কাজ শেষ না হতেই ২৭ কোটি টাকার সেতুতে ফাটল

স্থানীয়দের অভিযোগ, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার ও এলজিইডি প্রকৌশলীদের দায়িত্বহীনতার কারণে সেতুর নিচে পিলারে ফাটল ধরেছে। ছবি: সংগৃহীত

নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার আগেই রংপুরের পীরগঞ্জে করতোয়া নদীর ওপর নির্মিত ন্যূনদহ সেতুর পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে, প্রায় ২৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন সেতুটির কাজের মান নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও নির্মাণ কাজ স্থগিত রেখেছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী ব্যবহার ও এলজিইডি প্রকৌশলীদের দায়িত্বহীনতার কারণে সেতুর নিচে পিলারে ফাটল ধরেছে।

রংপুরের মিঠাপুকুর ও পীরগঞ্জ এবং দিনাজপুরের নবাবগঞ্জ ও ঘোড়াঘাট উপজেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় করতোয়া নদী। প্রতি বছর বন্যায় ভেঙে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হওয়ায় অসংখ্য গ্রাম করতোয়ার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

জাতীয় সংসদের স্পিকার ও রংপুর-৬ (পীরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী পীরগঞ্জ উপজেলার পশ্চিমাঞ্চল এবং দিনাজপুর জেলার ঘোড়াঘাট, নবাবগঞ্জ ও বিরামপুর উপজেলার মানুষের জন্য উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে করতোয়া নদীর ওপর সেতু নির্মাণের উদ্যোগ নেন এবং সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে এ বিষয়ে কাজ করার নির্দেশ দেন। সেই আলোকে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) আওতায় সিআইবি প্রজেক্টের মাধ্যমে করতোয়া নদীর ওপর চতরা জিসি গিলাবাড়ী ঘাট ভায়া নিশ্চিন্তবাটি প্রাথমিক বিদ্যালয় সড়কে ন্যূনদহ ঘাট পর্যন্ত সেতু নির্মাণের জন্য ২৬ কোটি ৮২ লাখ ৩৩ হাজার ৮৭৮ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

ঘোড়াঘাটের সিংড়া ইউনিয়নের মারনুপাড়া এবং পীরগঞ্জের চতরা ইউনিয়নের গিলাবাড়ী করতোয়া নদীর ন্যুনদহ ঘাটে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু করা হয়। সেতুটি নির্মিত হলে পীরগঞ্জের সঙ্গে ঘোড়াঘাট, নবাবগঞ্জ ও বিরামপুর উপজেলাসহ হিলি, জয়পুরহাট এবং গোবিন্দগঞ্জ-বিরামপুর-ফুলবাড়ী-দিনাজপুর আঞ্চলিক মহাসড়কের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হবে।

এলজিইডি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে করতোয়া নদীর ন্যুনদহ ঘাটে ৩০১ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৯ দশমিক ৮ মিটার প্রস্থের এ সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিপি এল জেভি ৫২ ছাত্তার ম্যানসন ও প্যান্স লাইন্স।

শর্তানুযায়ী, ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, এখন পর্যন্ত ন্যুনদহ সেতুর মাত্র ৭০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি।

নির্মাণাধীন ন্যূনদহ সেতু। ছবি: সংগৃহীত

নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে গত প্রায় ২ বছর ধরে তারা নির্মাণ কাজ স্থগিত রেখেছে। সম্প্রতি নদীর পানি শুকিয়ে গেলে, সেতুটির ৫ নম্বর পিলারটির বেজমেন্ট ফেটে মাটির নিচে ধসে যায়।

সেতুর নিচে হঠাৎ পিলারে ফাটল দেখা দেওয়ার ঘটনাটি জানাজানি হলে এলজিইডির পীরগঞ্জ উপজেলা কর্মকর্তাদের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়।

সম্প্রতি ঢাকা থেকে ৩ সদস্যদের একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি সেতুটি সরেজমিন পরিদর্শন করেছেন। এ সময় স্থানীয়রা সেতুর কাজের গুনগত মান, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবহার ও বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে উপজেলা প্রকৌশলী মজিবর রহমানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ করেন।

পিলারে ফাটল দেখা দেওয়ায় সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ কি না, এর ভবিষ্যৎ কি হবে—এসব বিষয়ও স্পষ্ট করে তদন্ত কমিটি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলজিইডির এক কর্মকর্তা বলেন, 'প্রকৌশলী মজিবর রহমান রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় দায়িত্ব পালনের সময় 'সাবেরা খাতুন এতিমখানায়' বহুতল বিশিষ্ট ভবনের নকশা পরিবর্তন করেন এবং ওই কাজে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়, যা এখনো বিচারাধীন। তিনি পীরগঞ্জে যোগদানের পর ঠিকাদারের সঙ্গে যোগসাজশ করে সেতুর নকশা পরিবর্তন করে নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহারের সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন। এ কারণেই সেতুর মূল পিলার ধসে গেছে।'

এ অভিযোগের বিষয়ে প্রকৌশলী মজিবর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, '২০১৯ সালে সেতুটির পিয়ার ক্যাপের কাজ হয়। ওই সময়ে করা ৫ নম্বর পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে। এলজিইডির উচ্চপর্যায়ের তদন্ত দল তদন্ত করছে। তাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ থাকার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'নির্মাণ সামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়ায় কয়েক বছর ধরে সেতুর কাজ বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া, সেতুর জন্য ৫ একর ৩৩ শতাংশ জমি এখনো অধিগ্রহণ সম্পন্ন হয়নি। কাজ করতে গিয়ে বারবার জমির মালিকদের কাছ থেকে বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছে।'

এ বিষয়ে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান আলী বলেন, 'তদন্ত কমিটির প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞরা প্রতিবেদন দেওয়ার পর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

জমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'জেলা প্রকৌশল বিভাগের অনুমোদন ও ঢাকার প্রধান প্রকৌশল দপ্তরের অনুমোদনপত্র নিয়ে ২০১৯ সালের ২৫ আগস্ট পীরগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ে জমা দিয়েছি। জেলা ভূমি কার্যালয় থেকে অনুমোদন এলেই জমির মালিকরা জমি অধিগ্রহণের টাকা পাবেন এবং সেতুর নির্মাণ কাজেরও গতি বাড়বে।'

Comments

The Daily Star  | English
Banking sector crisis

Why is the banking sector crisis so deep-rooted?

The regime-sponsored immorality to protect or pamper the financial gangsters not only eroded the future of the banking sector, but also made the wound too difficult to recover from.

4h ago