‘আজমেরী ওসমানকে বন্দুক, পিস্তলের লাইসেন্স দিলে আতঙ্ক ছড়াবে’
দুটি আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আবেদন করেছেন আজমেরী ওসমান। আলোচিত ত্বকী হত্যাসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তাকে অস্ত্রের লাইসেন্স দিলে নারায়ণগঞ্জবাসী সন্ত্রাসীদের কাছে আবারও জিম্মি হয়ে পড়বে বলে মনে করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীও আজমেরী ওসমানকে অস্ত্রের লাইসেন্স না দেওয়ার পক্ষে।
তারা বলছেন, আজমেরী ওসমান ও তার বাহিনীর কাছে বিপুল পরিমাণ অবৈধ অস্ত্র আছে। তারা প্রায়ই এসব ব্যবহার করেন এবং শহরের মানুষকে আতঙ্কে রাখেন। আজমেরী ওসমান অস্ত্রের লাইসেন্স পেলে মানুষ আরও আতঙ্কে থাকবেন। প্রশাসনের উচিত হবে তাকে লাইসেন্স না দেওয়া।
আজমেরী ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের প্রয়াত সংসদ সদস্য এ কে এম নাসিম ওসমানের ছেলে। তার দুই চাচার মধ্যে এ কে এম সেলিম ওসমান একই আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য এবং এ কে এম শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য। আজমেরী ওসমানের মা পারভীন ওসমান জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য। তিনি স্বামীর আসনে নির্বাচন করতে চান, এজন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশ সুপারের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, গত ৯ মার্চ একটি বন্দুক ও একটি পিস্তলের লাইসেন্সের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে আবেদন করেন আজমেরী ওসমান। এর আগের দিন ৮ মার্চ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের ১০ বছর পূর্তি হয়। আজমেরী ওসমানের আবেদনের বিষয়টি তদন্তের জন্য জেলা পুলিশ সুপার কার্যালয়ের বিশেষ শাখায় (এসবি) পাঠানো হয়। আজমেরী ওসমানের নিবাস ফতুল্লা মডেল থানা এলাকায় হওয়ায় পুলিশ সুপার কার্যালয় থেকে ওই থানাকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিষয়টি তদন্তাধীন বলে আজ বুধবার বিকেলে দ্য ডেইলি স্টারকে জানান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রিজাউল হক দিপু।
তিনি বলেন, 'অস্ত্রের লাইসেন্সের বিষয়টি অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটি এসপি অফিস থেকে থানা পর্যায়ে তদন্তের জন্য পাঠানো হয়। গত সোমবার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ('ক'-সার্কেল) এর অফিসে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবে।'
এ বিষয়ে জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ('ক'-সার্কেল) নাজমুল হাসান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বিষয়টি তদন্তাধীন আছে। নিয়ম অনুযায়ী তদন্তের পর যাচাই-বাছাই করে প্রতিবেদন দেওয়া হবে। এই প্রতিবেদন এসপি অফিস হয়ে পরে যাবে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে।'
২০১৩ সালের ৬ মার্চ অপহরণের পর নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন নারায়ণগঞ্জের মেধাবী কিশোর তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী। দুই দিন পর শীতলক্ষ্যা নদীর শাখা খাল থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডে আজমেরী ওসমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল।
এ ছাড়াও, আজমেরী ওসমান ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে হত্যা, ব্যবসায়ীদের ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। আরও অভিযোগ, আজমেরীর 'হোন্ডা বাহিনী' নারায়ণগঞ্জ শহর দাপিয়ে বেড়ায়। এই বাহিনীর বিরুদ্ধে সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কথা বলেছেন, প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
এমন অবস্থায় আজমেরী ওসমানের অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে মেয়র আইভী ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এমনিতেই এই শহরে অবৈধ অস্ত্রের ছড়াছড়ি। এখন আবার অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়ার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। ত্বকী হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার আসামি ভ্রমর ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতেও আজমেরী ওসমানের নাম বলেছেন। তাকে অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হলে শহরে আরও আতঙ্ক ছড়াবে। এটা সরকারের পক্ষে ইতিবাচক কোনো ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয় না। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হবে। এতে কেবল ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল হবে। নারায়ণগঞ্জের মানুষ আতঙ্কিত হবে, আবার সন্ত্রাসের জনপদে পরিণত হবে, শান্ত পরিবেশ আর থাকবে না। প্রশাসনকে অনুরোধ জানাব, তাকে যেন অস্ত্রের লাইসেন্স না দেওয়া হয়।'
নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রশাসন তার (আজমেরী ওসমান) ব্যাপারে সবই জানে। সবকিছু জানার পরও যদি এই ধরনের মানুষের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়, তাহলে তা কতটুকু সঠিক হবে তারাই বলতে পারে। অবৈধভাবেই তারা অস্ত্র ব্যবহার করে, বৈধভাবে অস্ত্র পেলে তো আরও বেপরোয়া হয়ে যাবে।'
ত্বকীর বাবা ও সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ত্বকী হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পর আজমেরী ওসমানের অন্যতম সহযোগী সুলতান শওকত ভ্রমর ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। জবানবন্দিতে ভ্রমর জানান, আজমেরী ওসমানের নেতৃত্বে অপহরণের পর শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে আজমেরীর টর্চার সেলে ১১ জন মিলে ত্বকীকে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করে। ত্বকী হত্যার এক বছরের মাথায় সংবাদ সম্মেলনে র্যাবও একই কথা জানিয়েছিল। ত্বকী হত্যার পর র্যাব আজমেরীর টর্চার সেলে অভিযান চালিয়ে রক্তমাখা প্যান্ট, পিস্তলের বাট, মাদক ও নির্যাতনের সরঞ্জাম জব্দ করে।'
রাব্বি বলেন, 'শুধু ত্বকী না, নারায়ণগঞ্জের আশিক, চঞ্চল, ভুলু ও মিঠু হত্যাকাণ্ডেও আজমেরী ওসমান জড়িত। এই শহরে প্রতিনিয়ত চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আছে আজমেরী ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে। সে নারায়ণগঞ্জে ৪-৫টা টর্চার সেল চালাত। এখনো অবৈধ অস্ত্র ও হোন্ডার মহড়া দিয়ে শহর দাপিয়ে বেড়ায় আজমেরী ও তার লোকজন। এমন এক ব্যক্তি কীভাবে অস্ত্রের লাইসেন্স চায়, সেটিই চিন্তার বিষয়। তাকে অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হলে নারায়ণগঞ্জের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়বে। সারাদেশের মানুষ জানে, খুনি-সন্ত্রাসী-জল্লাদদের হাতে নারায়ণগঞ্জ জিম্মি, সেটিই আবার সত্য প্রমাণিত হবে।'
আজমেরী ওসমানকে অস্ত্রের লাইসেন্স না দিয়ে বরং তাকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান রফিউর রাব্বি।
নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান মাসুম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আজমেরী ওসমান ও তার সন্ত্রাসী বাহিনীর কাছে বেআইনি অস্ত্রের ছড়াছড়ি বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব অবৈধ অস্ত্র জব্দ করে তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। উল্টো যদি এদের কাছে অস্ত্রের লাইসেন্স যায়, তাহলে তারা আবারও শহরটাকে অস্থিতিশীল করে তুলবে। এই শহর ও শহরের মানুষ আবারও জিম্মি হওয়ার প্রক্রিয়ার দিকে যাবে। সুতরাং আমার আবেদন থাকবে আজমেরী ওসমান ও তার মতো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত লোকজনকে অস্ত্রের লাইসেন্স না দেওয়া এবং যাদের কাছে অস্ত্রের লাইসেন্স আছে কিন্তু সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত তাদের লাইসেন্সও বাতিল করতে হবে।'
নারায়ণগঞ্জে বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্সধারীদের তালিকা প্রকাশেরও আহ্বান জানান তিনি।
আজমেরী ওসমানের অস্ত্রের লাইসেন্সের আবেদনে হতবাক হওয়ার কথা জানিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) নারায়ণগঞ্জ জেলা সভাপতি ধীমান সাহা জুয়েল।
তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটা কোনোভাবেই আমরা আশা করি না। আজমেরী ওসমান অস্ত্রের লাইসেন্স পেলে শহরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড আরও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছি। প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাই, তাকে যেন কোনোভাবেই অস্ত্রের লাইসেন্স না দেওয়া হয়। এই ধরনের লোকদের অস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া মানে সমাজে অপরাধকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের দিকে ঠেলে দেওয়া।'
'আজমেরী ওসমান শুধু ত্বকী হত্যাকাণ্ডই না, আশিক, চঞ্চল, ভুলুসহ আরও অনেক হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ রয়েছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, লুটপাটে আজমেরী ওসমান ও তার বাহিনী সম্পৃক্ত বলেও অভিযোগ আছে। কিন্তু এই শহরে তার ত্রাস এতটাই যে, তার বিরুদ্ধে মামলা করার সাহস কেউ পায় না। পুলিশ-প্রশাসন আজ্ঞাবহ হওয়া তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা নেই। দ্বিতীয়ত, আমাদের দেশে সাক্ষী সুরক্ষা আইন নেই। যে কারণে অনেকেই মামলা করার সাহস পান না। তার নামে মামলা না থাকার মানে এই না যে, তিনি নিরপরাধ, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।'
সর্বশেষ গত ১৬ মার্চ আজমেরী ওসমানের সন্ত্রাসী বাহিনী বন্দর উপজেলার ফরাজিকান্দা এলাকায় ৬৬ শতাংশ জমি দখলে যান বলে অভিযোগ পাওয়া যায়। এসময় জমির মালিক ও স্থানীয়দের বাধা পেয়ে গুলি চালান তারা। গুলিতে জমির মালিক মঈনুল হক পারভেজ ও তার স্ত্রী আহত হন। ঘটনার ২০ দিন পর চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মঈনুল।
গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি ত্বকী হত্যাকাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ায় 'সময়ের নারায়ণগঞ্জ' নামে স্থানীয় একটি পত্রিকা অফিসে আজমেরী ওসমানের লোকজনের হামলা চালানোর অভিযোগ রয়েছে। ওই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানায় পত্রিকাটির সম্পাদক জাবেদ আহমেদ জুয়েল বাদী হয়ে আজমেরী ওসমানের ১৯ সহযোগীর নাম উল্লেখসহ ৫৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
২০২০ সালে আজমেরী ওসমান ও তার ৩ সহযোগীর বিরুদ্ধে হত্যার হুমকির অভিযোগ জানান মডেল ডি ক্যাপিটাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে একটি পোশাক কারখানার ডিজিএম অরূপ কুমার সাহা। সেসময় অভিযোগটি ফতুল্লা মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি হিসেবে রেকর্ড করা হয়। এ ছাড়াও, নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন থানায় একাধিক সাধারণ ডায়েরি রয়েছে যেখানে বাদীরা উল্লেখ করেছেন, তাদের কাছে আজমেরী ওসমানের নামে চাঁদা চাওয়া হয়েছে।
২০১৯ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রাতে শহরের আল্লামা ইকবাল রোডে (কলেজ রোড) আজমেরী ওসমানের ব্যক্তিগত কার্যালয় ও বাসায় অভিযান চালিয়ে এক ব্যবসায়ীর কাছে চাঁদাবাজির অভিযোগে তার ২ সহযোগীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
আজমেরী ওসমানের অস্ত্রের লাইসেন্স চাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আবেদনের পর সেটি তদন্তের জন্য এসপি অফিসে দেওয়া হয়। আজমেরী ওসমান দুটি অস্ত্রের জন্য আবেদন করেছেন। একটি শটগান (বন্দুক) ও একটি পিস্তল। শটগানটির লাইসেন্স জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে দেওয়া হয়। কিন্তু পিস্তলের লাইসেন্সের জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রতিবেদন পাঠানো হবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। মন্ত্রণালয় পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত নেবে।'
'আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য আবেদন যে কেউ করতে পারেন। তবে তিনি অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্য কি না, সেটি যাচাই-বাছাইয়ের ব্যাপার রয়েছে। আবেদনকারীর ক্রিমিনাল রেকর্ড, সামাজিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থা, নিয়মিত কর পরিশোধকারী কি না, এসব বিষয় খোঁজ করা হয়। আবেদনকারীর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের অভিযোগ বা তার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ আছে কি না, লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়ায় এসব খতিয়ে দেখা হয়। তাছাড়া, লাইসেন্স পেলে তিনি অস্ত্রের সঠিক ব্যবহার করবেন কি না, সেটিও দেখা হয়', বলেন জেলা প্রশাসক।
Comments