আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস

তারা কোথায় অদৃশ্য হয়ে যান

তারা কোথায় অদৃশ্য হয়ে যান
ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

'আমাদের প্রিয় মানুষটি কেমন আছেন? তিনি কি ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করেন? তাকে কি নির্যাতন করা হয়? তিনি কি... বেঁচে আছেন?'

এসব প্রশ্ন 'গুম'র শিকার ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের তাড়া করে। কারণ, তারা সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে আশা নিয়ে সপ্তাহ, মাস ও বছর কাটান।

বাংলাদেশে ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে কমপক্ষে ৫২২ জন 'গুম' হয়েছেন বলে জানিয়েছে কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন।

'গুম' থেকে মুক্তি পাওয়া বেশিরভাগ মানুষ বাড়ি ফেরার পর জনসাধারণের কাছ থেকে দূরে থাকেন। তারা কোথায় ছিলেন বা কে তাদের নিয়ে গিয়েছিলেন তা প্রকাশ করেন না।

সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) গত মার্চের সমীক্ষায় বলা হয়, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া 'গুমের' ঘটনাগুলোয় দেখা গেছে, 'গুম' হওয়া ৩০ শতাংশ ব্যক্তিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে বা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে এবং কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের কেউই এ বিষয়ে কথা বলেননি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে 'গুম' থেকে ফিরে আসা ৫ জন তাদের প্রিয়জনদের প্রাসঙ্গিকভাবে জিজ্ঞাসা করা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন।

যদিও পরিবারের সদস্যরা তাদেরকে প্রতিটি অলি-গলিতে খুঁজেছিলেন, তবুও সেই ব্যক্তিদের দাবি, তারা রাজধানীর ভেতরেই ছিলেন।

বেঁচে ফেরা ব্যক্তিদের ভাষ্য, ঢাকায় কমপক্ষে ২টি কেন্দ্র আছে যেখানে 'গুম' হওয়া ব্যক্তিদের রাখা হয়। অভিযোগ রয়েছে, এর একটি নিরাপত্তা বাহিনী ও অন্যটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা পরিচালনা করে। দক্ষিণাঞ্চলের একটি জেলাতে আরও একটি কেন্দ্র আছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বেঁচে ফেরা ব্যক্তিদের দাবি, কেন্দ্রগুলো পুরোপুরি অবৈধ এক কারাগার। জনগণের টাকায় আইনশৃঙ্খলা ও দেশকে রক্ষার নামে এসব কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে।

সূত্রের গোপনীয়তা নিশ্চিত করতে দ্য ডেইলি স্টারে ইউনিটগুলোর নাম প্রকাশ করা হলো না।

ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

বেঁচে থাকা ২ জনের বর্ণনা একটি অপরটির সঙ্গে মিলে যায় এবং একটি কেন্দ্রের দিকে নির্দেশ করে। ধরি কেন্দ্রটি 'উ'।

বেঁচে থাকা অপর ৩ জনের বর্ণনা দ্বিতীয় একটি কেন্দ্রের নির্দেশ করে। ধরি সেটি হচ্ছে 'ক'।

তাদেরকে ২ মাস থেকে দেড় বছর পর্যন্ত এসব কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল। তাদের আটকে রাখা হয়েছিল ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ সালের মধ্যে।

বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে ৪ জনকে রাজনৈতিক কারণে এবং তাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কার্যক্রমের জন্য তুলে নেওয়া হয়েছিল। অপর একজন, যাকে 'ক' কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল, তুলে নেওয়া হয়েছিল ভুল পরিচয়ে।

তাদের সবাইকে ঢাকা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল। যা সিজিএসের গবেষণার সঙ্গে মিলে যায়—যেখানে দেখা গেছে যে এক-তৃতীয়াংশ গুমের ঘটনা ঘটেছে শুধু রাজধানীতে।

বর্ণনায় 'উ' কেন্দ্রে ভুক্তভোগীরা কঠোর ও অমানবিক জীবনযাপন এবং নির্যাতনমূলক জিজ্ঞাসাবাদের কথা বলেছেন। 'ক' কেন্দ্রের ভুক্তভোগীরা বন্দিদের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু রয়েছে এমন একটি কারাগারের বর্ণনা দিয়েছেন।

উভয়ক্ষেত্রেই একজন ব্যক্তিকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্জন কারাবাসে, নির্বিচারে ও বেআইনিভাবে অন্তহীন সময়ের জন্য আটকে রাখার উদ্দেশ্যে রাখা হয়েছে। এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে বন্দি জানেন না যে তিনি মুক্তি পাবেন, নাকি এখানেই তার জীবন শেষ হবে।

কেন্দ্র 'উ' এ বন্দিদের বর্ণনা অনুযায়ী, তাদেরকে প্রায় আড়াই ফুট প্রস্থ, ৪ ফুট দৈর্ঘ্য এবং ৫ ফুট উচ্চতার কক্ষে বন্দি রাখা হয়েছিল। 'এমনভাবে কেউ শুয়েও থাকতে পারবে না বা দাঁড়ায়েও থাকতে পারবে না। সেখানে সব সময় আধা বসা ও আধা শোয়া অবস্থায় থাকতে হবে।' কক্ষের ৩ দিকে কংক্রিটের দেয়াল এবং ১ দিকে কারাগারের দরজা ছিল।

বন্দিদের মধ্যে ১ জনকে দক্ষিণের একটি জেলায় স্থানান্তরের আগে ৪ মাস সেখানে রাখা হয়েছিল। অন্যদিকে একই কেন্দ্রের মধ্যে একটি বড় সেলে স্থানান্তরের আগে আরেক বন্দিকে সেখানে এক সপ্তাহের কিছু বেশি সময় ধরে রাখা হয়েছিল।

উভয় বন্দিই 'উ' কেন্দ্রে থাকাকালীন পুরো সময় চোখ বেঁধে ও হাতকড়া পরা অবস্থায় ছিলেন বলে জানান।

একজন বন্দি বলেন, 'খুব অন্ধকার ছিল, কিন্তু তারপরও আমার চোখ বেঁধে রাখা হয়েছিল। প্রত্যেকেরই চোখ বাঁধা ছিল। সেলটি ২ তলা মাটির নিচে ছিল। তারা সেখানে অন্তর্বাস ছাড়া বাকি সব জামা-কাপড় খুলে ফেলে। একটি লুঙ্গি দেয়। লুঙ্গিটি অনেক পরে, বিবস্ত্র করার অনেক ঘণ্টা পরে দিয়েছিল।'

সেখানে একজন প্রহরী তাদের অবস্থা দেখে দয়া করে গোপনে রাতে তাদের হাতকড়া খুলে দিতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'আমাদের বন্দিত্বের পুরো সময়কালে হাত পিছনে হ্যান্ডকাফ দিয়ে বাধা ছিল। শুধুমাত্র খাওয়া ও টয়লেটে যাওয়ার সময় খুলে দেওয়া হতো।'

'উ' কেন্দ্রে ৩ মাসের কম সময় বন্দি থাকা একজন বলেন, 'একজন চাচা ছিলেন, প্রবীণ প্রহরী; তিনি কয়েক ঘণ্টার জন্য মধ্যরাতের পর আমাদের হাত খুলে দিতেন। তখন আমরা চোখ খুলতে পারতাম। আমি বন্দি থাকাকালীন ৩ রাতে তাকে পেয়েছিলাম।'

তিনি জানান, 'উ' কেন্দ্রে আসার এক সপ্তাহের মধ্যে তাকে একটি বড় সেলে স্থানান্তর করা হয়। 'আমি ধাতবের তৈরি সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় সেলে গিয়েছিলাম। সেখানে একটি বড় ঘর ছিল, কিন্তু সেটি ছিল অত্যন্ত গরম এবং সেখানে প্রচুর মশা ছিল। সেখানে স্ট্যান্ডফ্যান ছিল, কিন্তু সেটা মাঝে মাঝে চালু করা হতো। তারা জানতো ঠিক কতক্ষণ সেটি চালালে আমরা বেঁচে থাকতে পারব।'

তিনি আরও বলেন, 'মেঝেটি ভাঙা সিমেন্টের ছিল এবং আমাদেরকে মেঝেতে বিছানা ছাড়াই ঘুমাতে হতো। আমাকে এক বোতল পানি দেওয়া হয়েছিল এবং সেটিকেই আমি বালিশ হিসেবে ব্যবহার করতাম। রাতে মেঝে যে এত ঠাণ্ডা হতে পারে…'

৬ মাসের কম সময় কেন্দ্রে থাকা আরেক বন্দি বলেন, 'যতদিন আমি ওই কেন্দ্রে ছিলাম, আমাকে চোখ বেঁধে এবং হাতকড়া পরিয়ে রাখা হয়েছিল। কেন্দ্রটি সম্ভবত ৩ তলা মাটির নিচে ছিল।'

তিনি জানান, এটি তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কারণ যখন তাকে অন্য কেন্দ্রে স্থানান্তর করা হয়েছিল, তখন তারা তাকে ৩ তলায় উঠতে বাধ্য করেছিল এবং তারপরে তিনি সরাসরি সেই তলায় থাকা একটি গাড়িতে উঠেছিলেন।

প্রথম বন্দির মতো তার সেলটিতেও শোয়ার জন্য যথেষ্ট জায়গা ছিল না এবং তিনি কয়েক মাস ধরে বসে ছিলেন।

ভুক্তভোগী ২ জনই জানান, খাবার দেওয়ার সময় প্লেট ও দরজার আওয়াজ শুনে তারা বন্দিদের সংখ্যা গণনা করেছেন।

প্রথম বন্দি বলেন, তার মনে আছে ১২টি সেল গুনেছিলেন, যেগুলো ছিল মুখোমুখি। 'একজন দয়ালু প্রহরীর সহযোগিতার কারণে যখন প্রথমবারে মতো চোখ খুলতে পেরেছিলাম তখন আমার বিপরীত পাশের সেলটি দেখেছিলাম। যখন তারা আমাদেরকে খাবার দিতো তখন আমি সেলের দরজায় ধাক্কা দেওয়ার শব্দ থেকেও গুনেছি।'

দ্বিতীয় বন্দি বলেন, 'ওই দীর্ঘ হলটিতে আমরা প্রায় ১৪ জন ছিলাম। খাবারের সময় মেঝেতে ধাতব প্লেটের আওয়াজ শুনে আমি এটা গুনেছি।'

একইভাবে, তাদেরকে আটকের সময়কালে ৫ বছরের ব্যবধান থাকলেও জিজ্ঞাসাবাদের সময় ২ জনকেই নির্যাতন করা হয়েছিল।

ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

একজন বলেন, 'আমাকে ৬ ঘণ্টা ধরে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছিল। আমার শরীরের প্রতিটি অংশে নির্যাতন করা হয়েছে। তাদের নির্যাতনের পদ্ধতি সিনেমার মতো। তারা উপরে থেকে তীব্র তাপ দেওয়ার জন্য কিছু একটা ব্যবহার করেছিল। তাদের নির্যাতনে আমার নাক দিয়ে রক্ত পড়েছে। আমি সেলে ফিরে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।'

অপরজন দাবি করেন, 'আমাকে গোড়ালি ও কব্জি বেঁধে একটি কাঠের চেয়ারে বসানো হয়েছিল। তারা আমার কানের লতিতে ২টি ক্লিপ সংযুক্ত করে, যেগুলো ২টি ব্যাটারির সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। তারা একটি করে প্রশ্ন করে আর আমার কানে শক দেয়। তারা হুমকি দিতে থাকে যে আমি তাদেরকে সহযোগিতা না করলে আমার যৌনাঙ্গে ক্লিপ লাগিয়ে দেবে। তাদের নির্যাতনে প্রস্রাব করে দিয়েছিলাম।'

তিনি আরও বলেন, 'আমি প্রার্থনা করার চেষ্টা করলে আমাকে মারধর করা হবে বলে তারা বলতেন। তারা বলতেন যে আমার মতো পাপীর প্রার্থনা করার দরকার নেই।'

তিনি অপর একটি কেন্দ্রে নির্যাতনের আরেকটি পদ্ধতিও বর্ণনা করেছেন। রাজধানী থেকে তুলে নেওয়ার পর তাকে রাজধানীর বাইরে দক্ষিণ দিকে অন্য একটি কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া হয়।

দ্য ডেইলি স্টার আটক ব্যক্তির নিরাপত্তার স্বার্থে জেলার নাম প্রকাশ করছে না।

তিনি বলেন, 'সেই জায়গায় পৌঁছাতে কয়েক ঘণ্টা লেগেছিল। সেই জেলায় যাওয়ার পথে বাসের কন্ডাক্টররা যখন যাত্রীর জন্য চিৎকার করে এলাকার নাম বলছিল, সেটা শুনেছিলাম। তাই জানি যে আমাকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। জায়গাটির খুব কাছেই একটি লঞ্চ জেটি ছিল, কারণ আমি সেখানে থাকার সময় জাহাজের হুইসেল শুনতে পেয়েছি।'

তিনি বলেন, ওই কেন্দ্রে নির্যাতনের পদ্ধতি ছিল জোর করে খাওয়ানো। 'তারা ৭-৮ কেজি গরুর মাংসের বালতি নিয়ে আসত। আমাকে বলত, আপনাকে এর অর্ধেক খেতে হবে। প্রতি বেলায় খাওয়ার জন্য ৬টি ডিম দিত।'

'আপনার কোনো ধারণাই নেই যে তারা প্রত্যেক বন্দির পিছনে কত টাকা খরচ করে', যোগ করেন তিনি।

ওই নির্দিষ্ট কেন্দ্রে দেয়ালগুলো ছিল ঢেউতোলা টিনের এবং বন্দিদের যেখানে রাখা হতো সেগুলো বড় বড় পশুর খাঁচার মতো। 'আমি সেগুলোর ভেতরে পা ছড়াতে পারতাম। সেখানে, আমার হাত সামনের দিকে আটকে রাখার পরিবর্তে, একটি হাত একটি হ্যাণ্ডকাফের সঙ্গে আটকে সেটিকে খাঁচার বাইরে একটি হুকের সঙ্গে সংযুক্ত লম্বা দড়িতে বাঁধা ছিল।'

লম্বা ঘরের ভেতরে ৪টি খাঁচা ছিল বলে জানান তিনি।

'একটা সময় আসে, যখন অন্য ৩ জনকে একদিন নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে যারা নিয়ন্ত্রণ করতেন তারা ফিরে এসে বলেন, ওই ৩ জনের একজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, অন্য ২ জনকে "ক্রসফায়ারে" গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সেই মুহূর্তে থেকে মুক্তি পাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি আতঙ্কে ছিলাম যে, এই ভাবেই আমাকেও হত্যা করা হবে', যোগ করেন তিনি।

'ক্রসফায়ারে'র হুমকি জিজ্ঞাসাবাদের একটি হাতিয়ার এবং নির্যাতনের পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 'আমাকে শহরের একটি বড় হাইওয়েতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল চোখ বেঁধে এবং হ্যাণ্ডকাফ লাগিয়ে। আমি জানি না সেটা কোন হাইওয়ে। যখন আমরা সেখানে পৌঁছলাম, সবাই আমাকে রেখে গাড়ি থেকে নেমে গেল। আমি অনুভব করতে পারছিলাম যে একজন লোক ঢুকছেন। তিনি আমার কাছে জানতে চান, আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড কি কি। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে আমাকে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে দৌড়াতে বলা হয়। আমি ভয় পেয়েছিলাম যে পেছন থেকে গুলি করা হবে, তাই আমি দৌড় না দিয়ে ওই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলাম', বলেন তিনি।

আটককৃতরা উভয়েই বলেন, বন্দিশালাগুলোর ভেতর থেকে যেন শব্দ বাইরে না যায় সেজন্য বড় মেশিনের শব্দ ব্যবহার করা হতো।

একজন বন্দি বলেন, একটি বড় জেনারেটর সব সময় চলত। আওয়াজের কারণে আমার নাক-গলা থেকে রক্ত পড়তে শুরু করে।

অপর বন্দি বলেন, নির্দিষ্ট সময়ে খুব জোরে গান বাজানো হতে। 'এতে আমার মাথা ব্যথা শুরু হতো।'

তিনি আরও বলেছিলেন যে তাকে মাঝরাতে গোসল করতে হতো। 'আমি খালি গায়ে থাকতাম এবং একটাই লুঙ্গি ছিল। প্রতিবার লুঙ্গি ভিজালে না শুকানো পর্যন্ত ভেজা লুঙ্গিটিই পড়ে থাকতে হতো। আমার ঠাণ্ডার সমস্যা আছে এবং এভাবে ভেজা লুঙ্গি পড়ে থাকা ছিল আমার জন্য নির্যাতন।'

৫ বছর পরে কেন্দ্রে লন্ড্রি সিস্টেমের কিছুটা উন্নত হয়। অপর বন্দি বর্ণনা করেন, 'তাদের কাছে লুঙ্গি ও টি-শার্ট ছিল। বন্দিদের মধ্যে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সেগুলো দেওয়া হতো। আমরা টি-শার্ট ও লুঙ্গি ধুয়ে শুকাতে পারতাম এবং বদলে নিতে পারতাম।'

বন্দি উভয়েরই চুল-দাড়ি কাটা হয়েছিল মুক্তির ঠিক আগে, একবারই।

ইলাস্ট্রেশন: বিপ্লব চক্রবর্তী

কেন্দ্র 'ক'

কেন্দ্র 'ক' এর ৩ বন্দি তাদের বর্ণনায় কেন্দ্র 'উ' এর থেকে তুলনামূলক ভালো সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা বলেছেন এবং নির্যাতনের কথা বলেননি।

সব বন্দি কেন্দ্রটিকে একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ কারাগার বলে বর্ণনা করেছেন। যেখানে নিজস্ব রান্নাঘর, সেলুন, ডাক্তারের কক্ষ, বাথরুম, বিছানা ও কম্বলসহ কক্ষ, হাই কমোড টয়লেট এবং এমনকি বন্দিদের পড়ার জন্য বইও রয়েছে।

বন্দিদেরকে অনেকে সম্মানের সঙ্গে 'স্যার' বা 'চাচা' বলে ডাকতেন।

কিন্তু এর কোনোটিই এই সত্যকে অস্বীকার করে না যে, ওই বন্দিদেরকে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ২ বছর পর্যন্ত নির্জন কারাগারে আটকে রাখা হয়েছিল এবং তাদের পরিবার জানত না যে তারা মারা গেছেন নাকি বেঁচে আছেন।

এক বন্দি বলেন, 'আমার ঘরে একটি লোহার খাট ছিল এবং গদি তৈরি করার জন্য ৪টি কম্বল দেওয়া হয়েছিল। একটি লাইট সব সময় জ্বলত এবং একটি দরজার কোণে এক্সজস্ট ফ্যান চলত।'

সাধারণ পেশাদার ওই ব্যক্তিকে বাড়ি থেকে তুলে নেওয়া হয়েছিল বিরোধী রাজনৈতিক চিন্তা-ভাবনার সমর্থনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কার্যক্রমের জন্য।

বন্দি হওয়ার কয়েকদিন পর তিনি পড়ার জন্য একটি বই চেয়েছিলেন। 'তারা আমারকে একটি বইয়ের দ্বিতীয় খণ্ড দেন এবং যখন আমি প্রথম খণ্ড চাইলাম, তারা জানান যে সেটি অন্য একজন বন্দি পড়ছেন। পরে, যখন আমি একটি বইয়ের নাম বলে চাইলাম, তখন তারা সেটি দোকান থেকে কিনে আনেন। তবে বইয়ে দোকানের নাম লেখা প্রথম পাতাটি ছিঁড়ে ফেলা হয়েছিল।'

বন্দিদের হাতকড়া পড়ানো হয়নি, এমনকি কক্ষে থাকা অবস্থায় চোখও বেঁধে রাখা হয়নি। এর একটি সম্ভাব্য কারণ হতে পারে যে তাদের কক্ষে ২টি দরজা ছিল। একটি জেল সেলের মতো দণ্ডযুক্ত এবং আরেকটি শক্ত দরজা। তাই তারা বাইরে কিছুই দেখতে পাননি।

তিনি বলেন, 'দরজার নিচে দিয়ে একটি ছোট ফাঁক বানানো ছিল, সেখান দিয়ে খাবার কক্ষের ভেতরে দিত। আমি ঘরের ভেতরেই হাত ধুতাম।'

প্রতিবার কক্ষের বাইরে নেওয়ার সময় তাদের পুরো মাথা কালো একটি কাপড় দিয়ে ঢেকে দিতো এবং হাতকড়া পড়ানো হতো। টয়লেটে যাওয়ার সময়ও একই কাজ করা হতো।

তিনি বলেন, 'একবার কালো কাপড়টি সড়ে গেলে আমাকে যে প্রহরী নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি আবার সেটি পড়ানোর প্রয়োজন মনে করলেন না। আমি আমার ডানদিকে একটি রান্নাঘর এবং সেখানে একজন নারীকে রান্না করতে দেখলাম।'

সব খাবার গরম গরম পরিবেশন হতো এবং বন্দিরা খাবার বেছে নিতে পারতেন। একজন বন্দি বলেন, 'দুপুরের খাবারের সময় আমাকে শাক, তেলাপিয়া মাছ, ২টি ডিম ও ডাল দেওয়া হয়। আমি যখন তাদের বলি যে আমি চাষ করা মাছ ও ডিম খেতে চাই না, তখন তারা আমার জন্য গরুর মাংস নিয়ে আসেন।'

তিনি আরও বলেন, 'রোজায় সেহরিতে আমাকে গরম দুধ, একটি বড় কলা, ভাত, শাকসবজি ও প্রোটিন এবং ইফতারের জন্য ফল, জুস, ভাজা খাবার, ছোলা ও মিষ্টি দেওয়া হতো।'

বেশ কয়েকজন বন্দি বর্ণনা করেছেন যে বিশেষ দিনগুলো তারা বিশেষ খাবার পেতেন। সকালে পরাটা, সেমাই, ভাত ও বাদামের মিষ্টি এবং দুপুর ও রাতে তেহারি, ভাত, গরুর মাংস ও মুরগির মাংস দিয়েছে।

এক বন্দি বলেন, 'যতবার আমাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, প্রতিবারই জানতে চাওয়া হয়েছে যে, আমাকে খাবার দেওয়া হচ্ছে কিনা এবং ভালো ব্যবহার করা হচ্ছে কিনা। কিন্তু আমার সঙ্গে যতই ভালো আচরণ করা হোক না কেন, এটি কোনো জীবন না। আমি আমার পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম এবং তারা আমার জীবনকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিল।'

একজন প্রহরী একবার একজন বন্দিকে বলেছিলেন, 'আমি দিতে পারব না এমন কিছু না চাইলে, এখানে যা চাইবেন তাই পাবেন।' এই দিতে না পারার মতো চাওয়া হচ্ছে, তাদের পরিবার বা বন্ধুদেরকে তাদের সম্পর্কে খবর দেওয়া।

বন্দিরা ২ ধরনের কক্ষের বর্ণনা দিয়েছেন। একটি দেয়ালের মুখোমুখি এবং অন্যটি বারান্দার দিকে।

দেয়ালের মুখোমুখি সেলে ছিলেন এমন একজন বন্দি জানান, তার সেলের শক্ত দরজা বেশিরভাগ সময় খোলা রাখা হতো। কিন্তু প্রত্যেকবার তাকে বাথরুমে নেওয়ার জন্য বন্ধ করা হতো, যাতে তিনি তাদেরকে দেখতে না পারেন। এই আটক ব্যক্তিকে ভুল পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল।

বারান্দার মুখোমুখি সেলে থাকা অপর একজন বন্দি জানান, তার কক্ষে একটি ছোট ভেন্টিলেটর ছিল। সেখান দিয়ে তিনি বাইরে দেখতে পেতেন। তার সেল ছিল নিচতলায়।

তিনি বলেন, 'ছোট ভেন্টিলেটর দিয়ে আমি একটি কাঁঠাল গাছে কাঁঠাল ধরতে এবং সেগুলো বড় হতে দেখেছি। আমি বৃষ্টি দেখেছি, পাখির শব্দ শুনেছি। আমি একটি ছেলেকে গিটার বাজাতে শুনেছি এবং তার বোন তার মায়ের কাছে তাকে নিয়ে অভিযোগ করছে সেটাও শুনেছি।'

এই স্বাভাবিক, সুন্দর পৃথিবীর ঠিক পাশেই তিনি নির্জন কারাবাসে বন্দি ছিলেন।

তিনি বলেন, 'আমি একবার পাশের সেলমেটের সঙ্গে কথা বলার জন্য দেয়ালে টোকা দিয়েছিলাম, কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। দেয়ালগুলো প্রায় ১০ ইঞ্চি পুরু এবং অনেক উঁচু ছিল।'

তিনি বন্দি থাকা প্রতিটি দিন গুনেছেন। কাঠের একটি ছোট টুকরা ব্যবহার করে দেয়ালের নীচে তারিখ লিখতেন। জাতীয় দিবসগুলো হিসাব করে তিনি সঠিক হিসাব লিখে রাখতে পারতেন। বাইরে দেশাত্মবোধক গান শুনে তিনি বুঝতে পারতেন, এটি কোন তারিখ।

তিনি বলেন, 'আগে যারা এই কক্ষে বন্দি ছিলেন তারা অনেক কিছু লিখেছিলেন। সেখানে কবিতা থেকে শুরু করে আরবি লেখা, হিন্দু ধর্মীয় চিহ্ন পর্যন্ত ছিল। একদিন কয়েকজন লোক এসে দেয়াল পেইন্ট করে দিয়ে যায়।'

একবার তিনি পা পিছলে বাথরুমে পড়ে যান এবং এক্স-রে করার জন্য হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হয়।

তিনি বলেন, 'তারা আমার মাথা ঢেকে একটি গাড়িতে নিয়ে যায়। এই প্রথম আমি আমার মুখে সূর্য অনুভব করলাম। আমি শুনলাম রিকশাওয়ালারা ঝগড়া করছে। আমি একবার ভাবলাম, পালাই। কিন্তু পরেই মনে হলো, তারা গুলি করবে বা ধরে ফেলবে। এমন কিছু হলে আর এখন যেমন আরামে রেখেছে সেটা আর করবে না। তখন নির্যাতন করতে পারে। আমি কর্মকর্তাদের দেওয়া আশ্বাসে মনকে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছিলাম যে, সময় হলে আবার বাড়ি ফিরব।'

আরেকজন বন্দি বর্ণনা করেন, কিভাবে তিনি পাশের সেল থেকে প্রচুর কান্নার শব্দ শুনতে পান। তিনি বলেন, 'যদি তিনি খুব কান্নাকাটি করতেন, তাকে কোথাও নিয়ে যাওয়া হতো। তারপর ফিরে অনেকক্ষণ ঘুমাতেন।'

সবকিছু ছাড়িয়ে নির্জন কারাবাসটিই তাদের জীবনে সবচেয়ে কঠিন অভিজ্ঞতা ছিল। বিষয়টি এতটাই দুর্বিষহ ছিল যে, তারা সেই সময়ের একমাত্র ভালো অভিজ্ঞতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন সেই প্রহরীদের সঙ্গে আলাপচারিতা। বাইরের বিশ্বের সঙ্গে তাদের একমাত্র যোগাযোগ ছিল সেটিই।

অনেক বন্দি তাদের সম্পর্কে সম্মান দিয়ে কথা বলেছেন, অনেকটা স্নেহের সঙ্গে, যারা তাদের তদারকি করেছেন। যদিও তারা জানতেন যে, এই মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে তারাও জড়িত।

তাদের বক্তব্যকে মিথ্যা বলে আখ্যায়িত করা খুবই সহজ। কারণ তাদের পরিচয় প্রকাশ করা হচ্ছে না। কিন্তু তাদের বর্ণনা শুনে প্রশ্ন জাগে, পরিচয় প্রকাশ করে কে আবার সেই নির্যাতিত জীবনে ফিরে যেতে চাইবে?

Comments

The Daily Star  | English
US election outcome’s likely impact on the Russia-Ukraine war

US election outcome’s likely impact on the Russia-Ukraine war

The endgame of the Ukraine war remains uncertain with US policy likely to be influenced by the outcome of the US election.

3h ago