অমল মেঘের শারদবেলায় কাশের নিমন্ত্রণ

কাশফুল
খুলনার ডুমুরিয়ায় বিল পাবলার বিস্তৃর্ণ এলাকায় কাশের সমারোহ। ছবি: হাবিবুর রহমান/স্টার

ভ্যাপসা ভাদ্রের শেষে আশ্বিনের বৃষ্টি প্রায় প্রতিদিনই ভাসিয়ে নিচ্ছে ঢাকার রাজপথ, অলি-গলি। বৃষ্টি শেষে অগুনতি বহুতলের আড়ালে ফ্ল্যাটবাড়ির মতোই বর্গফুটে মাপা সীমিত আকাশের নীলিমায় 'গাভির পালের মতো' চরে বেড়ানো শুভ্র মেঘপুঞ্জ ফুটিয়ে তুলছে একেক টুকরো শরতের ছবি।

এই ঠাসবুনটের নগরে 'বর্ষার গর্ভ থেকে জন্ম নেওয়া' স্নিগ্ধ শরতের প্রকাশিত রূপ ঠিক এতটুকুই।

শরতের সঙ্গে স্নিগ্ধতার এ সম্পর্ক চিরায়ত। ঢাকার ঊষর জীবনে মেঘের পাশাপাশি স্নিগ্ধতার এই পালে হাওয়া লাগাচ্ছে শহরতলীর জলাভূমি ভরাট করে তৈরি আবাসন প্রকল্পগুলোর বালুময় বুকে ফুটে ওঠা ধবধবে সাদা কাশফুল আর নগরকাননে ফোটা কোমল শিউলি।

শরৎ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মূল্যায়ন ঠিক এ রকম—'আমার কাছে আমাদের শরৎ শিশুর মূর্তি ধরিয়া আসে। সে একেবারে নবীন। বর্ষার গর্ভ হইতে এইমাত্র জন্ম লইয়া ধরণী-ধাত্রীর কোলে শুইয়া সে হাসিতেছে। তার কাঁচা দেহখানি সকালে শিউলি ফুলের গন্ধটি সেই কচিগাঁয়ের গন্ধের মতো। আকাশে আলোকে গাছপালায় যা কিছু রঙ দেখিতেছি সে তো প্রাণেরই রঙ, একেবারে তাজা।'

কাশফুল
রাজধানীর বসিলায় এক আবাসন প্রকল্পের বালুময় বুকে কাশফুল। ছবি: রবিউল কমল/স্টার

আবার শরতের আকাশে সঞ্চারমান মেঘমালা নিয়ে গানে রবিঠাকুর বলছেন, 'অমল ধবল পালে লেগেছে/মন্দ মধুর হাওয়া/দেখি নাই কভু দেখি নাই/এমন তরণী বাওয়া'।

সবমিলিয়ে শরতের সঙ্গে মেঘ, কাশফুল আর শিউলির সম্পর্ক যেন অচ্ছেদ্য। এ সময়টিতে আকাশের ক্যানভাসে শুভ্র মেঘের ছায়া কাশফুলের রূপ ধরে যেন নেমে আসে মাটির পৃথিবীতেও।

এখন উত্তরার দিয়াবাড়িতে দিনের শুরু কিংবা শেষ বিকেলের মৃদু হাওয়ায় মাথা দোলানো কাশফুল চোখ জুড়িয়ে দেবে। আবার পূর্বাচলের ৩০০ ফুট সড়কের দুই পাশ ও রামপুরা থেকে ডেমরার দিকে যেতে কিছু কিছু জায়গায় দেখা মিলবে এ ফুলের। এছাড়া ঢাকার অদূরে কেরাণীগঞ্জ কিংবা নারায়ণগঞ্জের নদীতীরেও পাওয়া যাবে আশ্চর্য এ ফুলের দর্শন।

কাশফুল
ঢাকার অদূরে ডেমরার খোলাপাড়া বাজারের বালু নদের তীরে কাশের ঝোপ। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার ফাইল ফটো

আশ্চর্য এই কারণে যে, কাশফুলের কোনো সৌরভ নেই। এটা দিয়ে মালা গাঁথা যায় না। আবার ফুলদানিতে সাজিয়ে রাখার মতো ফুলও নয় নয় এটি। খোঁপায় গোঁজার তো প্রশ্নই ওঠে না। তবু দিগন্তছোঁয়া কাশবনের মনোরম সৌন্দর্য মানুষকে আচ্ছন্ন করে রাখে।

তাই কাশ বাংলাদেশের জনপ্রিয় ফুলগুলোর মধ্যে একটি। পৃথিবীতে কোনো ঘাসজাতীয় উদ্ভিদের ফুলের এত কদর এবং মানুষের জয় করে নেওয়ার এমন আবেদন আছে কি না, তা জানা নেই। বাংলা সাহিত্যেও এ ফুলের উপস্থিতি ব্যাপক।

এদিকে এ শহরে শরতের আরেক বিজ্ঞাপন শিউলি স্বল্প হলেও দুর্লভ নয়। শরৎ মানেই শিউলি ফোটার মৌসুম। ভোরের বাতাসে ভেসে আসে তার মধুগন্ধ। ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের কালীমন্দির–সংলগ্ন জায়গা, শিশু একাডেমি প্রাঙ্গণ, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বলধা গার্ডেন কিংবা জাতীয় উদ্ভিদ উদ্যানে শিউলিগাছের দেখা মিলবে।

যে অল্প কিছু ফুলের সঙ্গে আমাদের ফুল কুড়ানোর স্মৃতি মিশে আছে, শিউলি কিংবা শেফালি তাদের অন্যতম। ঢাকার মতো যন্ত্রকাতর শহরে হয়তো শিউলি কুড়ানোর সেই দিন ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়। তবে শাহবাগ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা, ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের মোড় কিংবা সংসদ ভবনের ক্রিসেন্ট লেক–সংলগ্ন এলাকায় খুব ভোরে কিংবা সন্ধ্যায় শিউলি ফুলের মালা বিক্রি করতে দেখা যায় ভ্রাম্যমাণ ফুল বিক্রেতাদের। এরমধ্যে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলের ক্যানটিনের সামনে লাগানো শিউলিগাছটি ফুল ফোটানো শুরু করেছে। সকালবেলায় আশপাশের এলাকার হিন্দুধর্মাবলম্বী নারীরা ঝরা ফুল কুড়িয়ে নিয়ে যান পূজার জন্য।

কাশফুল
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কেওঢালার যে অংশে আবাসন কোম্পানির প্রকল্প, সেখানে মাথা দোলাচ্ছে শুভ্র কাশের দল। উপরে শরতের আকাশ। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার ফাইল ফটো

শিউলি নিয়ে পুরাণের বিষণ্ন কাহিনিটি জানা যায় নিসর্গবিদ দ্বিজেন শর্মার শ্যামলী নিসর্গ বই থেকে। লোকমুখেও এই গল্পের প্রচার আছে। গল্পে বলা হচ্ছে, কোনো এক কালে এক রাজকন্যা ভালোবেসেছিলেন সূর্যকে। ব্যর্থ হলো তাঁর প্রেম। প্রবঞ্চিত রাজকন্যা হলেন আত্মঘাতী। তার চিতাভস্ম থেকে জন্মাল একটি গাছ। আর সেই গাছেই তার বেদনা ফুটল শুভ্র ফুল হয়ে। রাতের নিভৃতে। সূর্যের আলোর স্পর্শ পাওয়ার আগেই সেই ফুল ঝরে গেল।

এভাবে মেঘ-কাশ-শিউলির পাশাপাশি শরতের সঙ্গে সংযোগ আছে নানা লোকজ উৎসবেরও। এ সময়েই ঢাকঢোলের বোলে পরিবেশ মুখর করে শুরু হয় সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা। ছড়িয়ে পড়ে আনন্দের রেশ।

তখন সবার মতোই শ্বশুরবাড়ি কৈলাস থেকে কন্যারূপে বাপের বাড়ি বেড়াতে মর্ত্যলোকে আসা দেবী দুর্গাকে বরণ করে নেয় শুভ্র কাশ আর সাদা-কমলা শিউলি।

এমন আনন্দ আয়োজনে অমল মেঘের এই শারদবেলায় প্রিয়জনকে কাশের বনে বেড়ানো কিংবা শিউলিতলায় ফুল কুড়ানোর নিমন্ত্রণ জানানো তো যেতেই পারে।

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

14h ago