রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে থাকাটাই কি যৌক্তিক নয়?

শাহজাদপুরে রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি। ছবি: আহমেদ হুমায়ুন কবির তপু

জাতিসংঘ প্রণীত এবারের ট্যুরিজম দিবসে প্রথাগত পর্যটনের পরিবর্তে উদ্ভাবনী ও টেকসই পর্যটন শিল্পের প্রতি বিনিয়োগের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই লক্ষ্যমাত্রার লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য জাতিসংঘ যেসব শর্ত সামনে রেখেছে, সেগুলো পূরণে পর্যটন শিল্প যেন একটি শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে, এবারের পর্যটন দিবসে তার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ গত ৫২ বছরে অনেক টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে ইতোমধ্যে লক্ষ্যগুলো সাফল্যের সঙ্গে অর্জন করে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো অর্জনের পথে হাঁটছে। জলবায়ু সমস্যা দূরীকরণ, লিঙ্গীয় সমতা নিশ্চিতকরণ, দারিদ্র্যতা নিরসন কিংবা বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য যে কাজগুলো করা প্রয়োজন, সেগুলোর ওপর গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশ কাজ করেছে।

অনেক ক্ষেত্রেই আমরা সাফল্য অর্জন করতে সক্ষম হলেও এখনো বেশ কিছু ক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছি। এর অন্যতম উদাহরণ অপরিকল্পিত পর্যটন শিল্প। আয়তনে ছোট হলেও সাংস্কৃতিক ও প্রাকৃতিক উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অত্যন্ত বৈচিত্র্যময়। একদিকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পাঁচ শতাধিক প্রত্নস্থল এবং অন্যদিকে রয়েছে বৈচিত্র্যময় লিভিং হেরিটেজ।

আমরা কেন এগুলোর সমন্বয়ে একটি টেকসই ও কার্যকরী নীতিমালা প্রণয়ন করে পর্যটন শিল্পের প্রসার ঘটাতে পারছি না?

২০১৫ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাশ হয়েছে। কুষ্টিয়ার শিলাইদহ, নওগাঁর পতিশর এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত স্থান। এর মধ্যে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে শাহজাদপুরকে। এখানে কবি আনুমানিক ১৮৮০ পরবর্তী বেশ কয়েক বছর ছিলেন এবং পৈতৃক জমিদারি দেখাশুনা করতেন। বর্তমানে সেই কাছারি বাড়ির রবীন্দ্র জাদুঘর বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণ করে।

বিশ্বকবির জন্মস্থান কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িটিও ভারত সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষণ করে। সেই জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি থেকে যাত্রা শুরু করেছিল রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথক স্থানে নিজস্ব ভূমিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত সম্পূর্ণ কার্যক্রম জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতেই পরিচালনা করেছে।

ভারত ছাড়াও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রবীন্দ্র গবেষকদের তীর্থভূমি জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে বন্ধের দিন ছাড়া প্রতিদিন অগণিত দর্শনার্থী বেড়াতে এবং গবেষণার কাজে আসেন। টিকেট কিনে দর্শনার্থীরা জোড়াসাঁকোর রবীন্দ্র স্মৃতিকে অনুধাবন করেন। এর ফলে জোড়াসাঁকোর মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ ভালো অংকের রাজস্ব উপার্জন করে।

কবিগুরু তার জীবদ্দশায় নিজের হাতে বোলপুরে শান্তিনিকেতন নামক একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা বিশ্বভারতী নামে সমাদৃত। কয়েকদিন আগে এটি ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা লাভ করেছে। সেখানেও ভারত ও ভারতের বাইরে থেকে গবেষক ও দর্শনার্থীরা বেড়াতে যান।

বিশ্বভারতী ও রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বাংলাদেশেই সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথের নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটি সারা পৃথিবীর রবীন্দ্রপ্রেমীদের জন্য একটি অন্যতম তীর্থস্থানে পরিণত হবে, এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ২০১৮ সাল থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয় তিনটি বিষয়ের ওপর পাঠদান শুরু হয়।

গত প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর ধরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে কবিগুরুর স্মৃতিবিজড়িত রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি থাকা সত্ত্বেও রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান চলছে শাহজাদপুর উপজেলার দুটি বেসরকারি কলেজে এবং পাঠাগারটি অপর একটি বেসরকারি কলেজে।

বিশ্বকবির জমিদারির যে বিশাল অঞ্চল শাহজাদপুরে রয়েছে, তার পুরোটাই বছরের বেশিরভাগ সময় পানিতে ডুবে থাকে। রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় অষ্টম বর্ষে পদার্পণ করলেও এখন পর্যন্ত নিজস্ব জমিসংক্রান্ত ডিপিপি অনুমোদিত হয়নি।

রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি চত্বরটির দেখাশুনার দায়িত্ব বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের, তাই রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে অধিদপ্তরের নিয়ম মেনে কাছারি বাড়িতে প্রবেশ করতে হয়। টিকেট কিনতে হয় এবং শিক্ষার্থীদের অসীম আগ্রহ থাকা স্বত্বেও তারা রবীন্দ্র কাছারি বাড়ির জাদুঘরভিত্তিক গবেষণা পরিচালনা করতে বাঁধাগ্রস্ত হয়।

প্রশ্ন হলো, রবীন্দ্র কাছারি থাকার কারণেই যেহেতু শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাহলে এর প্রধান অংশীদার কি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় নয়? এই জাদুঘর কি শুধু নামমাত্রই সংরক্ষিত থাকবে, নাকি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় এবং পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গবেষকরাও এখানে গবেষণার সুযোগ পাবেন?

পর্যটন নিয়ে উদ্ভাবনী কৌশল বের করতে চাইলে অবশ্যই আমাদেরকে গবেষণার সুযোগ দিতে হবে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রধান কাজ হলো নিরীক্ষাধর্মী গবেষণার মাধ্যমে নীতি-নির্ধারকদেরকে সুপারিশ প্রণয়ন করা। সেই কাজটিই যদি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্র কাছারি বাড়িতে বসে শুরু করতে পারে, তাহলে নিঃসন্দেহে নতুন মাত্রার ধারণা পাওয়া সম্ভব।

কবিগুরুর জন্মস্থানে যদি বিশ্ববিদ্যালয় নির্মিত হতে পারে, তাহলে রবীন্দ্র কাছারি বাড়িতে কেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারবে না? কবিগুরুর নামে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য, দেশি-বিদেশি রবীন্দ্র গবেষকদের জন্য এবং সর্বোপরি আমরা যেহেতু গত সাড়ে পাঁচ বছরেও নিজস্ব জমি পাইনি, সেসব বিবেচনা করে রবীন্দ্র কাছারি বাড়ির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে ন্যস্ত করা হোক।

এ বছরের জুনে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় 'সোশ্যাল চেঞ্জ' শীর্ষক প্রথম একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের আয়োজন করেছিল। কনফারেন্সটিতে বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক সুজিতকুমার বসু, রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক পবিত্র সরকার এবং রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. শাহ্ আজম।

রবীন্দ্রনাথের নামজড়িত তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মিলন আমাদেরকে ভীষণ অনুপ্রাণিত করেছে এবং একইসঙ্গে আমরা দেখেছি অধ্যাপক সুজিতকুমার বসু ও অধ্যাপক পবিত্র সরকার রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কতোটা আবেগপ্রবণ হয়েছিলেন। তারা অবাক হয়েছেন এটা দেখে যে রবীন্দ্র কাছারি বাড়ি রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে নেই।

আমাদের কনফারেন্সে বাংলাদেশের নদী বিশেষজ্ঞ প্রখ্যাত গবেষক প্রফেসর ইমেরিটাস আইনুন নিশাতও ছিলেন। তিনিও দাবি করেছেন, রবীন্দ্র কাছারি বাড়ির তত্ত্বাবধান রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়েরই হওয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে, আমরা বাংলাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন জাদুঘর বরেন্দ্র জাদুঘরের উদাহরণও উপস্থাপন করতে পারি, যা বর্তমানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।

আজ বিশ্ব পর্যটন দিবসে আমরা রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিনীত অনুরোধ করছি, যতদিন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ক্যাম্পাস না হয়, অন্তত ততদিন শাহজাদপুরের রবীন্দ্র কাছারি বাড়ির তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়কে দিন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিধন্য রবীন্দ্র কাছারি বাড়ির আঙ্গিনায় ক্লাস করুক।

মো. রিফাত-উর-রহমান, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Pathways to the downfall of a regime

The erosion in the credibility of the Sheikh Hasina regime did not begin in July 2024.

6h ago