী রুহুল আমিন ইট পোড়ান আর সুমি ইটভাটার শ্রমিকদের জন্য রান্না করেন। শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত সুমি বাল্যবিয়ের শিকার হয়ে স্বামীর সঙ্গে খুলনার পাইকগাছা থেকে এসেছেন মানিকগঞ্জের সিংগাইরের এই ইটভাটায়।

কোলের শিশু আয়েশাকে লেখাপড়া করাতে চান সুমি। কিন্তু সেই সুযোগ কবে হবে, জানেন না। কেননা, তারা ছয় মাস থাকেন ইটভাটায়। আর ছয় মাস থাকেন নিজ গ্রামে।

ইটভাটার শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাদের প্রবল ইচ্ছা থাকার পরও সন্তানদের লেখাপড়া করাতে পারছেন না।

ইটভাটার পশ্চিম পাশে চোখে পড়ল ২০-২৫টি ঘর। সেখানে গিয়ে জানা গেল, সেখানেই থাকেন এখানকার শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। ভাটার মালিকের পক্ষ থেকে প্রতিটি পরিবারের জন্য তৈরি করা হয়েছে এক বারান্দাবিশিষ্ট একটি ঘর।

এরকম একটি ঘরের সামনে ১০ মাসের শিশু আরিয়ান ও দুই বছরের আমেনাকে সঙ্গে নিয়ে বসে আছেন চম্পা বেগম। আরিয়ান তার নিজের সন্তান আর আমেনা পাশের ঘরের আরাফাত সরদার ও সুমির মেয়ে। ঘর থেকে তারা বেরিয়ে যেতে পারে, এ কারণে ঘরের সামনে বাঁশ দিয়ে বেড়া তৈরি করা হয়েছে।

চম্পা বেগমের স্বামী মো. ইনছান ভ্যানে করে পোড়ানো ইট বের করে আনেন। আমেনার বাবাও একই কাজ করেন। তাদের বাড়িও খুলনার পাইকগাছায়।

এমন গল্প এখানকার সবগুলো ঘরেরই। ছোট ছোট ছেলেমেয়েকে সঙ্গে নিয়ে কাজে আশায় ছুটে এসেছে পরিবারগুলো। বেশিরভাগ পরিবারই এসেছে খুলনায় পাইকগাছার কয়রা গ্রাম থেকে।

কথা হয় এখানকার বৃষ্টি আক্তার (১৯), বিউটি আক্তার (১৫) তাসলিমা বেগমের সঙ্গে। সবাই ছোট ছোট শিশুর মা। বলেন, চার মাস আগে এই ইটখোলায় এসেছেন। থাকবেন আরও কমপক্ষে দুই মাস। এরপর এলাকায় ফিরে যাবেন। তারা ছয় মাস চিংড়ির ঘেরে কাজ করেন, আর বাকি ছয় মাস ইটভাটায় কাজ করেন।

১৮ বছর বয়সী রুমি খাতুনের মেয়ের বয়স প্রায় ৪ বছর। রুমির স্বামী আবির সানা গত ছয় বছর ধরে ইটভাটায় কাজ করছেন। ১৪ বছর বয়সে রুমির বিয়ে হয়। বাল্যবিয়ে হওয়ায় নিজেও পড়তে পারেনি, এখন মেয়েকেও এই সুযোগ দিতে পারছেন না।

ইটভাটার শ্রমিক ও তাদের পরিবারের সদস্যরা জানান, অভাবের তাড়নায় নিজ এলাকা ছেড়ে কাজের সন্ধানে দূর-দূরান্তে যেতে হয়। এ কারণে তারা তাদের সন্তানদের স্কুলে দিতে পারেন না। সারাদিনই কাজে ব্যস্ত থাকার কারণে সন্তানদের আর বিদ্যালয়ে নেওয়ার সুযোগ থাকে না।

এমআরসি ব্রিকস নামে ওই ইটভাটার মালিক লিয়াকত আলী বলেন, 'আমার ইটভাটায় মোট ১৫০ জন শ্রমিক কাজ করে। তাদের মধ্যে ১০০ জনই এসেছেন খুলনার পাইকগাছা থেকে। আমি ওই এলাকায় অনেকবার গিয়ে দেখেছি, ওরা খুবই গরিব। ওখানে কাজ নেই।'

তিনি বলেন, 'অভাবের তাড়নায় তারা আমাদের এখানে এসে ইটভাটায় কাজ করে। এখানে ছয় মাস থাকে। তারপর চলে যায়। সেখানে ছয় মাস চিংড়ির ঘেরে কাজ করে। তারা যখন যেখানে যায় সংসারের সব জিনিসপত্র নিয়ে সবাই একসঙ্গে যায়। আবার যখন বাড়িতে ফিরে যায়, তখন সব নিয়েই যায়।'

মানিকগঞ্জের প্রায় সবগুলো ইটভাটার চিত্রই এটা। এখানকার শ্রমিকদের সন্তানরা একদিকে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। অন্যদিকে, মেয়ে শিশুদের ১২-১৩ বছর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ফলে এই চক্র থামছে না বলে জানায় পরিবারগুলো।

মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক রেহেনা আকতার বলেন, 'জেলায় শতাধিক ইটভাটা রয়েছে। সেখানে বিভিন্ন এলাকার শ্রমিকরা কাজ করেন। কিন্তু সেখানে শিশুরা থাকে কি না, আমার জানা নেই। যদি থেকে থাকে তাহলে আমি অবশ্যই খোঁজ খবর নিয়ে তাদের কীভাবে লেখাপড়ার মধ্যে আনা যায়, সেই ব্যবস্থা নেবো।'

Comments

The Daily Star  | English

Leather legacy fades

As the sun dipped below the horizon on Eid-ul-Azha, the narrow rural roads of Kalidasgati stirred with life. Mini-trucks and auto-vans rolled into the village, laden with the pungent, freshly flayed cowhides of the day’s ritual sacrifices.

17h ago