হাওরে ফসল রক্ষাবাঁধ নির্মাণে বিলম্ব: এবার দায় ‘নির্বাচনের ওপর’

হাওরে ফসল রক্ষাবাঁধ নির্মাণে বিলম্ব: এবার দায় ‘নির্বাচনের ওপর’
চিত্রটি গত বছর সুনামগঞ্জের তাহিরপুর উপজেলার গুরমার হাওরে বাঁধের ওপর দিয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করার | ফাইল ফটো

২০১৭ সালের প্রলয়ংকরী বন্যায় সুনামগঞ্জের বোরো ধানের সম্পূর্ণ ফলন নষ্ট হওয়ার পর অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রতিরোধে সংশোধন হয় 'কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) নীতিমালা'।

সংশোধিত নীতিমালায় বাঁধের কাজ শুরু ও শেষের সময় বেঁধে দেওয়া হলেও বিলম্ব হচ্ছে প্রতি বছরই। আর বিলম্বের অজুহাত হিসেবে থাকে হাওরের পানি ধীরে নামার বিষয়।

সেই ধারাবাহিকতা এবারও বজায় আছে। তবে এ বছর হাওরে পানি ধীরে নামার অজুহাতের পাশাপাশি জাতীয় নির্বাচনের ঘাড়েও বর্তেছে বিলম্বের দায়।

২০১৭ সালের পর থেকে প্রায় প্রতিবছরই বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বোরো ধানের আবাদ। এবারও ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ শুরুতে বিলম্ব হওয়ায় কৃষকরা উদ্বিগ্ন।

কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই সবগুলো বাঁধের কাজ শুরু হওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, জেলায় বাঁধ নির্মাণের ৭৩৮টি স্কিমের মধ্যে গত রোববার পর্যন্ত কাজ শুরু হয়েছে কেবল ৫০টির।

২০১৭ সালের বন্যার পর সংশোধিত কাবিটা নীতিমালা অনুযায়ী বাঁধের কাজের জন্য পাঁচ থেকে সাত সদস্যের প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনের নির্দেশনা রয়েছে। কাজের আর্থিক মূল্যের হিসাবে প্রতি ২৫ লাখ টাকার একটি করে স্কিম প্রস্তুত করে তার জন্য বাঁধের পার্শ্ববর্তী কৃষি জমির মালিকদের নিয়ে একটি করে পিআইসি গঠন করতে হবে।

নীতিমালা অনুযায়ী প্রতি বছর ৩০ নভেম্বরের আগে জরিপ শেষ করে সব পিআইসি গঠন করতে হবে। তারপর ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে সবকটি বাঁধের কাজ শুরু করে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে তা শেষ করতে হবে।

২০২২ সালের বন্যায় বাঁধের ক্ষয়ক্ষতি বেশি হওয়ায় গত বছর ২০৪ কোটি টাকা ব্যয়ে এক হাজার ৬৩টি পিআইসির মাধ্যমে ৭৪৫কিলোমিটার বাঁধে নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়।

এ বছর ১২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ৭৩৮টি পিআইসির মাধ্যমে ৭৩৮ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বাঁধ নির্মাণের দায়িত্বে থাকা জেলা কমিটি ও সহযোগী পাউবো।

গত ১৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে বলে ঘোষণা দেওয়া হলেও গত রোববার পর্যন্ত ৩৯১টি পিআইসি গঠন হয়েছে এবং এর মধ্যে মাত্র ৫০টি পিআইসি কাজ শুরু করেছে বলে পাউবো থেকে জানানো হয়েছে।

পাউবো সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রকৌশলী (পওর বিভাগ-১) ও বাঁধ নির্মাণের দায়িত্বে থাকা জেলা কমিটির সদস্য সচিব মো. মামুন হাওলাদার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এবারও পানি নামতে বিলম্ব হওয়ায় বাঁধের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না। তা ছাড়াও জাতীয় নির্বাচনের কারণে পিআইসি গঠনে বিলম্ব হচ্ছে। কারণ দায়িত্বশীল সরকারি কর্মকর্তারা নির্বাচনের কাজে ব্যস্ত রয়েছেন।'

তিনি আরও জানান, পিআইসি গঠনের পর তা অনুমোদনের জন্য কমিটির সভা নির্বাচনের ব্যস্ততার কারণে এখন পর্যন্ত তিনবার পেছাতে হয়েছে।

জেলা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলার পাঁচটি আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে রয়েছেন। তা ছাড়া উপজেলা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা জাতীয় নির্বাচনের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার দশমন্তপুর গ্রামের প্রবীণ কৃষক জ্যোতিমোহন দাশ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রতি বছরের মতো এবারও বাঁধের কাজ সময়মতো শুরু হয়নি। আমাদের এখানকার পিআইসি বলছে নির্বাচনের পরে কাজ শুরু করবে। ভয় হচ্ছে বিগত কয়েকবছরের মতো এবারও বন্যায় ফসলের ক্ষতি হবে।'

সুনামগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, জেলায় এ বছর দুই লাখ ২৩ হাজার ২৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যার মধ্যে এক লাখ ৬৫ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমি হাওরে।

বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হাওর এরিয়া আপলিফটমেন্ট সোসাইটির (হাউস) নির্বাহী পরিচালক সালেহীন চৌধুরী শুভ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ফসল চক্র ও আবহাওয়া কর্তাব্যক্তিদের নির্বাচনী ব্যস্ততা বোঝে না। সময়মতো বাঁধের কাজ শুরু না করলে শেষ সময়ে তড়িঘড়ি করে কাজ শেষ করলে দুর্বল বাঁধ নির্মিত হবে, যা পাহাড়ি ঢল ঠেকাতে পারবে না।'

'হাওরের ফসল রক্ষার ওপর নির্ভর করে দেশের সামগ্রিক খাদ্য নিরাপত্তা। তাই এ কাজে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই', যোগ করেন তিনি।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বিজয় সেন রায় ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নির্বাচন হোক বা অন্য যেকোনো কিছু হোক, বাঁধের কাজে কোনো অবস্থাতেই বিলম্ব করা যাবে না। গত ১৫ ডিসেম্বর লোকদেখানো উদ্বোধন করা হয়েছে। বাস্তবে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার কাজের অগ্রগতি খুবই অসন্তোষজনক।'

Comments

The Daily Star  | English
compensation for uprising martyrs families

Each martyr family to get Tk 30 lakh: Prof Yunus

Vows to rehabilitate them; govt to bear all expenses of uprising injured

3h ago