ফরিদপুরের জন হাট: যেখানে শ্রম বিক্রি হয়

জন হাট
ফরিদপুর শহরের পশ্চিম গোয়ালচামটে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উত্তর পাশে জন হাট। ছবি: সুজিত কুমার দাস/স্টার

ফরিদপুরসহ আশপাশের জেলাগুলোয় চলছে পাট কাটার মৌসুম, তাই এসব জেলাতে শ্রমিকের চাহিদা বেড়েছে। ফলে, দেশের নানান স্থান থেকে মানুষ এসে ভিড় করছেন ফরিদপুরের 'জন হাটে', এটি মূলত শ্রম বিক্রির হাট।

ফরিদপুর শহরের পশ্চিম গোয়ালচামট এলাকায় ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উত্তর পাশে ৩০ শতাংশ জমির ওপর স্থানীয়দের কাছে 'জন হাট' হিসেবে পরিচিত এই হাটটি। মূলত ফরিদপুরসহ এই অঞ্চলে শ্রমিকের চাহিদা বেশি থাকে, বিশেষ করে ফসল রোপণ ও কাটার সময়। সেই প্রয়োজন থেকেই এই হাটটি গড়ে ওঠে।

হাট কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, হাটটি ৫০ বছরের বেশি পুরনো। শুরুতে এটি শহরের হাজি শরীয়তউল্লাহ বাজারের দক্ষিণ পাশের গলিতে ছিল। কিন্তু, ২০০৭ সালে গোয়ালচামট মহল্লার পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় স্থানান্তর হয় এবং ২০১৬ সালে সেখান থেকে উচ্ছেদ করা হয়।

উচ্ছেদের ৭ মাস পর ফরিদপুর শহরের মোল্লা বাড়ী এলাকার বাসিন্দা মো. আবুল কালাম শেখ ওরফে বাবু শেখ বর্তমানে স্থানে আবার হাট বসান।

২০১৭ সালের শুরুর দিকে হাটটি ফরিদপুরের বাইপাস এলাকায় নিয়ে যান স্থানীয় এক রাজনীতিক। কিন্তু, ২০১৯ সালে করোনা মহামারি শুরু হলে হাটটি আবার বন্ধ হয়ে যায়। পরে ২০২০ আবারও মো. আবুল কালাম স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় হাটটি বর্তমান স্থানে ফিরিয়ে আনেন।

হাট কর্তৃপক্ষ জানান, পাট কাটার মৌসুমে প্রতিদিন গড়ে এখানে ২৩০-২৫০ শ্রমিকের শ্রম বিক্রি হয়। বছরের অন্য সময় এই সংখ্যা থাকে ১০০-১২০ জন। শ্রমিকের চাহিদার ওপর নির্ভর করে শ্রমের দর। বর্তমানে একজন শ্রমিক দৈনিক ৭০০ টাকায় কাজ নেন।

এখানে বেশিরভাগ শ্রমিক আসেন চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, দিনাজপুরসহ উত্তরবঙ্গের অন্যান্য জেলা থেকে।

হাটে গিয়ে দেখা যায়, জটলা করে দরদাম করছেন শ্রমিক নিতে আসা ব্যক্তিরা। শ্রমিকরা তাদের সঙ্গে কথা বলছেন, কী ধরনের কাজ করতে হবে তা নিয়ে। কাজের ধরন ও দাম ঠিক হলে হাট কর্তৃপক্ষের কাছে প্রতি শ্রমিকের জন্য ১০ টাকা দিয়ে নাম, ঠিকানা, মুঠোফোন নম্বর লিখে রাখার পর শ্রমিক নেওয়ার অনুমতি মেলে।

চুয়াডাঙ্গা থেকে সবুর আলী (৫৩) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি এক সপ্তাহ আগে এখানে এসেছি। যেদিন এসেছি সেদিন গিয়েছিলাম ফরিদপুর সদর উপজেলার গোপালপুর এলাকায়। ওই বাড়িতে প্রতিদিন ৭০০ টাকা মজুরিতে এক সপ্তাহ কাজ করেছি। খাওয়া বাড়িওয়ালা দিয়ে থাকেন।'

তিনি আরও বলেন, 'আমাদের এলাকায় এখন কাজ কম। প্রতিদিন কাজ করলে দেয় ৩০০ টাকা। আর এই এলাকায় দেয় ৭০০ টাকা, এটা শুনে এসেছি। এখানে ১ সপ্তাহে যে টাকা পেয়েছি আমাদের এলাকায় তা ১ মাসেও আয় করা সম্ভব না।'

রাজশাহী থেকে আসা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন (৩৬) ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি ২ বছর ধরে পাট কাটার মৌসুমে এই হাটে আসি। এখানে ১ মাসে সব খরচ বাদ দিয়ে ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারি। আর এই সময় যদি এলাকায় থাকি, সারা মাসে ৫ হাজার টাকা আয় করা কঠিন।'

হাটে জন কিনতে আসা ভাঙ্গার মালিগ্রাম এলাকার শফিকুল মৃধা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই হাট থেকে আমি প্রতি বছর পাট কাটার সময় শ্রমিক নিয়ে যাই। পাট কাটার এই সময় স্থানীয় শ্রমিকদের প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা দিতে। অথচ তারা, সকাল ৮টায় এসে দুপুর ৩টায় চলে যায়। আর এখান থেকে শ্রমিক নিলে সারাদিন কাজ করে।'

গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর উপজেলা থেকে জন কিনতে আসা আবু শিকদার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমাদের এলাকায় এখন শ্রমিক সংকট। পরিচিত একজনের মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে এখানে এসেছি শ্রমিক নিতে। আমার মোট ৫ বিঘা জমির পাট কাটতে হবে। তাই ৫ জনকে নিয়ে যাচ্ছি। কাজ শেষ হতে ১০-১২ দিন সময় লাগবে।'

এই হাটকে ঘিরে শুধু মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হয়নি, গড়ে উঠেছে দোকানপাট। এসব দোকানে নাস্তা, দুপুরের খাবার, পুরনো জামা-কাপড়, কৃষি কাজের কাচি, দা, খোন্তা, নিড়ানিসহ নানা ধরনের সরঞ্জাম বিক্রি হয়। সেখানে কয়েকটি সেলুনও গড়ে উঠেছে।

ফরিদপুর সদরের কৈজুরি ইউনিয়নের সমেশপুর গ্রামের বাসিন্দা ওবায়দুর শেখ (৩৬) এখানে কৃষি সরঞ্জাম বিক্রির দোকান দিয়েছেন। তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি দা, কাচি, খোন্তা, নিড়ানি বিক্রি করি। প্রতিটির দাম ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে। আমি দিনে ৪০ থেকে ৫০টি কৃষি সরঞ্জাম বিক্রি করি।'

হাটের তত্ত্বাবধানে থাকা আবুল কালাম শেখ ওরফে বাবু শেখ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হাটে ফরিদপুরের ৯ উপজেলাসহ পার্শ্ববর্তী গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, রাজবাড়ী থেকে মানুষ শ্রমিক নিয়ে যান। এখান থেকে যারা শ্রমিক নিয়ে যান- আমরা তাদের নাম, ঠিকানা, মুঠোফোন নম্বর লিখে রাখি। অনেক সময় দেখা যায় শ্রমিকের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেকে ঠিক মতো টাকা পাচ্ছেন না। তখন তাদের সঙ্গে কথা বলে সুরাহা করি।'

তিনি জানান, যে স্থানে এই হাট বসেছে এই জায়গার ভাড়া হিসেবে মালিককে প্রতিদিন ১ হাজার টাকা দিতে হয়। এ ছাড়া, মোট ৫ জন হাটের দেখাশোনার কাজ করেন। প্রতিদিন তাদের ৬০০ টাকা করে আয় হয়।

ফরিদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) সুমন রঞ্জন সরকার ডেইলি স্টারকে বলেন, 'জন হাটটি পুলিশের নজরদারিতে আছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় কেউ যেন শ্রমিক ও হাট মালিকের কাছে চাঁদাবাজি করতে না পারে এ ব্যাপারে আমরা সতর্ক আছি।'

ফরিদপুর শহরের পশ্চিম গোয়ালচামটে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কের উত্তর পাশে জন হাট। ছবি: সুজিত কুমার দাস/স্টার

Comments

The Daily Star  | English

ACC to investigate irregularities in 11th National Election

A five-member team has been formed to investigate these allegations

22m ago