‘কারও জন্য দেশের মানুষের এমন দরদ আর দেখিনি’

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। ফাইল ফটো

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন প্রবাদ পুরুষ। তিনি ছিলেন উদার ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির একনিষ্ঠ ধারক, প্রকৃত প্রগতিশীল এবং সবসময়ের অকুতোভয় যোদ্ধা। যার আপোষহীন ওষুধনীতি এ দেশের স্বাস্থ্যখাতকে আমূল পাল্টে দিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।

আজ রোববার বিকেল ৩টায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে স্বাস্থ্য আন্দোলন আয়োজিত 'গণমুখী স্বাস্থ্য সেবার জন্যে সংগ্রাম, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা ও স্মৃতিচারণ' শীর্ষক আলোচনায় বক্তারা এসব কথা বলেন।

'লোকে তাকে বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করত'

আলোচনার সভাপ্রধান ও ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. কাজী কামরুজ্জামান বলেন, 'জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মতো ব্যক্তিত্বকে নিয়ে কথা বলে শেষ করা যাবে না। তার ছিল অসম্ভব সাহস, যেখান থেকে আমরা প্রেরণা পেতাম। তার একটা গুণ ছিল, লোকে তাকে বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করত। দেশে যখন যুদ্ধ চলছিল, তখন জাফরুল্লাহর নেতৃত্বেই লন্ডনে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (তৎকালীন নাম ছিল বিডিএমএ) গঠন করা হয়। নামটিও জাফরুল্লাহ চৌধুরীর দেওয়া। তিনি বিদেশিদের কাছে অতি পরিচিত ছিলেন, যার কারণে আমরা সেসময় বেশ অনুদান সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম।'

রোববার বিকেলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর প্রতি শ্রদ্ধা ও স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান। ছবি: আরাফাত সেতু/স্টার

'যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতালের সবাইকে নিয়ে জাফরুল্লাহ চৌধুরী দেশে চলে আসেন। আসলে তিনি কাউকে ছাড়তে চাইতেন না। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র যে শুধু একটি হাসপাতাল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা নয়, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা কেমন হবে, সে পরিকল্পনাতেই এর কার্যক্রম এগুতে থাকে। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক ডায়নামিক মানুষ। তার সঙ্গে যারা কাজ করছেন, তাদের বিচিত্রসব অভিজ্ঞতা রয়েছে। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে কাজ করলে থাকা-খাওয়া নিয়ে চিন্তা করতে হত না। তিনি এসব নিয়ে খুব একটা ভাবতেনও না। তার উদ্দেশ্য ছিল একটাই- মানুষের সেবা করা। জাফরুল্লাহ চৌধুরী যে প্রতিষ্ঠান তৈরি করে গেছেন, সে প্রতিষ্ঠান যেন টিকে থাকে, কোনোভাবেই যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়', বলেন তিনি।

'জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন অনেক বড় দার্শনিক'

কবি, চিন্তাবিদ এবং উবিনীগের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফরহাদ মজহার বলেন, 'জাফরুল্লাহ চৌধুরীকে শুধু চিকিৎসক হিসেবে দেখলেই হবে না, রাজনৈতিকভাবেও দেশের মানুষের জন্য যদি কারও অবদান বেশি থাকে সেটা জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। হুইল চেয়ারে চেপে মিছিলের সামনে থাকাই নয়, সমাজকে বদলে দেওয়া, সমাজের অসঙ্গতিগুলো নিয়ে প্রশ্ন করা, এসব জাফরুল্লাহ চৌধুরীর চেয়ে ভালোভাবে কেউ করতে পারেননি। জাফরুল্লাহ চৌধুরী এমনই এক মানুষ ছিলেন, যার এক ডাকে আমি আমেরিকা থেকে চলে এসেছিলাম। তিনি কখনো তথাকথিত স্বাস্থ্যনীতি ও ওধুষনীতি নিয়ে চিন্তা করেননি। জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন অনেক বড় দার্শনিক। বিখ্যাত ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকোকে বাংলাদেশে চর্চা করেছেন কেবল জাফরুল্লাহ চৌধুরীই।'  

'নতুন ধরনের বাংলাদেশ গঠনের স্বপ্ন দেখতেন বলেই, জনগণের স্বার্থের জায়গা থেকে তিনি জীবনভর এসব চর্চা করেছেন। এটাই মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা, যেটাকে আমরা বলি- মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। তাকে বিভিন্ন দিক থেকে পড়া যায়, বিচার করা যায়। জাফরুল্লাহ চৌধুরীর বই পড়ার চেয়ে তিনি কী করে গ্রামের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে দেখিয়ে দিয়েছেন, সেগুলো জানা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাকে নিয়ে শোক করার কিছু নেই, বরং আনন্দ করার আছে। তাকে স্মরণ করার, তার প্রতি সম্মান দেখানোর শ্রেষ্ঠ উপায় হলো- তার অসমাপ্ত স্বাস্থ্যনীতি বাস্তবায়ন করা', বলেন তিনি।

'জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন সবসময়ের যোদ্ধা'

আইনজীবী ও বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে অনেক কাজ করতে পেরেছি, আবার অনেক কাজ "পাছে সরকার কিছু বলে" বলে করতে পারিনি। তিনি সবার সঙ্গে চলতে পারতেন, কী করতে চান সে ব্যাপারে তার কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। ১৯৭১ সালে অনেকেই যুদ্ধ করেছেন, কিন্তু জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন সবসময়ের যোদ্ধা। তার মুক্তিযুদ্ধ কখনোই থেমে ছিল না। রাজনৈতিকভাবেও তিনি খুবই সঠিক মানুষ ছিলেন। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তার রাজনীতি ছিল না, পাওয়ার হাউস-কেন্দ্রিক রাজনীতি ছিল না। জনগণকে কীভাবে ক্ষমতায়িত করা যায়, সেই কাজটিই তিনি আজীবন করে গেছেন।'

'জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্বৈরাচারী সরকারের সময় ওষুধনীতি করেছেন। তার উদ্দেশ্য সেই সরকারের কাছাকাছি যাওয়া ছিল না, তার উদ্দেশ্য ছিল- ওষুধনীতি বাস্তবায়ন করা। তার হিসেব একটাই ছিল, এটা করলে সাধারণ মানুষের উপকার হবে। জাফরুল্লাহ চৌধুরী আদ্যোপান্ত গণতান্ত্রিক মানুষ ছিলেন। তিনি যা করে গেছেন, তাকে আন্দোলন বলতে চাই না, এটা একটা বিপ্লব। তিনি জীবদ্দশায় নোবেল পুরস্কার পাননি। তবে আমার মনে হয়, মৃত্যুর পর বাংলাদেশের মানুষ তাকে নোবেল পুরস্কার দিয়েছে। কোনো বাংলাদেশির জন্য মানুষের এমন দরদ আর দেখিনি', বলেন তিনি।

'তিনি ধূমপায়ীদের চাকরি দিতে চাইতেন না'

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী বলেন, 'জাফরুল্লাহ চৌধুরী তামাক ও ধূমপানের বিরুদ্ধে সবসময় সোচ্চার ছিলেন, এমনকি গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে তিনি কোনো ধূমপায়ীকে চাকরি দিতে চাইতেন না।'

'জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন খুবই দূরদর্শী মানুষ। তার চিন্তা-চেতনা ছিল খুবই তীক্ষ্ণ। আমরা এখন ধূমপান প্রতিরোধে কাজ করছি, তামাক বন্ধে আন্দোলন করছি। কিন্তু আশির দশকেই জাফরুল্লাহ চৌধুরী তামাক ও ধূমপানের ব্যাপারে সচেতন ছিলেন এবং নিজ অবস্থান থেকে কঠোর ব্যবস্থা নিতেন। সেই সময়ে দেখতাম- গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রে কোনো নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে সেখানে লিখে দেওয়া হতো, ধূমপায়ীদের আবেদন করার প্রয়োজন নেই', বলেন তিনি।

'মাজার বানাবেন না, তার কাজকে স্মরণ করুন'

স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই-মাহবুব বলেন, 'অন্যায়ের প্রতিবাদ করাই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল। তিনি প্রতিবাদের মাধ্যমে সবকিছু অর্জন করেছেন। তিনি যা করেছেন জনকল্যাণে করেছেন। তবে শেষের দিকে এসে তিনি গণতন্ত্র, সরকার এসবের মধ্যে জড়িয়ে যান। তাই তার অনুসারীদের বলব, মাজার বানাবেন না, জাফরুল্লাহ চৌধুরীর কাজকে স্মরণ করুন।'

'স্বাধীনতার পর এ দেশে ৩ জন মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশি, তারা হলেন- ফজলে হাসান আবেদ, ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং জাফরুল্লাহ চৌধুরী। সমাজের যে গণতন্ত্রহীনতা, এই জায়গায় মুক্তিদাতা হিসেবে জনগণ জাফরুল্লাহ চৌধুরীকেই চিন্তা করেছে। তিনি একাধারে ছিলেন চিকিৎসক ও সমাজ পরিবর্তনকারী। দেশ-জাতিকে তিনি অনেক কিছু দিয়ে গেছেন', বলেন তিনি।

'বাবা মাত্র ৩টি ওষুধ ব্যবহার করতেন- প্যারাসিটামল, ভিটামিন সি ও ঝাল গরুর মাংস'

জাফরুল্লাহ চৌধুরীর ছেলে বারিশ হাসান চৌধুরী বলেন, 'আমার বাবা শুধু যে দেশের জন্য অবদান রেখেছেন তা নয়। তার কারণে জাতিসংঘে পুরুষদের টয়লেটে পোশাক পরিবর্তনের জন্য রুম তৈরি করা হয়। যখন যেখানে অনিয়ম দেখেছেন, সেখানেই প্রতিবাদ করেছেন তিনি।'

'আমার কোনো অসুখ হলে বাবা মাত্র ৩টি ওষুধ ব্যবহার করতেন। সেগুলো হলো- প্যারাসিটামল, ভিটামিন সি ও ঝাল গরুর মাংস। তিনি বেশি ওষুধের ব্যবহার পছন্দ করতেন না। তার মতে- অতিরিক্ত ওষুধ মানুষকে আরও অসুস্থ করে তোলে', বলেন তিনি।

স্বাস্থ্য আন্দোলনের যুগ্ম-আহ্বায়ক ফরিদা আখতারের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য রাখেন নারীপক্ষের নারী স্বাস্থ্য প্রকল্পের পরিচালক সামিয়া আফরীন, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়ক ডা. মনজুর কাদির, জনস্বাস্থ্য সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ডা. ফয়জুল হাকিম, পাবলিক হেলথ ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম. মোজাহেরুল হক ও নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন প্রমুখ।

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

3h ago