নারায়ণগঞ্জের পোশাক ব্যবসাতেও বঙ্গবাজারের ‘আগুনের আঁচ’

বঙ্গবাজার, বঙ্গবাজারে আগুন, দেওভোগ মার্কেট, নারায়ণগঞ্জ,
বঙ্গবাজারের ভয়াবহ আগুনের কারণে আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছেন নারায়ণগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

ভয়াবহ আগুনে পুড়ে গেছে দেশের পোশাক খাতের বৃহত্তম পাইকারি মার্কেট বঙ্গবাজার। এই আগুনের আঁচ লেগেছে নারায়ণগঞ্জেও। বঙ্গবাজারের আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তৈরি পোশাক শিল্পের সঙ্গে জড়িত নারায়ণগঞ্জের কয়েকশ ব্যবসায়ী।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জে তৈরি পোশাকের বড় একটি অংশ যায় বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে। সারা বছর বাকিতে মালামাল বিক্রি হয়। ঈদকে সামনে রেখে এই বিক্রি কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তবে, ঈদের আগেই পুরো বছরের বকেয়া পরিশোধ করা হয়। কিন্তু বঙ্গবাজারের ভয়াবহ আগুনের কারণে তারাও আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছেন।

সারাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বড় একটি বাজার দখল করে রেখেছে নারায়ণগঞ্জ। হাত বাড়ালেই সুতা থেকে থানকাপড় সবই মেলে এই শহরে। শহরের নয়ামাটি, টানবাজার, দেওভোগসহ সদর ও বন্দর উপজেলার বেশ কয়েকটি এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ৫ হাজারেরও বেশি হোসিয়ারি শিল্প কারখানা। এসব কারখানায় শিশুসহ নানা বয়সীদের জন্য তৈরি পোশাক বিক্রি হয় সারাদেশে। গত ২ দিনে অন্তত ১৫ জন পোশাক ব্যবসায়ীর সঙ্গে দ্য ডেইলি স্টারের প্রতিবেদকের কথা হয়।

তারা বলেছেন, রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে রাজশাহী, কুমিল্লা, ফরিদপুর, চাঁদপুর, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানে পাইকারি দরে নারায়ণগঞ্জ থেকে পোশাক কিনে নিয়ে যান ব্যবসায়ীরা। রাজধানীর সদরঘাট ও বঙ্গবাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী পোশাক কেনেন নারায়ণগঞ্জ থেকে। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে নয়ামাটি, টানবাজার, দেওভোগের ছোট-বড় কয়েকশ ব্যবসায়ী নিয়মিত লেনদেন করে থাকেন। ঈদের আগে বঙ্গবাজারে আগুন লাগায় এসব ব্যবসায়ীর প্রায় শতকোটি বকেয়া টাকা তোলা নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন।

বঙ্গবাজারের ‘আগুনের আঁচ’ নারায়ণগঞ্জে
রাজধানীর সদরঘাট ও বঙ্গবাজারের অধিকাংশ ব্যবসায়ী পোশাক কেনেন নারায়ণগঞ্জ থেকে। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

শহরের দেওভোগ মার্কেটের আল-মুজিব গার্মেন্টসের মালিক ব্যবসায়ী হাজী মো. সেলিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বঙ্গবাজারে ৩০ জন পার্টি (পাইকারি ক্রেতা) আছে আমার। সারা বছরই তারা আমার কাছ থেকে মাল নেয়। এই লেনদেন চলে বাকিতে। ঈদের অন্তত ১০ দিন আগে সব লেনদেন ক্লিয়ার হয়ে যায়। কিন্তু বঙ্গবাজারের আগুনে আমার ৩০ জন পার্টির সবারই মালামাল পুড়ে গেছে। প্রায় ১ কোটি টাকা বকেয়া আছে। এখন তাদের এই দুর্দিনে টাকা চাইতেও পারতেছি না। কিন্তু টাকা না পাইলে ঈদের আগে আমি আমার কর্মচারীদের বিদায় করমু কেমনে?'

একই পরিস্থিতি এই মার্কেটের আল-করিম গার্মেন্টসের মালিক আব্দুল মতিন, রুমা গার্মেন্টসের মালিক মুজিবুর রহমান, একে ফ্যাশনের মালিক আবুল কালাম, আওলাদ গার্মেন্টসের মালিক আওলাদ হোসেন, আরপি গার্মেন্টসের মালিক আব্দুল মতিন ও এইচকে ফ্যাশনের হাসিবুর রহমানেরও। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে ২ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত বকেয়া আছে তাদের।

দেওভোগ মার্কেটের ব্যবসায়ী মালিক সমিতির সহসভাপতি মুজিবুর রহমান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এই মার্কেটের অনেকেই বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছে মাল বিক্রি করেন। তাদের কাছে আমাদের ৪০ কোটি টাকারও বেশি পাওনা আছে। এখন তাদের সবকিছু আগুনে পুড়ে যাওয়ায় আমরা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি।'

নয়ামাটির মার্ক ফ্যাশনের রফিকুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সারাবছরই বেচাকেনা চলে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজন এখান থেকে মালামাল কেনে। বড় বড় পার্টিরা বাকি রাখে বেশি। শবে মেরাজের পর থেকে ঈদ উপলক্ষে পোশাক বিক্রি শুরু করি, যা চলে ১৫ রমজান পর্যন্ত। এরপর পেমেন্ট শুরু হয়। কিন্তু এবার এক আগুনে সবকিছু উল্টাইয়া গেছে।'

'সবাই জানে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের সব পুড়ে গেছে। কিন্তু, ক্ষতিগ্রস্ত তো আমরাও হইছি। কারণ তারা তো আমাগো মাল নিয়া বিক্রি কইরা তারপর টাকা দিত', যোগ করেন তিনি।

বঙ্গবাজারের ‘আগুনের আঁচ’ নারায়ণগঞ্জে
সারাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বড় একটি বাজার দখল করে রেখেছে নারায়ণগঞ্জ। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/স্টার

ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন টানবাজারের হাবিব শপিং কমপ্লেক্স, রিভার ভিউ মার্কেট ও ফারজানা টাওয়ারের শতাধিক ব্যবসায়ী। আর্থিক অনিশ্চয়তার কথা জানিয়েছেন তারাও।

হাবিব শপিং কমপ্লেক্সের ব্যবসায়ীদের ফেডারেল কমিটির কোষাধ্যক্ষ মোক্তার হোসেনের ভাষ্য, 'এই মার্কেটের কেউ ১ লাখ আবার কেউ ২০ লাখ টাকার মতো পাওনা আছে বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। আমি নিজেই ৪০ লাখ টাকা পাওনা। ঈদের আগেই এসব পাওনা মিটে যেত। এখন এগুলো কবে পাব, তার কোনো ঠিক নেই। শুধু আমিই না, নারায়ণগঞ্জের প্রায় ৫০০ ব্যবসায়ীর অন্তত ১০০ কোটি টাকারও বেশি পাওনা আছে সেখানে। হিসাবটা আমি কমই বললাম। আরও বেশি হবে। বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমাদেরও কপাল পুড়ছে।'

বাংলাদেশ হোসিয়ারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নাজমুল আলম সজল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'নারায়ণগঞ্জে ৫ হাজারেরও বেশি হোসিয়ারি কারখানা আছে। কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যবসা এখানে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধসহ নানা কারণে এইবার ব্যবসা এমনিতেই একটু খারাপ ছিল। তার ওপর অনেক ব্যবসায়ীর বকেয়া পড়ে আছে বঙ্গবাজারে। এইটা নিয়া গত রোববার আমরা মিটিং করছি। কে কার কাছে কত টাকা বকেয়া, এটার একটা তালিকা করতেছি। তালিকা করার পর বিকেএমইএ ও এফবিসিসিআইর সঙ্গে বসে আমরা একটা সমাধান বের করার চেষ্টা করব। বকেয়া সব হয়তো পাওয়া যাবে না, কিন্তু কিছু তো পাওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে।'

এই পরিস্থিতিতে সরকারের সহযোগিতা প্রত্যাশা কথাও জানান তিনি।

Comments