বাংলায় বিদেশি ভাষার সংমিশ্রণ: সমাধান কোন পথে

প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই তরুণদের বাংলা ভাষার মাঝে ইংরেজি শব্দের বহুল ব্যবহার নিয়ে আলোচনা শুরু হয়, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর দাবি ওঠে।

স্কুল-কলেজ পর্যায়ে বাংলা শেখার ক্ষেত্রে শিক্ষা পদ্ধতির দুর্বলতা, উচ্চশিক্ষায় বাংলায় পাঠ্যপুস্তক ও গবেষণা-গ্রন্থের অভাব তো আছেই, তার সঙ্গে রয়েছে পর্যাপ্ত ও মানসম্পন্ন অনুবাদের অভাব এবং এ পুরো প্রক্রিয়া নিয়ে নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনাগ্রহ।

তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রতিনিয়তই নতুন নতুন বিদেশি শব্দ আমাদের ব্যবহার করতে হচ্ছে, যার কোনো বাংলা পরিভাষা নেই। এসব শব্দের বাংলা পরিভাষার প্রয়োজন এবং কী প্রক্রিয়ায় পরিভাষাগুলোকে বহুল প্রচলিত করা যেতে পারে, এ নিয়েও বিশ্লেষকদের ভাবতে হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলা-ইংরেজির সংমিশ্রণ, নতুন বিদেশি শব্দ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সংরক্ষণবাদী দৃষ্টি, বিদেশি শব্দ ব্যবহার করাই যাবে না বা বাংলা বাক্যের মধ্যে যদি বিদেশি শব্দ থাকে তাহলে অনেক বড় ধরনের বিপদ হয়ে যাবে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। কিছু বিদেশি শব্দ আছে যেগুলো অভিধান ঘাটলে হয়তো একটা বাংলা শব্দ তৈরি করা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ওই বাংলা শব্দ ব্যবহারকারীদের কাছে গৃহীত হবে কি না। এই চ্যালেঞ্জ কিন্তু সবসময় থাকবে। এক্ষেত্রে প্রাঞ্জল, খুব যুতসই বাংলা হওয়া প্রয়োজন। ভাষা ব্যবহারকারীদের মনস্তত্ব, চিন্তাভাবনা, তাদের সুবিধা-অসুবিধা এসব চিন্তা করতে হবে।'

'আবার টেকনিক্যাল ওয়ার্ল্ডে এমন অনেক শব্দ আছে যেগুলোর বাংলা করলে ওইসব শব্দের সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হবে। পৃথিবী এখন বেঁচেই আছে মূলত প্রযুক্তির ছত্রছায়ায়। তাই বাংলা পরিভাষা তৈরির নামে যদি কঠিন, দুর্বোধ্য নতুন শব্দ তৈরি হয় তাহলে দেখা যাবে প্রযুক্তির থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। এটা ভীষণ আত্মঘাতী চিন্তা হবে। যেমন: জোর করে কম্পিউটারের বাংলা তৈরি করার কোনো প্রয়োজন নেই।'

'ভাষার শক্তিই হলো নতুন শব্দ ধারণ করার ক্ষমতা। একটা ভাষা যদি নতুন শব্দ ধারণ না করে, তাহলে ভাষাটা কিন্তু ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়ে। এখন নতুন শব্দ তৈরির ক্ষেত্রে বাংলা ভাষায় মূলত যৌগিকীকরণ বা সমাসের মাধ্যমে কিছু শব্দ তৈরি করা হয়। আর কিছু সাধারণ প্রত্যয়, অন্তপ্রত্যয় ব্যবহার করে সেগুলোকে বিশেষ্য থেকে বিশেষণ, বিশেষণ থেকে বিশেষ্য করা হয়।'

তবে বহুল প্রচলিত শব্দ থাকা সত্ত্বেও ইংরেজির ব্যবহার এক্ষেত্রে সমস্যাজনক বলেও মন্তব্য করে তিনি বলেন, 'বিপদটা হয় যদি বাংলাভাষায় প্রচলিত এবং ব্যবহারযোগ্য শব্দ থাকার পরেও সেটার ব্যবহার না করা হয়। যেমন: বন্ধু শব্দটা। বন্ধু তো খুব প্রচলিত শব্দ। অথচ দেখা যাচ্ছে আমরা বলছি ফ্রেন্ড। ফ্রেন্ডের সঙ্গে আবার বাংলা বহুবচন জ্ঞাপক প্রত্যায় ব্যবহার করছি। বলছি, "আমার ফ্রেন্ডসরা", "আজকে আমার ফ্রেন্ডসদের দাওয়াত"। মানে বাংলাভাষী হিসেবে আমার যে সহজাত জ্ঞান, যে জ্ঞানের দ্বারা আমি নিয়ন্ত্রিত হই, ওই বহুবচন জ্ঞাপক চিহ্নগুলো আমি ভুলতে পারি না আসলে, সেগুলো না বলতে পারলে আমার কাছে পূর্ণতা আসে না। এইজন্য ফ্রেন্ডস বলার পরেও আমরা 'রা' বলে ফেলি। এটা বিপজ্জনক। এমন যদি হতো যে ফ্রেন্ডের তেমন ভালো বাংলা নাই, তাহলে একটা বিষয়। কিন্তু আমার তো অনেক সুন্দর শব্দ 'বন্ধু' আছে। আরও সুন্দর সুন্দর প্রতিশব্দও আছে। কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে না।'

'এই জায়গাগুলো যদি পরিবর্তন আনতে হয়, তাহলে আসলে প্রজন্ম তৈরি করতে হবে, অর্থাৎ যারা এই মুহূর্তে শিশু শ্রেণিতে আছে, যারা বড় হচ্ছে। তাদের মধ্যে এই চিন্তাটা পরিষ্কার রাখতে হবে যে, বাংলা বলার সময় আমি মূলত বাংলা শব্দগুলো ব্যবহার করবো নিতান্তই যেটা পারবো না, সেক্ষেত্রে আমি বাইরে থেকে নেবো এবং তাতেও আমার কোনো সংকোচ কাজ করবে না। যারা নবীন একেবারে শিশু তাদের প্রজন্মকে লক্ষ্য রেখে যদি নীতি গ্রহণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে যে ১০ থেকে ১৫ বছর পরে পরিস্থিতিটা অনেকটাই পাল্টে যাবে', বলেন তিনি।

শিক্ষা পদ্ধতির দুর্বলতা

বাংলা ভাষা শেখার ক্ষেত্রে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে পদ্ধতিগত প্রয়োজন আনা জরুরি বলে মনে করছেন অধ্যাপক সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান।

তিনি বলেন, 'সবচেয়ে বেশি শিক্ষার্থী বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করে। স্কুল-কলেজে ১২ বছর বাংলা শেখে, ইংরেজি শেখে। আপনি যদি আজকে ফরাসি শিখতে যান অ্যাঁলিয়স ফ্রঁসেজে, আপনি ২ বছরের মধ্যে একটা বেশ কাজ চালানোর মতো ফরাসি শিখে ফেলবেন। এদিকে ১২ বছর বাংলা শিখেও আমাদের ছেলে-মেয়েরা সাবলীলভাবে বাংলা বলতে পারে না, লিখতে পারে না। আমাদের এই অবস্থা কেন? তার মানে এখানে পদ্ধতিগত সংকট আছে।'

'বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আলাদা পাঠক্রম তৈরি করা জরুরি। সাহিত্যের সঙ্গে ভাষাকে মিলিয়ে ফেলে ভাষার গাঁথুনি ঠিকঠাক তৈরি না করে শিক্ষার্থীদের ওপর সাহিত্যের নানারকম ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। একটা ভাষা শেখা মানে ৪টা দক্ষতা তৈরি করা শ্রবণ, লেখন, কথন ও পঠন। এই দক্ষতাভিত্তিক পড়াশোনা কি প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা করতে পারছে? এগুলো হচ্ছে একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের চিন্তা। অথচ আমাদের এখানে এখনো সেটা হয়নি।'

'ইংরেজির কারণে বাংলা ভাষার নানারকম সংকট তৈরি হচ্ছে, এটা হলো নিজের অক্ষমতা ঢাকার একটা চেষ্টা। ইংরেজি ভাষা এবং বাংলা ভাষার মধ্যে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার জায়গা নেই', বলেন তিনি।

নীতি-নির্ধারকদের অনাগ্রহ

বাংলা ভাষার সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে নীতি নির্ধারকদের অনাগ্রহকেই সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক

তিনি বলেন, 'বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রেই এর চর্চা করতে হবে। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, প্রাণিবিদ্যা, উদ্ভিদবিদ্যা, মেডিকেল সায়েন্স, ইঞ্জিনিয়ারিং টেকনোলজির বিভিন্ন বিষয় সবক্ষেত্রেই যদি সেই আগ্রহ আমাদের মধ্যে জাগত, যেটা ৬০ এর দশকে ছিল, তাহলে বাংলা ভাষা অনেক উন্নতি করত।'

'আশির দশকে বাংলা একাডেমি অনেক ভালো বই ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছে, প্রকাশ করেছে। অনুবাদের বৈশিষ্ট্য হলো চর্চা যদি থাকে তাহলে একজন একটা অনুবাদ করলেন, কিছুদিন পরে আরেকজন সেই বই আবার অনুবাদ করলেন, এভাবে অনুবাদের মাধ্যমে জ্ঞানচর্চা বা যেকোনো বিষয়ের কাজে বাংলা ব্যবহার করা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু এজন্য জাতির যে মনোভাব দরকার, গত ২০ থেকে ২৫ বছরের মধ্যে সেটার পরিবর্তন ঘটে গেছে।'

এই অধ্যাপকের মতে, জাতিগত ঐক্য তৈরি না হওয়া এবং বাংলাদেশের প্রতি অনাস্থা এর একটি বড় কারণ।

অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেন, '১৯৭২ সাল থেকেই আমাদের দেশের যারা আমলাতন্ত্রের লোক, মন্ত্রী, যারা উচ্চ অবস্থানে আছেন, তারা তো তাদের ছেলে-মেয়েদেরকে বাংলাদেশে রাখছেন না, বাংলা মাধ্যমে পড়াচ্ছেন না। ফেব্রুয়ারি মাস আসলে তারা বাংলা ভাষার পক্ষে মন খুলে কথা বলেন, কিন্তু কাজ করেন যাতে বাংলা না এগোয়। মৌখিকভাবে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন ঠিকই কিন্তু ছেলেমেয়েদের ইউরোপের নাগরিক বানাতে চান। এর কারণ হলো আমাদের শাসকদের মধ্যে এমন একটা মনোভাব আছে যে বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠবে না, চেষ্টা করে লাভ নেই। এই ধরনের মানসিকতার লোকেরা যখন রাষ্ট্র পরিচালনা করে, তখন রাষ্ট্রব্যবস্থা, বিচার ব্যবস্থা, আইনকানুন সবখানেই তো এর প্রভাব পড়ে।'

'বাংলাদেশের কত নাগরিক গত ১০-২০ বছরে বিদেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন, এ নিয়ে কি সরকারের কাছে সুস্পষ্ট তথ্য আছে? যারা বিদেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন, তারা কি বাংলাদেশের শাসনকার্য, বিচারকাজ পরিচালনায় থাকতে পারবেন? এগুলোর সুস্পষ্ট উত্তর পাওয়া প্রয়োজন। যারা বিদেশে থাকেন, তাদের কাছ থেকে চাঁদা এনে রাজনৈতিক সংগঠনগুলো চলছে। যারা বাংলাদেশে না থেকে বাংলাদেশের প্রতি দরদ প্রদর্শন করেন, তাদের এই দরদ বাংলাদেশকে গড়ে ওঠার পক্ষে কতখানি সহায়তা করে?', বলেন তিনি।

নতুন প্রজন্মের বিদেশ চলে যাওয়ার প্রবণতা থেকে ইংরেজি শিক্ষাকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েরা বিদেশ চলে যেতে চায়। এটা একটা বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিচার করে দেখতে হবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী কিংবা অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাংলা ভাষা নিয়ে কাজ করতে শিক্ষকদের মধ্যেই তো আগ্রহ দেখা যায় না। আর যেগুলো প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে বাংলাকে কোনো মর্যাদাই দেওয়া হয় না। জাতিগতভাবে আমাদের এই মানসিকতার মধ্যে আমরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে রক্ষা বা বিকশিত করতে চাই কি না, এ প্রশ্নের জাতীয়ভাবে একটা উত্তর দেওয়া দরকার।'

'বাংলা ভাষা নিয়ে তরুণদের মধ্যে হীনমন্যতা রয়েছে। কিন্তু আমাদের মনে রাখা প্রয়োজন যে উপনিবেশিক সময় থেকেই আমাদের এ অঞ্চলের জ্ঞান-বিজ্ঞানের শাখা, বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য যতখানি প্রসিদ্ধ হয়েছে, এটি একটি বিরল দৃষ্টান্ত। অন্য যেসব দেশে উপনিবেশ হয়েছিল, তাদের কিন্তু অতটা অগ্রগতি দেখা যায় না। আমাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি আছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাংলা ভাষা টিকে আছে, বাংলা ভাষাকে আমরাই বিকশিত করেছি। কারণ জাতিগতভাবে আমাদের সেই মনোভাবটা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু আশির দশকের পর সেটা আর রইল না। যে দলের সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন, ভাষার সমৃদ্ধির জন্য, রাষ্ট্রভাষাকে রক্ষা জন্য রাষ্ট্রব্যবস্থার যে ভূমিকা পালন করা দরকার, যে দূরদর্শিতা দরকার, সেটা কোনো সরকার আমলেই দেখা যায় না।'

তিনি আরও বলেন, 'রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য, জাতি গঠনের জন্য জাতীয় ঐক্য রক্ষার ব্যাপারে চেষ্টা থাকা দরকার। এ ব্যাপারে সরকারের কি কোনো চেষ্টা আছে? দেশে তো এখন কোনো গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলও নেই। আমাদের ভাষার, জাতির উন্নতির জন্য সবার আগে একটা সর্বজনীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা জরুরি।'

ভাষার কারণে মানুষের মধ্যে তৈরি শ্রেণি বিভেদের বিষয়ে অধ্যাপক সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান বলেন, 'বাংলা ভাষা যদি এলোমেলো হয়ে থাকে, তাহলে আমাদের মধ্যে ঐক্যের জায়গাটা নষ্ট হয়ে যাবে। একটা নৃগোষ্ঠীর বড় ঐক্যের জায়গা হলো ভাষা। এখন যদি এমন হয় আমি কথা বলছি বাংলায়, আপনিও কথা বলছেন বাংলায়, কিন্তু তবুও আমি আপনার কথা বুঝতে পারি না, আপনি আমার কথা বুঝতে পারেন না, তাহলে আপনার সঙ্গে আমার কোনো ঐক্য তৈরি হবে না। তাই ভাষাগত এই বিভেদ দূর করতে ক্ষমতাসীন স্বার্থান্বেষী মহলের অনাগ্রহও এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।'

'সর্বস্তরের বাংলা ভাষার কথা বলছি, কিন্তু আমার এখানে তো উচ্চশিক্ষায় বাংলা বই নেই। আমি এই বইয়ের অভাব পূরণ না করে ভাষা নিয়ে এক ধরনের আবেগি জায়গা থেকে কথা বলছি', যোগ করেন তিনি।

 

Comments

The Daily Star  | English

Teknaf customs in limbo as 19 mt of rice, authorised by AA, reaches port

The consignment of rice weighing 19 metric tonnes arrived at Teknaf land port on Tuesday evening with the documents sealed and signed by the Arakan Army

1h ago