বরুণের শাখে শাখে রোদেলা উচ্ছ্বাস

পৃথিবীর সবচেয়ে 'সুন্দর ও করুণ' জায়গাটির বর্ণনা দিতে গিয়ে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, 'সেখানে সবুজ ডাঙা ভ'রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;/সেখানে গাছের নাম: কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;/সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ;/সেখানে বারু
বসন্তের মাঝামাঝি থেকেই নজর কাড়তে থাকে বরুণের পুষ্পোচ্ছ্বাস। ছবি: সারোয়ার হোসেন

পৃথিবীর সবচেয়ে 'সুন্দর ও করুণ' জায়গাটির বর্ণনা দিতে গিয়ে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, 'সেখানে সবুজ ডাঙা ভ'রে আছে মধুকূপী ঘাসে অবিরল;/সেখানে গাছের নাম: কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল;/সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ;/সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাপসাগরের বুকে, – সেখানে বরুণ'।

এভাবে আবহমান বাংলার নিসর্গের প্রতি মোহাবিষ্ট এই কবির কবিতায় প্রাণ-প্রকৃতির তুচ্ছাতিতুচ্ছ সব অনুষঙ্গের মতো বনফুল বরুণও জায়গা করে নিয়েছে।

এখন বরুণ ফোটার সময়। গ্রীষ্মের প্রকৃতিতে গ্রামবাংলায় এই বনফুলটিই সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে। এ সময়টাতে বরুণের গাছভরা অফুরন্ত প্রস্ফুটন প্রকৃতিতে এক অনাবিল উচ্ছ্বাস এনে দেয়।

জীবনানন্দ বরুণকে নিয়ে 'সাগর বলাকা' শিরোনামের আরেক কবিতায় বলছেন, 'বাসা তোমার সাতসাগরের ঘূর্ণী হাওয়ার বুকে!/ফুটছে ভাষা কেউটে- ঢেউয়ের ফেনার ফণা ঠুকে! প্রায়ণ তোমার প্রবালদ্বীপে, পলার মালা গলে/বরুণ-রানি ফিরছে যেথা,-মুক্তা-প্রদীপ জ্বলে!'।

সম্প্রতি মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার গ্রামে গ্রামে অনাদরে-অবহেলায় বেড়ে ওঠা রাজসিক বরুণের অবারিত প্রস্ফুটনের দেখা মেলে। ছবি: সারোয়ার হোসেন

সম্প্রতি ঢাকার অদূরে মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার গ্রামে গ্রামে অনাদরে-অবহেলায় বেড়ে ওঠা রাজসিক বরুণের অবারিত প্রস্ফুটনের দেখা মেলে। তবে স্থানীয়দের কাছে এই উদ্ভিদ পরিচিত 'বৈন্যা' নামে। এ ছাড়া এটি শ্বেতপুষ্প, কুমারক, সাধুবৃক্ষ, শ্বেতদ্রুম, মহাকপিথা ও মারুতাপহ নামেও পরিচিত। প্রচলিত ইংরেজি নাম Spider Tree, Temple Plant, Garlic Pear।

বরুণের ফুলের রঙ সাদা ও হালকা হলুদ। বসন্তের মাঝামাঝি থেকেই নজর কাড়তে থাকে বরুণের পুষ্পোচ্ছ্বাস। গাছভর্তি ফুলের কারণে পাতা খুব একটা দেখা যায় না। কৃষ্ণচূড়ার মতো অনেক দূর থেকেই নজর কাড়ে এর শোভা।

বাংলাদেশের জলাভূমি, নিচু এলাকা, নদীর তীর ও হাওর এলাকায় বেশি দেখা যায় বরুণ। বসন্তে পাতা ঝরে গেলে গ্রীষ্মের শুরুতে নতুন পাতার সঙ্গে বড় বড় থোকায় ফুল আসে। মাসখানেক থাকে এই ফুল। বর্ষাকালে দেখা যায় কতবেলের মতো ছোট ছোট ফল।

কৃষ্ণচূড়ার মতো অনেক দূর থেকেই নজর কাড়ে বরুণের শোভা। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

দেশের ভাটি অঞ্চলে ধানকাটার সময় টেপী বোরো চালের গরম ভাতের সঙ্গে বরুণের কচি ডগা ভর্তা-ভাজি করে খাওয়ার চল আছে। চৈত্রসংক্রান্তির দিন হাওরের নারীরা বরুণ ফুল সংগ্রহ করেন। নতুন বছরে মঙ্গল কামনায় এই ফুলেই দেওয়া হয় নৈবেদ্য। হাওরাঞ্চলে এ পর্ব আড়ি বিষুসংক্রান্তি নামে পরিচিত।

বুকসমান পানিতেও দিব্যি বেঁচে থাকতে পারে বরুণ। মসৃণ বাকল ধূসর-বাদামি রঙের। সাধারণত গাছ ১০-২০ মিটার উঁচু হয়। হাওর এলাকার কোনো কোনো জনপদে অনেক বড় ও বয়সী বরুণ গাছ দেখা যায়।

মানিকগঞ্জের পাশাপাশি ঢাকার আশপাশে মুন্সিগঞ্জ ও গাজীপুরে বরুণের প্রাধান্য বেশি। এর আদি আবাস ভারত, বাংলাদেশ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। প্রাকৃতিকভাবেই শিকড় থেকে গজানো চারা ও বীজে এর বংশবিস্তার হয়।

বাংলাদেশের জলাভূমি, নিচু এলাকা, নদীর তীর ও হাওর এলাকায় বেশি দেখা যায় বরুণ। ছবি: মামুনুর রশীদ/স্টার

বরুণ প্রাচীনকাল থেকেই ভেষজ গাছ হিসেবে পরিচিত। বেদে এর কথা উল্লেখ আছে। পাতা চর্মরোগ, ব্যথা, বাত নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়। শিকড়ের বাকলের নির্যাস কাজে লাগানো হয় গ্যাস্ট্রিক রোগে।

একসময় মানুষ ফল পাকাতে বরুণের পাতা ব্যবহার করতেন। কিন্তু এই কাজে ক্ষতিকারক ক্যালসিয়াম কার্বাইডের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এর পাতার ব্যবহার কমেছে।

গ্রামবাংলায় বরুণের কাঁচা ফল রান্না করে সবজি হিসেবে খাওয়ার চলও আছে।

Comments

The Daily Star  | English

Thailand sees growing influx of patients from Bangladesh

Bangladeshi patients searching for better healthcare than that available at home are increasingly travelling to Thailand instead of India as the neighbouring country is limiting visa issuances for Bangladeshi nationals.

9h ago