বাতাসে গ্যাসের গন্ধ, ঢাকার জীবন কতটা ঝুঁকিতে

ঢাকার বেশ কয়েকটি এলাকায় গত সোমবার রাতে গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে রাজধানীবাসী আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়ে জানায়, ঈদে শিল্পকারখানায় গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকায় সঞ্চালন ও বিতরণ লাইনে গ্যাসের চাপ বেড়ে যাওয়ায় গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।

তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষও একই ব্যাখ্যা দিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার পরামর্শ দেয়।

তবে, গ্যাসের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়ে দেওয়া এই ব্যাখ্যা সঠিক নয় বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ভূতত্ত্ব বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরূল ইমাম।

দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'প্রথমবার কলকারখানা বন্ধ হয়েছে তাই চাপ বেড়েছে, বিষয়টি এমন না। আমার কাছে এই যুক্তিটা গ্রহণযোগ্য না। বর্তমানে যে পাইপলাইন আছে, সেগুলোর অবস্থা খুব খারাপ। তাদের কথা অনুযায়ী এগুলো ২০ বছর আগেই মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো ব্যবহৃত হচ্ছে। এখানে প্রচুর লিকেজ হয়েছে আর এই লিকেজ থেকে দুর্ঘটনা ঘটছে। এগুলো কিন্তু তারাই বলছে। ট্রান্সমিশন সিস্টেমের মধ্যে তো চাপ নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থাপনা আছে। এখানে সেই ব্যবস্থাপনার মধ্যেই গণ্ডগোল আছে। যে কারণে এ চাপ বেড়ে গেছে। সুতরাং তাদের ব্যাখ্যা সত্য না। লিকেজ কিন্তু ছোট ছোট আকারে হাজারো পয়েন্টে আছে। এই যে ঘটনা ঘটল, এটা প্রমাণ করে যে লিকেজ অনেক বেড়ে গেছে। তাই তিতাসের বক্তব্যকে আমি তেমন একটা দায়িত্বশীল বক্তব্য মনে করছি না।'

এই লিকেজগুলো মেরামত করা সম্ভব ছিল কি না, জানতে চাইলে অধ্যাপক বদরূল ইমাম বলেন, 'লিকেজ মেরামত করা সম্ভব। তবে বেশি লিকেজ হলে সেগুলো প্রতিস্থাপন করতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপ ২০ বছর ধরে চালানো ঠিক না। সেগুলো প্রতিস্থাপন করাই শ্রেয়। জরুরি ভিত্তিতে অবশ্যই লিকেজ মেরামত করতে হবে। তবে হাজারো লিকেজ আছে। কোনটা রেখে কোনটা মেরামত করবে। তিতাস গ্যাস বলছে, তারা মেরামত করছে। কিন্তু পরিধি অনুযায়ী যে পরিমাণ কাজ, তার তুলনায় অনেক কম করছে তারা। বড় ধরনের উদ্যোগ নিয়ে পাইপলাইন পরিবর্তন ও মেরামত করতে হবে। এই খাতে যে পরিমাণ নজর দেওয়া দরকার, তা দেওয়া হয়নি।'

বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকার মানুষের ঝুঁকি অনেক বেশি বলে মনে করছেন এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ। তার ভাষ্য, 'পাইপলাইনের মধ্যে অনেক লিকেজ আছে। এই লিকেজ দিয়ে যখন অল্প পরিমাণ গ্যাস বের হচ্ছে, তখন আমরা গন্ধ পাচ্ছি না। অল্প অল্প করে কয়েক হাজার পয়েন্ট দিয়ে গ্যাস বের হচ্ছে। এটিকে হালকা করে দেখার সুযোগ নেই। বাতাসের মধ্যে ৫ শতাংশ মিথেন থাকলে আগুন লেগে যেতে পারে। কোথাও ৫ শতাংশ বা তার ওপরে মিথেন থাকলে এবং সেখানে আগুন জ্বালানো হলে বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। যদি কখনো এই গ্যাস কোনো জায়গায় আটকে যায়, তখন ওই জায়গায় বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।'

সাধারণ মানুষের করণীয় বিষয়ে তিনি বলেন, 'গ্যাসের চুলা ঠিকমতো বন্ধ হয়েছে কি না তা দেখা, কোনো জায়গায় লিকেজ থাকলে তা মেরামত করতে হবে, গন্ধ পাওয়ার জন্য যে কেমিক্যাল (ওডোরেন্ট) ব্যবহার করা হয় সেখান থেকে কোনো গন্ধ বের হলেই পাইপলাইনের চাবি বন্ধ করে দিতে হবে, ঘর বদ্ধ রাখা যাবে না, দরজা-জানালা ও রান্না ঘরের জানালা অবশ্যই খুলে রাখতে হবে এবং সকালে উঠে রান্নাঘরে ঢুকে চুলা জ্বালানোর আগে অবশ্যই জানালা খুলে দিতে হবে।'

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেট্রোলিয়াম প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম তামিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কয়েক বছর এমন গ্যাসের চাপ বেড়ে যাওয়া দেখিনি, তার একটা কারণ হতে পারে চাহিদা ও সরবরাহের ভারসাম্য ছিল। এবার ঢাকায় পাইপলাইনের যে নেটওয়ার্ক, তা হয়তো ঠিক করা হয়নি বা কেউ কোনো জায়গায় ভুল করেছে। সরবরাহ আগের মতোই রেখেছে। এ কারণে এই ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। লাইনের মধ্যে যত গ্যাস জমেছে, তত চাপ বেড়েছে। চাপ বাড়ার কারণে অনেক জায়গায় যে লিকেজ আছে, সেগুলো দিয়ে গ্যাস বের হয়েছে। এক্ষেত্রে তিতাসের ব্যাখ্যা ঠিক আছে। কিন্তু তারা নিয়ন্ত্রণ করেনি এবং চাপ খেয়াল করেনি। তা ছাড়া, পাইপলাইনের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে দুর্বলতাগুলো আরও খারাপ হচ্ছে। সেটিও একটা কারণ হতে পারে। তবে এটি সিস্টেমের সমস্যা।'

লিকেজ মেরামত বিষয়ে তিনি বলেন, 'এগুলো অনেক পুরোনো সিস্টেম। এখানে কতগুলো লিকেজ বন্ধ করবে। তারা ৫০০ এর বেশি লিকেজ শনাক্ত করেছিল। সেগুলো একটা একটা করে ঠিক করতে পারে। কিন্তু লাইনই পুরোনো হয়ে গেছে। বহু জায়গায় পুরোনো লাইন আছে। ছোটছোট লিকেজ আরও বেশি আছে আমার ধারণা। লাইন পরিবর্তন যেমন করতে হবে, লিকেজও বন্ধ করতে হবে।'

এই পরিস্থিতিতে ঝুঁকি কতটা, জানতে চাইলে এই জ্বালানি বিশেষজ্ঞ বলেন, 'এর ফলে বাইরে গ্যাস জমে থাকলে আগুন লাগার ঝুঁকি আছে। কিন্তু বদ্ধ জায়গায় গ্যাস জমে গেলে সেখানে বিস্ফোরণের ঝুঁকি আছে। ঘর ও রান্নাঘরে বাতাসের সরবরাহ ঠিক রাখতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে কখনই বাইরে আগুন জ্বালানো যাবে না।'

বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য তিতাস গ্যাসের করপোরেট ডিভিশনের মহাব্যবস্থাপক ও কোম্পানি সচিব মো. লুৎফুল হায়দার মাসুমের সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জরুরি গ্যাস নিয়ন্ত্রণ বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক (অপারেশন ডিভিশন) প্রকৌশলী মো. শাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন।

মো. শাখাওয়াত হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বছর গ্যাসের চাপের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি লিকেজ হলে মেরামত করি। এই বিষয় আমার পরিচালক ভালো বলতে পারবেন।'

ঢাকা শহরে কী পরিমাণ লিকেজ আছে, জানতে চাইলে শাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। কেউ অভিযোগ করলে তখন আমরা সেখানে গিয়ে লিকেজ সারাই। প্রতিদিন ঢাকা শহরে গড়ে ২০ থেকে ২৫টি লিকেজ সারাই।'

গত সোমবার যে লিকেজের কারণে গ্যাস ছড়িয়ে পড়ল, এই বিষয়ে আপনাদের কাছে আগে থেকেই কোনো তথ্য ছিল কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'তথ্য থাকলে তো আমরা আগে থেকেই লিকেজগুলো সারিয়ে ফেলতাম।'

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিতাস গ্যাসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত সোমবার গ্যাসের ওডোরেন্ট চার্জ বেশি হয়েছে। আমরা কিছু কাজ করছিলাম, সেই কারণেই ওডোরেন্ট চার্জ বেশি হয়েছে। তবে এটা তেমন কোনো সমস্যা না।'

ঢাকা শহরে কতগুলো লিকেজ আছে, এমন কোনো হিসাব আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে কাজ করার জন্য আমরা ঠিকাদার নিয়োগ দিয়েছিলাম, তারা কাজ করেছে। আরও একজন ঠিকাদার নিয়োগ দেওয়ার প্রক্রিয়া আছে। আমরা প্রায় ৯০০ লিকেজ মেরামত করেছি। প্রতিদিন আমাদের টিম লিকেজ নিয়ে কাজ করছে।'

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আপনারা যে পাইপলাইনগুলো ব্যবহার করছেন, সেগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ। তারপরেও ব্যবহার করছেন কেন? তিনি বলেন, 'পাইপলাইন পুরোনো এটা তো জানেন আপনারা। আমরা এর জন্য প্রকল্প হাতে নিয়েছি। তিতাসের নেটওয়ার্কে ১৩ হাজার কিলোমিটারের মতো পাইপলাইন আছে। কিছু পাইপলাইন পুরাতন হয়ে গেছে, এগুলো প্রতিস্থাপন করা হবে।'

মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইনের কারণেই লিকেজ বেশি হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'হ্যাঁ, কিছু কিছু জায়গায় হচ্ছে। এসব পাইপ কিন্তু ২০-৩০ বছরে সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, রাজধানীতে ইউটিলিটির কাজ করার ফলে আমাদের পাইপ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।'

এই মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইন ব্যবহার করা কি ঠিক হচ্ছে, প্রশ্ন করলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কর্মকর্তা বলেন, 'আমরা তো প্রকল্প নিয়েছি পরিবর্তন করে দেওয়ার। যেগুলোর সমস্যা হচ্ছে, আমরা সেগুলো শনাক্ত করে বাদ দেবো। প্রজেক্ট এখনো পাশ হয়নি, মন্ত্রণালয়ে আছে। আমরা চেষ্টা করছি। আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই।'

মেয়াদোত্তীর্ণ পাইপলাইন কী পরিমাণ আছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এসব পরিসংখ্যান কি সহজ জিনিস? এটা কি বের করা যাবে? এটা অনেক কঠিন কাজ। যেগুলো বেশি পুরাতন, সেগুলো প্রতিস্থাপন করার প্রকল্প আমরা নিয়েছি।'

কোন জায়গায় বেশি পুরাতন পাইপ আছে বা কোন জায়গাগুলো বেশি ঝুঁকিতে আছে, এমন কোনো জরিপ আছে কি? জানতে চাইলে এই কর্মকর্তা বলেন, 'এমন পাইপ সব জায়গায় আছে। গুলশান, বনানীর মতো নতুন এলাকায় সব ভালো অবস্থানে আছে। কড়াইল বস্তির মতো কিছু এলাকায় অবৈধ লাইন আছে। সেগুলো ঝুঁকিতে আছে। অবৈধ লাইনগুলোর জন্যই লিকেজ বেশি হচ্ছে।'

আপনারা বলছেন চাপ বাড়ার কারণে এই সমস্যা হয়েছে। কিন্তু ট্রান্সমিশন লাইনে তো চাপ নিয়ন্ত্রণ করার ব্যবস্থা আছে। সেদিন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়নি কেন? কারো কি গাফিলতি ছিল? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'না, না, না। এগুলো নিয়ন্ত্রণে ছিল। গাফিলতির কোনো বিষয় ছিল না। ঈদে সবসময়ই এমন চাপ হয়। ওই দিন ওডোরেন্ট বেশি ছিল, তাই এমনটি হয়েছে।'

 

Comments

The Daily Star  | English

Not for kidney patient, they tried to rob bank for iPhones

Police say three robbers fabricated a story claiming that the robbery was to save a kidney patient

1h ago