চামড়া থেকে তোলা মাংসই যখন আরাধ্য

গোদারাঘাট বাজারে চামড়া থেকে মাংস তোলার কাজ করছেন শ্রমিকরা। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

কবিতায় বিনয় মজুমদারের সত্যভাষণটা ছিল এরকম- 'সকল ফুলের কাছে এত মোহময় মনে যাবার পরেও/মানুষেরা কিন্তু মাংস রন্ধনকালীন ঘ্রাণ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।'

ঈদের দিন দুপুরের পর থেকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় কোরবানির মাংসের অস্থায়ী বাজার বসার চিত্র মোটামুটি সবার কাছে পরিচিত। নিম্ন আয়ের অনেকেই বাড়ি বাড়ি থেকে সংগ্রহ করা মাংস বিক্রির জন্য হাজির হন এসব বাজারে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ীরাও এ মাংসের বড় ক্রেতা হন। ফলে দামও থাকে খানিকটা বাড়তি।

তবে মৌলভীবাজার সদর উপজেলার বালিকান্দি গ্রামের গোদারাঘাট এলাকায় কোরবানির সময় মাংসের যে অস্থায়ী হাট বসে সেটা কিছুটা ব্যতিক্রম।

এখানেই অবস্থিত প্রায় ২০০ বছরের পুরনো একটি চামড়ার বাজার। কোরবানির সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে চামড়া সংগ্রহের পর এখানেই সেই চামড়া থেকে মাংস ছেঁটে নেওয়ার কাজ করেন দেড় হাজারের বেশি শ্রমিক। আর চামড়া থেকে তুলে নেওয়া সেই মাংস বিক্রি হয় অবিশ্বাস্য কম দামে, যার বেশিরভাগ ক্রেতা দরিদ্র খেটে খাওয়া মানুষ।

বিক্রির জন্য রাখা মাংস। ছবি: মিন্টু দেশোয়ারা/স্টার

গতকাল থেকেও ঢাকা ও ঢাকার বাইরে কোরবানির মাংসের অস্থায়ী অস্থায়ী বাজারগুলোতে কেজিপ্রতি মাংস বিক্রি হয়েছে ৫০০-৮০০ টাকার মধ্যে। অথচ গোদারাঘাটে প্রতি কেজি মাংস বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকারও কম দামে।

গোদারাঘাটে মাংসের এই অস্থায়ী হাটটি শুরু হয় ঈদের দিন বিকেল থেকে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতার ভিড়ও বাড়তে থাকে। চলে ঈদের দ্বিতীয় দিন পর‌্যন্ত।

ঈদের আগে টানা কয়েকদিনের বৃষ্টির কারণে কাজে যেতে পারেননি দিনমজুর সাজিদুর রহমান। তাই ঈদ করার মতো হাতে তেমন টাকাও ছিল না তার। তবে ছেলের আবদার মেটাতে সস্তায় কিছু মাংস কিনতে গতকাল রাতে গোদারাঘাটে এসেছিলেন তিনি।

সাজিদুর জানালেন, ছেলের ইচ্ছা পূরণে এখান থেকে ৫০০ টাকা দিয়ে ৬ কেজি মাংস কিনেছেন তিনি।

এই মাংসের হাটটি যে গ্রামে বসে সেই বালিকান্দির বাসিন্দা আব্দুর রহমানও একজন খেটে খাওয়া মানুষ। অত্যাধিক দামের কারণে সারাবছর গরুর মাংস খাওয়া হয় না তার ও তার পরিবারের। তবে ঈদের সময় চামড়ার বাজারে চামড়া থেকে মাংস তোলার কাজ করেন। এতে চামড়ার আকার অনুসারে ১৫-৩০ টাকা মতো পান। তুলে নেওয়া মাংস তারই থাকে। নিজের জন্য কিছু রেখে সেই মাংস তিনি আবার এই অস্থায়ী হাটে ৫০-৭০ টাকায় বিক্রি করেন।

আব্দুর রহমান বলেন, 'প্রতি বছর কোরবানি ঈদের দিন ও ঈদের দ্বিতীয় দিন আমি এই ব্যবসা করি। নিজেরে এই সময়টায় বড়লোক বড়লোক মনে হয়।' তার ভাষ্য, রাত বাড়ার সঙ্গে এই হাটে ক্রেতার সংখ্যাও বাড়তে থাকে।

মাংস কিনতে গত রাতে গাড়ির হেলপার সাদ্দাম মিয়াও এসেছিলেন এখানে। তিনি বলেন, 'এখানে গরুর মাংসের দাম খুবই কম। এত কম দামে আর কোথাও গরুর মাংস পাওয়া যায় বলে আমার জানা নেই। আমি প্রতি বছর কোরবানি ঈদের রাতে এখানে গোশত কিনতে আসি। করোনার কারণে মাঝখানে কিনতে পারিনি। গত বছর থেকে আবার কিনতে শুরু করেছি।'

চামড়ার বাজারে পাহারাদার হিসেবে কাজ করেন পাশ্ববর্তী গিয়াসনগরের মবরুল মিয়া। তার ভাষ্য, প্রতি বছর ঈদের সময় এত কম দামে মাংস কিনতে পেরে তার ঈদের আনন্দ 'ডাবল' হয়ে যায়।

কথা হয় বালিকান্দি চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি মো. শওকতের সঙ্গে। তার বক্তব্য অনুসারে, প্রায় ২০০ বছর আগে চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের মনু নদের তীর ঘেঁষে এই চামড়ার বাজারটি গড়ে ওঠে। কোরবানি ঈদের সময় বিভিন্ন এলাকা থেকে চামড়া সংগ্রহ করার পর প্রায় ১৫০০-২০০০ শ্রমিক চামড়া থেকে মাংস তোলার কাজ করেন। সেই মাংস শ্রমিকদেরই থাকে। তারা সেটি অস্থায়ী হাটি বিক্রি করেন। আর চামড়া পরিষ্কার করলে চামড়ার আকার অনুপাতে পারিশ্রমিক দেওয়া হয় শ্রমিকদের।

 

Comments

The Daily Star  | English

Pilots faked flying records

CAAB inquiry finds, regulator yet to take action

11h ago