স্মৃতিতে ভয়াবহ ২১ আগস্ট, শরীরে স্প্লিন্টার

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা

২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা…। প্রশ্ন শেষ করার আগেই এটুকু শুনে কেঁপে ওঠেন দৌলতুন নাহার। তার চোখে-মুখে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যন্ত্রণা আর মানসিক আঘাতের ছাপ। তার শরীরে আজও রয়ে গেছে কয়েক শ স্প্লিন্টার, যার ব্যথায় রাতের পর রাত ঘুমাতে পারেন না তিনি।

৫৫ বছর বয়সী এই নারী সেদিনের ভয়াবহ হামলা বেঁচে গেলেও হারিয়েছেন বাম চোখের দৃষ্টি। সেই সঙ্গে তৈরি হয়েছে নানান স্বাস্থ্যগত জটিলতা। বাংলাদেশ ও ভারতে ৬টি অস্ত্রোপচারের পরও ঠিকমতো হাঁটতে পারেন না দৌলতুন নাহার। সেদিনের কথা মনে পড়লে আজও তার হাড় হিম হয়ে আসে।

তৎকালীন পল্লবী থানা মহিলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি দৌলতুন নাহার দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নেত্রীর (আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা) বক্তৃতা শেষের দিকে। তখন হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম। তারপর আরও কয়েকটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ হলো। স্প্লিন্টারের আঘাতে আমি নিচে পড়ে যাই এবং জ্ঞান হারাই। জ্ঞান ফেরার পর দেখতে পাই, আমার পা থেকে প্রচুর রক্ত বের হচ্ছে।'

তিনি আরও বলেন, 'সবকিছু আজও মনে হয় যেন দুঃস্বপ্ন। অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু সেই কষ্টের স্মৃতি কোনোভাবেই ভুলতে পারি না। আমরা এখন শুধু চাই, অপরাধীদের বিচার ও মৃত্যুদণ্ড।'

আজ ২১ আগস্ট সেই ভয়াবহ হামলার ১৯তম বার্ষিকী। সেই হামলায় ২৪ জন নিহত হয়েছিলেন এবং আহত হয়েছিলেন অন্তত ৩০০ জন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা—তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী—ডান কানে আঘাত পেয়ে অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা পান। এ ঘটনায় নিহতদের মধ্যে রয়েছেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমান।

সেদিনের হামলার পরও বেঁচে ফেরা আরও ৩ জনের বর্ণনায় উঠে এসেছে কী অবর্ণনীয় কষ্টের মাঝে দিনযাপন করছেন তারা। শরীরে কয়েক শ স্প্লিন্টার নিয়ে বেঁচে থাকার কষ্ট, মানসিক আঘাত ও আর্থিক চাপ—সবই উঠে এসেছে তাদের কথায়।

২০০৪ সালে মিরপুর এলাকায় আওয়ামী লীগ কর্মী ছিলেন রত্না আক্তার রুবি (৪২)। ২১ আগস্ট হামলার পর সবাই তাকে মৃত ভেবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ফেলে রাখে।

রুবি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জ্ঞান ফেরার পর দেখি, আমি মর্গের ভেতরে আরেকটি মরদেহের পাশে। এরপর ধীরে ধীরে অনেকটা সুস্থ হয়েছি। কিন্তু, শারীরিক ও মানসিক ক্ষত পিছু ছাড়েনি। ডাক্তাররা বলেছিলেন, যতদিন বাঁচব, ততদিন এই ব্যথা সহ্য করতে হবে। এই যন্ত্রণা এতই বেশি, অনেক সময় মনে হয় সেদিন মরে গেলেই ভালো হতো।'

গ্রেনেড হামলার পর সংবাদপত্রে যে ছবিগুলো প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে রক্তমাখা শাড়িতে রুবিকে দেখা গেছে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে পড়ে থাকা নিহতদের মধ্যে। এ ঘটনার কয়েক মাস পরে তার ডান কিডনি অস্ত্রোপচার করে অপসারণ করতে হয়েছে। এখনো তার শরীরে প্রায় ৫০টি স্প্লিন্টার রয়েছে।

মাঝেমধ্যেই ২ পা ফুলে যায় রুবির। শরীরে বাসা বেঁধেছে চর্মরোগসহ নানান রোগ। প্রতি মাসে তার চিকিৎসায় খরচ হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা।

সেলিনা খাতুন ও নার্গিস আক্তারের গল্পও অভিন্ন।

কলাবাগান ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদক সেলিনা (৪৩) তার বোনকে চোখের সামনে মরে যেতে দেখেছেন। তিনি বেঁচে গেলেও শরীরে বয়ে নিয়ে চলেছেন ১ হাজারেরও বেশি স্প্লিন্টার।

ডেইলি স্টারকে সেলিনা বলেন, 'সেদিন আমি আর আমার বড় বোন সুফিয়া খাতুন সমাবেশের তৃতীয় সারিতে বসেছিলাম। ঘটনার আকস্মিকতায় দেখলাম আমার বোন রাস্তায় পড়ে আছেন, চারদিক রক্তে ভেসে যাচ্ছে।'

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস সহকারী পদে চাকরি করতেন সেলিনা। ওই ঘটনার পর তিনি চাকরিটাও হারিয়েছেন। সেলিনা জানান, সংসার আর চিকিৎসার খরচ চালাতে তাকে নিত্য সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

সেদিনের কথা বলতে গিয়ে ভাটারা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদক ৫০ বছর বয়সী নার্গিস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি সেদিন অস্থায়ী মঞ্চের উত্তর পাশে ছিলাম। কিছু বোঝার আগেই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। মনে হলে আজো সবকিছু চোখের সামনে ভেসে ওঠে।'

তিনি আরও বলেন, '১৯ বছর কেটে গেছে। অথচ, পুরোপুরি সুস্থ হতে পারিনি। এখনো শক্ত খাবার খেতে পারি না। অনেক দিন কাটিয়েছি পানির ভেতর। এখনো খাবারের চেয়ে বেশি ওষুধ খাই।'

'আমার একটাই দাবি—দোষীদের শাস্তি। তাদের শাস্তি দিলে কিছুটা স্বস্তি পাবো,' বলে মন্তব্য করেন তিনি।

২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর দেওয়া রায়ে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল এই ভয়াবহ হামলার ঘটনায় দায়ের করা ২ মামলায় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

এ ছাড়াও, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে হত্যার অভিযোগে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

Comments

The Daily Star  | English

Ending impunity for crimes against journalists

Though the signals are mixed we still hope that the media in Bangladesh will see a new dawn.

10h ago