ডিআইজির বাংলোবাড়ি: সিলগালা ভেজাল সার কারখানায় চলছে উৎপাদন

মেঘনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি। ছবি: স্টার

ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার আলিপুর এলাকায় মেঘনা ফার্টিলাইজার কোম্পানি লিমিটেডে ২০২১ সালের জুলাই মাসে অভিযান পরিচালনা করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। ২ দিনের সেই অভিযানে প্রতিষ্ঠানটি থেকে প্রায় ১৫০ কোটি টাকা মূল্যের নকল সার ও কীটনাশক জব্দ ও ধ্বংস করে ভ্রাম্যমাণ আদালত।

ভ্রমমাণ আদালতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ব্যান্ডের মোড়কে ভেজাল ও কীটনাশক বাজারজাত করে কৃষকের ক্ষতি করে আসছিল। ওই অভিযানে কারখানাটিকে সিলগালা করা হয়।

ভ্রাম্যমাণ আদালত ও স্থানীয়দের তথ্যে জানা যায়, কারখানাটি পুলিশের ডিআইজি মিজানুর রহমানের বাংলোবাড়িতে অবস্থিত। অন্তত আড়াই একর জমি ওপর কয়েকটি বিশাল সেডে স্থাপিত কারখানাটির মালিক সাইদুর রহমান খান। সাইদুর রহমান খান ডিআইজি মিজানুর রহমানের 'ঘনিষ্ঠজন'। ডিআইজি মিজানুর রহমানের পৃষ্ঠপোষকতায় কারখানাটি তিনি পরিচালনা করেন।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মতে কারখানাটি এখনো সিলগালাই আছে এবং চাবি স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে।

মেঘনা ফার্টিলাইজার কোম্পানির কেরানীগঞ্জে কারখানাটি ছাড়াও হেমায়েতপুরে আরও একটি শাখা আছে। সম্প্রতি কারখানা থেকে ৯ ট্রাক ভেজাল টিএসপি সার বগুড়ায় জব্দ হয়েছে। পুলিশ ধারনা করছে, মেঘনা ফার্টিলাইজার কোম্পানির এই ২টির যেকোনো ১টিতে সারগুলো পুনরায় প্যাকেট করা হয়েছে।

বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক মো. আব্দুল মোন্নাফ বলেন, 'আমরা বিষয়টি তদন্ত করছি।'

দ্য ডেইলি স্টারের অনুসন্ধানেও জানা গেছে, কারখানাটি সিলগালা হলেও কারখানার গেট বাইরে থেকে লাগিয়ে নিয়মিত উৎপাদন চালিয়েছে প্রতিষ্ঠানের মালিক সাইদুর রহমান খান।

কারখানার আশেপাশের একাধিক বাসিন্দা (নিরাপত্তাজনিত কারণে নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না) দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, কারখানাটি সিলগালা হলেও, কয়েকদিন পর থেকেই পুরোদমে উৎপাদন শুরু হয়। কারখানার মূল গেট বাইরে থেকে সিলগালা অবস্থায় দেখা গেলেও ওই গেটটি ভেতর থেকে খোলা যায়। এ ছাড়া, অভিযানের পরপর পাশেই উত্তর-পশ্চিম কর্নারে একটি গেট নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠানের মালিক। মূলত ওই গেট দিয়েই শ্রমিকদের কারখানায় প্রবেশ করানো হয়। কারখানাটি সিলগালা করার পরও মালিক পুরোদমে কারখানা পরিচালনা করেছেন। ডিআইজি মিজানুর রহমানও কয়েকদিন পরপর সেখানে আসেন।

কারখানাটির সঙ্গে লাগোয়া একটি বাড়িতে বসবাসকারী নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নারী ডেইলি স্টারকে জানান, কারখানা সিলগালা করার পর একদিনও কারখানা বন্ধ থাকেনি। কারখানাটিতে সারারাত উৎপাদন করা হয়।

তিনি বলেন, 'কারখানার বিষাক্ত ধোয়া ও গন্ধে বসবাস করাই কঠিন। কী হবে এগুলো বলে? কিছুই হবে না। কারণ এটি ডিআইজি মিজান সাহেবের প্রতিষ্ঠান।'

সরেজমিনে কারখানা এলাকায় দেখা যায়, কারখানাটির মোট ৩টি গেট আছে। ৩টি গেটই বাহির থেকে তালা লাগানো। গেটের ফাঁকা যায়গা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখা যায়, ভেতরে মানুষ হাঁটাহাঁটি করছেন।

গেটের বাহিরে এই প্রতিবেদককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একজন এগিয়ে আসেন এবং নিজেকে নিরাপত্তা কর্মী পরিচয় দিয়ে প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে চান। পরিচয় জানার পর তিনি ভেতর থেকে কাউকে ডেকে আনার কথা বলে চলে যান। ১ ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও আর তার দেখা পাওয়া যায়নি।

যোগাযোগ করা হলে কারখানার মালিক সাইদুর রহমান খান মুঠোফোনে ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আলিপুরের কারখানাটি সিলগালা অবস্থায় আছে। কারখানায় কোনো প্রকার উৎপাদন করা হয়নি। কারখানার চাবি লোকাল পুলিশ ফাঁড়িতে আছে।'

স্থানীয়দের অভিযোগ কারখানাটিতে নিয়মিত উৎপাদন করা হয়। এ ছাড়া, সম্প্রতি কারখানা থেকে ৬ ট্রাক ভেজাল টিএসপি সার বগুড়ায় গিয়ে জব্দ হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে সাইদুর রহমান বলেন, 'এগুলো সঠিক না। কারখানায় উৎপাদন চলে না।'

কারখানায় যদি উৎপাদন না চলে তাহলে সাংবাদিক পরিচয় পাওয়ার পর কারখানা পরিদর্শনে অনুমতি দেওয়া হলো না কেন? এ ছাড়া, কারখানায় নিয়মিত ট্রাক প্রবেশ করে এবং মূল ফটকে ট্রাকের চাকার দাগ দেখা গেছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'কারখানার গেটের চাবি আমাদের কাছে নেই। কারখানার ভেতরে ডিআইজি স্যারের বাড়ি আছে। ওখানে ডিআইজি স্যার গাড়ি নিয়ে মাঝে মাঝে আসেন। ওই গাড়ির চাকার দাগ দেখে হয়তো আপনার কাছ এমন মনে হয়েছে।'

বিষয়টি জানতে কেরানীগঞ্জের উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শহিদুল আমিনের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা অভিযান পরিচালনার পর পুলিশের কাছে চাবি হস্তান্তর করি। মূলত পুলিশেরই তদারকি করার কথা। আমাদের মতে প্রতিষ্ঠানটি এখনো বন্ধ আছে। কারণ মামলা সুরাহা হয়নি এবং মালিকের লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এখন যদি কারখানাটিতে উৎপাদন চলে আমরা কী করবো? আমাদেরও তো একটা সীমাবদ্ধতা আছে। ইচ্ছা করলেই একটা সিলগালা কারখানায় আমরা ঢুকতে পারি না।'

'পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, পুলিশই ভালো বলতে পারবে,' শহিদুল আমিন যোগ করেন।

এ বিষয়ে কেরানীগঞ্জ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুনুর রশিদ মামুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি থানায় কয়েকদিন যাবৎ যোগদান করেছি। বিষয়টি আমার জানা নেই। কারখানার চাবিটি কার কাছে জমা আছে খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। ওই এলাকাটা কলাতিয়া পুলিশ ফাঁড়ি দেখাশোনা করে। আপনি ওইখানে একটু যোগাযোগ করেন।'

যোগাযোগ করা হলে কলাতিয়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ সহিদুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কোনো ভেজাল কীটনাশক ও সার কারখানার চাবি আমাদের নিকট হস্তান্তর করা হয়নি। অভিযান যারা পরিচালনা করেছিলেন তারাই বলতে পারবেন কাদের কাছে চাবি আছে।'

স্থানীয়দের অভিযোগ, বাড়ির মালিক পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়ার কারণেই অবৈধ কারখানাটির বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না।

মিজানুর রহমান একসময় বাগেরহাট জেলার পুলিশ সুপার ছিলেন। তখন বাড়ি নির্মাণে পুলিশ সদস্যদের ব্যবহার করায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি।

বিষয়টি জানতে মিজানুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'কারখানাটি আমার কাছ থেকে ভাড়া নেওয়া হয়নি। কারখানাটি একটি লিমিটেড কোম্পানির কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছে সাইদুর। কারখানার সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। কারখানা থেকে আমার বাড়িটি পুরোপুরি প্রাচীর দিয়ে আলাদা। আমি কেন এই প্রশ্নের জবাব দেব?'

সাইদুর রহমান বলেছেন কারখানাটি আপনার জমিতে করা হয়েছে— এমন প্রশ্নের জবাবে মিজানুর রহমান বলেন, 'সাইদুর একটা বাটপার। ২ বছর যাবৎ কারখানার ভাড়া দেয় না। সাইদুরের সঙ্গে কথা বলেন।'

সাইদুরের হেমায়েতপুরে আরও একটি সার কারখানা

সাইদুর রহমানের খানের সাভারের হেমায়েতপুর মুশুরিখোলা এলাকায় মেঘনা ফার্টিলাইজার কো. লি. নামে আরও একটি সার কারখানা আছে। সেখানেও নিম্নমানের ভেজাল জৈব সার উৎপাদন করা হয় বলে অভিযোগ আছে। গত বছরের শেষের দিকে হেমায়েতপুরের কারখানাটিতে অভিযান পরিচালনা করে স্থানীয় কৃষি বিভাগ। পরে ওই কারখানা থেকে জৈবসারের নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাব টেস্টে মানের তারতম্যের প্রমাণিত হয়। পরে কারখানাটি বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেয় কৃষি বিভাগ।

সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নাজিয়াত আহম্মেদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাইদুর রহমানের কেরানীগঞ্জের কারখানায় অভিযান পরিচালনার পরপরই আমরা ওনার হেমায়েতপুর এলাকার কাখানায় অভিযান পরিচালনা করি। সেখানে শুধু জৈব সার উৎপাদন হয়। সারের গুণগত মান নিয়ে সন্দেহ হলে আমরা নমুনা সংগ্রহ করে টেস্টে পাঠাই। নমুনা টেস্টে সার নিম্নমানের প্রমাণ পাওয়ায় কারখানাটি বন্ধ রাখার নির্দেশনা দেওয়া হয়। আমাদের জানা মতে কারখানাটি বন্ধ আছে। কারখানাটির লাইসেন্স বাতিলের জন্য আমরা অধিদপ্তরে লিখিত আবেদন করেছি।'

সরেজমিনে কারখানা এলাকা পরিদর্শন করে জানা যায়, কারখানাটি বন্ধ রাখার নির্দেশনা উপেক্ষা করে সাইদুর রহমান মাঝে মাঝে কারখানায় উৎপাদন করেন।

এই কারখানাটিতেও প্রবেশের চেষ্টা করা হলে অনুমতি পাওয়া যায়নি।

কারখানাটি সম্পর্কে জানতে চাইলে কারখানার মালিক সাইদুর রহমান খান ডেইলি স্টারকে বলেন, 'হেমায়েতপুরের কারখানাটি আমার নিজের জমিতে করা। ওটাও এখন বন্ধ আছে। লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেছি। লাইসেন্স নবায়ন হলে উৎপাদনে যাব।'

কৃষি বিভাগের নির্দেশনা উপেক্ষা করে কারখানাটি মাঝেমধ্যে পরিচালনার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বিষয়টি সঠিক না। আপনি আমার অফিসে আসেন অথবা আপনার সঙ্গে দেখা করি। কোথায় দেখা করবো ভাই, বলেন।'

প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন দ্য ডেইলি স্টারের বগুড়া সংবাদদাতা মোস্তফা সবুজ    

Comments

The Daily Star  | English

Jamaat rally begins at Suhrawardy Udyan with cultural programme

The first phase of Bangladesh Jamaat-e-Islami's rally at the historic Suhrawardy Udyan in Dhaka began this morning with a cultural programme

1h ago