মে দিবস

নতুন মজুরি কাঠামোসহ ১২ দাবিতে ট্যানারি শ্রমিকদের সমাবেশ

দেড়শ বছর পূর্বে শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা নির্ধারিত হলেও আমাদের দেশে ট্যানারি শিল্পে এই নিয়মের শতভাগ বাস্তবায়ন নেই।
নতুন মজুরি কাঠামোসহ ১২ দাবিতে ট্যানারি শ্রমিকদের মানববন্ধন
ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের ব্যানারে হরিনধরা এলাকায় সমাবেশ করেন ট্যানারি শ্রমিকরা। ছবি: স্টার

মহান মে দিবসে বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ট্যানারি শিল্পের শ্রমিকদের জন্য দ্রুত নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন এবং নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণাসহ ১২টি দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছে সাভারের চামড়া নগরীর শ্রমিকরা।

আজ সোমবার সকাল ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের ব্যানারে হরিনধরা এলাকায় এই কর্মসূচি পালন করেন তারা।

শ্রমিকরা বলেন, মহান মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির এক গৌরবোজ্জ্বল দিন। ১৮৮৬ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে শ্রমিক নেতৃবৃন্দের আত্মত্যাগের বিনিময়ে শ্রমজীবী মানুষের জন্য ৮ ঘণ্টা শ্রম, ৮ ঘণ্টা বিশ্রাম ও ৮ ঘণ্টা বিনোদনের অধিকার আদায় হয়েছে। সারা বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আজ চামড়া শিল্প নগরীর শ্রমিকরাও যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে দিনটি পালন করছে।

শ্রমিকরা বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মে দিবসের চেতনাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পয়লা মে সরকারি ছুটি ঘোষণা করলেও দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের শ্রমিকদের বৃহত্তর অংশ আজও মে দিবসের ছুটি থেকে বঞ্চিত। দেড়শ বছর পূর্বে শ্রমিকদের কর্মঘণ্টা ৮ ঘণ্টা নির্ধারিত হলেও আমাদের দেশে ট্যানারি শিল্পে এই নিয়মের শতভাগ বাস্তবায়ন নেই। এমনকি সাপ্তাহিক ছুটি কিংবা সরকারি ছুটির দিনগুলোতেও অধিকাংশ কারখানায় শ্রমিকদেরকে কাজ করতে হয়। আজও অনেক শ্রমিক উপযুক্ত মজুরি ও ওভারটাইম সুবিধা ছাড়াই দৈনিক ১২ ঘণ্টা কিংবা এর চেয়েও বেশি সময় ধরে কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। আবার, শ্রম আইন বাস্তবায়নের জন্য সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের যথাযথ মনিটরিংয়ের ঘাটতি রয়েছে। শ্রম আইন মোতাবেক শ্রমিক নিয়োগের সময় শ্রমিককে নিয়োগপত্র প্রদান করা হচ্ছে না, ট্যানারি কারখানাগুলোর কাজ স্থায়ী প্রকৃতির হলেও আইনে বর্ণিত সময়সীমার পর শ্রমিকদেরকে স্থায়ী করা হচ্ছে না, এছাড়াও মধ্যস্বত্বভোগী কন্ট্রাক্টরের মাধ্যমে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক নিয়োগ করা হচ্ছে, ফলে শ্রমিকরা আইনগত সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এসময় তারা অভিযোগ করে বলেন, আইএলও কনভেনশন ও শ্রম আইন মোতাবেক শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার থাকলেও স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের নানাভাবে বাধা দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য অধিকারের কথা তুলে ধরলে তাদের ওপর নেমে আসে নানারকম হয়রানি, যখন খুশি তাদেরকে চাকরিচ্যূত করা হচ্ছে। অথচ এসব বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরসহ সরকারের দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানসমূহ থেকে আমরা প্রত্যাশিত সহযোগিতা পাচ্ছি না।

এসময় চামড়া শিল্পের সকল মালিকদের প্রতি তারা কমপ্লায়েন্সের স্বার্থে, শিল্পে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে, দেশের আইনকানুন মেনে চলার আহ্বান জানান।

এসময় শ্রমিক নেতৃবৃন্দ কয়েকটি দাবি তুলেন। তাদের দাবিগুলো হলো—  বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ট্যানারি শিল্পের শ্রমিকদের জন্য দ্রুত নিম্নতম মজুরি বোর্ড গঠন এবং নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করা, সরকার ঘোষিত নিম্নতম মজুরি এবং সিবিএ চুক্তি মোতাবেক বিভিন্ন গ্রেডের জন্য যে নিম্নতম মজুরি নির্ধারিত রয়েছে তার কম মজুরি দিয়ে কোনো শ্রমিক নিয়োগ না করা, ট্যানারি কারখানাগুলোতে শ্রম আইনের সকল ধারা বাস্তবায়নে দ্রুত ও কার্যকরি উদ্যোগ গ্রহণ করা, নিয়োগপত্র প্রদান ব্যতিরেকে কোনো শ্রমিক নিয়োগ না করা, শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি উন্নয়নে সেইফটি কমিটি গঠন ও কার্যক্রম জোরদার এবং পরিদর্শন কার্যক্রম জোরদার করাসহ যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা, নিয়োগপত্র প্রদান ব্যতিরেকে কোনো শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে না, চামড়া শিল্প নগরীতে অবিলম্বে ৫০ শয্যাবিশিষ্ট একটি পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল এবং শ্রমিকদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা করা, প্রসূতি কল্যাণ সুবিধার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, সোশ্যাল কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও সিইটিপিকে পুরোপুরি কার্যকর করার মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব ও আধুনিক চামড়া শিল্প নগরী গড়ে তুলে লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি)-এর সনদ অর্জনের পথে অগ্রসর হওয়া, অসৎ উদ্দেশ্যে শ্রমিক হয়রানি ও তাদেরকে চাকরিচ্যূত করা বন্ধ করা, অবিলম্বে মধ্যস্বত্বভোগী কন্ট্রাক্টর বা ঠিকাদারের মাধ্যমে কাজ করানো বন্ধ করা, আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ মোতাবেক শ্রমিকদের অবাধ ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার নিশ্চিত করা এবং আইন দ্বারা স্বীকৃত ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার চর্চায় প্রশাসনিক এখতিয়ারবহির্ভূত হস্তক্ষেপ বন্ধ করা, ট্যানারি শিল্পের জন্য গৃহীত 'ন্যাশনাল প্লান অব একশন' অর্থাৎ জাতীয় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ এবং ট্যানারি শিল্পকে আনুষ্ঠানিক সেক্টরের ধারাবাহিকতায় ফিরিয়ে আনা।

ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, 'আমরা মোট ১২টি দাবিতে মহান মে দিবসে সমাবেশ, র‍্যালি ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছি। আশা করি সরকার ও মালিক পক্ষ আগামী ৩ মাসের মধ্যে আমাদের দাবিগুলো মেনে নেবেন। অন্যথায় ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন প্রয়োজনীয় কর্মসূচি নিতে বাধ্য হবে।'

Comments