কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে সৃষ্ট বেকারত্বের ভয়াবহ পরিণতির ওপর বিশেষ জোরারোপ ড. ইউনূসের
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২৩ মে থেকে ১ জুন পর্যন্ত ইউরোপে ১০ দিনের সফরকালে বিশ্বব্যাপী ইতিবাচক পরিবর্তনের লক্ষ্যে জার্মানি, ইতালি ও ফ্রান্সে কয়েকটি উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক করেছেন। এ সময় তিনি বেশ কয়েকটি স্থানে বক্তৃতা দেন এবং কয়েকটি চুক্তিতে সই করেন।
জার্মানির বিসবাডেনের টাউন হলে অধ্যাপক ইউনূসকে স্বাগত জানান শহরটির মেয়র। শহরটিকে ইতোমধ্যে সামাজিক ব্যবসাকেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে।
বিসবাডেনে গ্রামীণ ক্রিয়েটিভ ল্যাব, ইউনূস এনভায়ারনমেন্ট হাব ও ওয়াই-ওয়াই ফাউন্ডেশন স্থাপিত হয়েছে।
এই শহরের বিষয়ে আগ্রহের জন্য শহরের মেয়র তার বক্তৃতায় অধ্যাপক ইউনূসের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
বিসবাডেনের ফাওন মিউজিয়াম বা নারী যাদুঘর এবং রোটারি ক্লাব অব বিসবাডেন রাইন মাইনে অধ্যাপক ইউনূস নারীর ক্ষমতায়নের ওপর বক্তব্য রাখেন। তিনি এই রোটারি ক্লাবের সদস্য।
ক্লাবটি বিসবাডেনের কেন্দ্রীয় উদ্যানে অধ্যাপক ইউনূসের ৮০তম জন্মদিনে একটি বৃক্ষরোপণ করে।
নগরীর পুরোনো আদালত ভবনকে একটি সামাজিক ব্যবসা ইনকিউবেটরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। অধ্যাপক ইউনূসকে সেখানে স্বাগত জানানো হয়। তিনি সেখানে স্থানীয় তরুণ উদ্যোক্তা ও সামাজিক উদ্ভাবকের উদ্দেষে বক্তৃতা দেন এবং তাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।
ইতালির ট্রেনটো নগরী ভ্রমণকালে ড. ইউনূস ট্রেনটো অর্থনৈতিক উৎসবে মূলবক্তা হিসেবে ভাষণ দেন। অনুষ্ঠান চলাকালে মঞ্চেই তার সাক্ষাৎকার নেন দেশটির শীর্ষ অর্থনীতিবিষয়ক পত্রিকা ইল অরে ২৪ এর উপসম্পাদক লরা লা পস্তা।
সম্মেলনে যোগদানের পাশাপাশি তিনি ইতালির সাবেক প্রধানমন্ত্রী রোমানো প্রদি, ফ্লাভিয়া ফ্রাজোনি অধ্যাপক ফ্লাভিয়া প্রদি, আনিয়া শ্রিফরিন এবং নোবেলবিজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক জোসেফ স্টিগলিটজের সঙ্গে বৈঠক করেন।
এ ছাড়া, অধ্যাপক ইউনূস ইউনেস্কোর ক্রীড়া বিভাগের প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং ইউনূস স্পোর্টস হাবের সঙ্গে ইউনেস্কোর সহযোগিতা বিষয়ক একটি চুক্তিতে সই করেন।
তিনি জাতিসংঘের 'জিরো ওয়েস্ট' কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গেও বৈঠক করেন। ড. ইউনূস এ বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।
এ সফরে অধ্যাপক ইউনূস ড্যানোনের প্রধান নির্বাহীর সঙ্গে বৈঠক করেন। গ্রামীণ ও ড্যানোনের মধ্যকার পার্টনারশিপের অধীনে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ-ড্যানোন ফুডস লি. দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে।
ড. ইউনূস ফ্রান্সের নেতৃস্থানীয় বিজনেস স্কুল 'এইচইসি প্যারিস' এর ১৫তম বার্ষিক সোশ্যাল বিজনেস সার্টিফিকেট বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন। বিশ্ববিদ্যালয়টি ১৫ বছর আগে সামাজিক ব্যবসার ওপর একটি 'ইউনূস চেয়ার' প্রতিষ্ঠা করে এবং একটি সামাজিক ব্যবসা সার্টিফিকেট চালু করে।
ফ্রান্সের সাবেক মন্ত্রী এবং দারিদ্র বিমোচন বিষয়ক কমিশনার মার্টিন হার্চ, এইচইসি প্যারিসের কয়েকজন অধ্যাপক, ফ্রান্সের কয়েকটি নেতৃস্থানীয় কোম্পানির প্রধান নির্বাহীরা এই সার্টিফিকেট অর্জন করেছেন।
এ ছাড়া, ড. ইউনূস স্পোর্টসওয়্যার প্রতিষ্ঠান ডেক্যাটলনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেন। ডেক্যাটলনের পক্ষ থেকে খেলাধুলা ও সামাজিক ব্যবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং এজন্য প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে ইউনূস স্পোর্টস হাবের সঙ্গে যৌথভাবে থাইল্যান্ডে কাজ করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
প্যারিসের মেয়র অ্যানে হিদালগো এবং ইনকোর আমন্ত্রণে অধ্যাপক ইউনূস ইমপ্যাক্ট-২ এর শ্রোতাদের উদ্দেশে বক্তৃতা দেন। ইমপ্যাক্ট-২ পৃথিবীর ৬০টি দেশে সামাজিক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে।
প্যারিস সিটি টাউন হলে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে ব্যবসা উদ্যোক্তা ও গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনসহ প্রায় ১ হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন।
অধ্যাপক ইউনূস ইউরোপিয়ান কমিশনার অন সোশ্যাল ইকোনমি নিকোলাস স্মিথের সঙ্গেও বৈঠক করেন।
কমিশনার স্মিথ সাম্প্রতিককালে বিশ্বব্যাপী সামাজিক ব্যবসার অভূতপূর্ব প্রসারের বিষয়টি তুলে ধরেন এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নে এর ক্রমবর্ধমান গুরুত্বের উপর জোর দেন।
এ সফরে বিভিন্ন বৈঠক ও অনুষ্ঠানে ড. ইউনূস একটি নতুন সভ্যতা তৈরির প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেন, যা মুনাফা সর্বোচ্চকরণের পরিবর্তে পারস্পরিক যত্ন, সহযোগিতা ও ভাগ করে নেওয়ার সংস্কৃতির ওপর গড়ে উঠবে।
তিনি বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, সম্পদ কেন্দ্রীকরণ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কারণে সৃষ্ট বেকারত্বের ভয়াবহ পরিণতির ওপর বিশেষভাবে জোর দেন এবং তার অংশগ্রহণ করা প্রতিটি অনুষ্ঠানে স্বার্থপরতাবর্জিত সামাজিক ব্যবসা উদ্যোগকে সহায়তা করতে এবং এ জন্য সামাজিক ব্যবসা ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড প্রতিষ্ঠা করতে আহ্বান জানান।
তিনি '৩-শূন্য ক্লাব' গঠনের ওপর বিশেষভাবে জোর দেন, যা তরুণ সমাজকে শূন্য বৈশ্বিক উষ্ণায়ন, শূন্য সম্পদ কেন্দ্রীকরণ ও শূন্য বেকারত্বভিত্তিক একটি 'তিন শূন্য'র নতুন সভ্যতা সৃষ্টির মাধ্যমে একটি অধিকতর বাসযোগ্য ও টেকসই পৃথিবী সৃষ্টিতে সক্রিয় হতে উদ্বুদ্ধ করবে।
Comments