গুম: ‘নিখোঁজ’র পর ‘আটক’ ও জীবন থেকে হারানো কয়েকটি দিন
'তারা (পুলিশ) প্রথমে আমাকে নির্মাণাধীন বিআরপি (ভাসানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প) ভবনে নিয়ে যায়। পরে আমাকে সেপটিক ট্যাংকের ভেতর নামতে বাধ্য করে। সেখানে আমি সারাদিন, সারারাত কাটাই।'
মাছ ব্যবসায়ী মোশাররফের দাবি, গ্রেপ্তার দেখানোর আগে তাকে ওই সেপটিক ট্যাংকে ৩৬ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল।
গুম বা বলপূর্বক অন্তর্ধানের কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনো ব্যক্তিকে তুলে নেওয়া কিংবা অপহরণের পর তিনি একেবারে বাতাসে মিলিয়ে যান। আর কখনো তার কণ্ঠ শোনা যায় না।
আরেক ক্ষেত্রে গুম হওয়া ব্যক্তি ফিরে আসেন। তবে অনেকগুলো মাস কিংবা বছরের পর।
আর মোশাররফের ঘটনাটি হচ্ছে গুমের সবচেয়ে পরিচিত ধরন।
এমন ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে তুলে নেওয়ার পর তাকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে হাজির করার আগে কোনো নির্দিষ্ট জায়গায় আটকে রাখা হয়। যা কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন, এমনকি কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত হতে পারে। এভাবে আটক ব্যক্তিকে হেফাজতে রাখার এই সময়গুলোর হিসাব থাকে না।
ফৌজদারি কার্যবিধি (ধারা ১৬৭) অনুসারে, কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে আদালতে হাজির করার বিধান আছে। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, সাংবাদিক কিংবা অধিকারকর্মী মাত্রই জানেন যে, খুব অল্প ক্ষেত্রেই এই বিধানটি প্রতিপালিত হয়।
মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ বিষয়ে খুব কম তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। আর নিয়মিত ঘটে চলা এ বিষয়টি কেবল সম্প্রতি গণমাধ্যমের নজরে আসে, যখন কার্টুনিস্ট আহমেদ কিশোর তাকে অজ্ঞাত জায়গায় আটকে রেখে নির্যাতনের অভিযোগে মামলা করেন।
তবে ঢাকার মেট্রোপলিটন সেশন জজ আদালতে গেলে এমন ঘটনার কথা অহরহ শোনা যায়।
এই আদালত ভবনের চতুর্থ তলায় মোশাররফ নামের ওই মাছ ব্যবসায়ী বলছিলেন, ২০০ পিস ইয়াবা রাখার অভিযোগে আটকের পর আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেপ্তার না দেখিয়ে কীভাবে তাকে একটা খালি সেপটিক ট্যাংকের ভেতর প্রায় ৩৬ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়েছিল। কীভাবে তাকে পেটানো হয়েছিল।
ঘটনাটি ঘটে ২০১৫ সালের ৩০ জুন। তবে গতকালও তিনি শুনানির জন্য আদালতে হাজির ছিলেন। যে শুনানি তার গুম হওয়ার বিষয়টি প্রমাণের জন্য না। তিনি যে ২০০ পিস ইয়াবা বহন করছিলেন না, সেটা প্রমাণের জন্য।
মোশাররফ দাবি করেন, সকাল ১০টার দিকে ভাসানটেক থানার পুলিশ যখন তাকে তুলে নিয়ে যায়, তখন তিনি ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ভেতরে একটা পুকুরে মাছ ধরছিলেন।
এই মাছ ব্যবসায়ী বলেন, 'তারা (পুলিশ) আমাকে নির্মাণাধীন বিআরপি (ভাসানটেক পুনর্বাসন প্রকল্প) ভবনে নিয়ে সেপটিক ট্যাংকে নামতে বাধ্য করে। সেখানে আমি সারাদিন, সারারাত কাটাই। পরের দিন পুলিশের এক শিশু ইনফরমার আমার কাছে আসে। জানতে চায়, আমি কী খেতে চাই। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে তার কাছে কোনো মোবাইল ফোন আছে কিনা। সে বলল আছে।'
'আমি তখন তাকে একটা নাম্বারে কল করে লাউডস্পিকারে দিতে বলি। এভাবে আমি আমার স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জানাই যে, আমি কোথায় আছি।'- বলছিলেন মোশাররফ।
পরে মোশাররফের স্ত্রী ঘটনাটি এই পত্রিকার এক সাংবাদিককে জানান। যিনি বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করেন।
মোশাররফের দাবি, 'ঠিক ইফতারের আগে আগে তাকে ওই সেপটিক ট্যাংক থেকে বের করা হয়।'
যদিও মামলার এজাহারে পুলিশের সহকারী উপ-পরিদর্শক সোহেল মো. মহিউদ্দীন উল্লেখ করেন, ২০১৫ সালের ১ জুলাই সন্ধ্যা সোয়া সাতটার দিকে ধামালকোটের একটি ময়লার কনটেইনারের পাশ থেকে মোশাররফকে আটক করা হয়।
এজাহার অনুসারে, গোপন তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ জানতে পারে যে, মোশাররফ ইয়াবা কারবারে জড়িত। পরে পুলিশ তাকে খুঁজতে যায় এবং আটক করে।
মোশাররফকে যখন জিজ্ঞাসা করা হলো, সেপটিক ট্যাংকে আটকে রাখার জন্য কেন তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা করলেন না, তখন তাকে কিছুক্ষণের জন্য বিভ্রান্ত দেখায়। পাল্টা প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, 'আমি নয় মাস জেলে ছিলাম। জেল থেকে যখন বের হলাম, তখন মামলার জন্য কি খুব দেরি হয়ে যায়নি?
যদিও মোশাররফের আইনজীবী মোজাম্মেল হক বলেন, আদালতে মামলার শুনানিতে বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে।
২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে মিরপুর ১০ নম্বর বিহারি ক্যাম্প থেকে মো. আরমানকে তুলে নেওয়ার সময় তার মাথার পেছনে রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করা হয়।
এর চার দিন পর আরমান নিজেকে আবিষ্কার করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিছানায়। আরমান বলেন, 'জ্ঞান ফেরার পর আমি আমার পরিবারকে বিষয়টি জানাতে পারি। অথচ চার দিন ধরে তারা আমার খোঁজ করছিলেন।'
আরমানকে যেদিন গ্রেপ্তার দেখানো হয়, সেদিন কোনো একজনের বিরুদ্ধে দায়ের করা একটি মামলায় ওই ব্যক্তির বাবার নামের সঙ্গে আরমানের বাবার নামের মিল ছিল।
২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর উচ্চ আদালত আরমানকে আটক ও হেফাজতে রাখাকে অবৈধ ঘোষণা করেন। বিষয়টিকে তার মৌলিক ও মানবাধিকারের পরিপন্থী বলে অভিহিত করেন। তাকে দ্রুত মুক্তি দেওয়ার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। কিন্তু তার আগে জেলের ভেতরেই আরমানের পাঁচটি বছর ফুরিয়ে যায়।
পাঁচ বছরের কারাবাসের তুলনায় চার দিন ধরে একজন মানুষকে উন্মত্তের মতো খুঁজে বেড়ানোর বিষয়টা হয়তো কিছুই মনে হবে না। কিন্তু এটা পুনরাবৃত্তি করা অপরিহার্য যে, এটা আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। যে আইন বলছে, গ্রেপ্তারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আসামিকে আদালতে হাজির করতে হবে।
২০১৭ থেকে ১৯ সালের মধ্যে এমন ১২২টি গুমের ঘটনা (পরবর্তীতে যারা ফিরে এসেছিলেন) পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঘটনার শিকার বেশিরভাগ ব্যক্তি অন্তত দুই দিন নিখোঁজ ছিলেন। প্রায় সব ক্ষেত্রেই যাদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
গুমের ঘটনার তথ্যগুলো নেওয়া হয়েছে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত 'মায়ের ডাক' নামের একটি প্ল্যাটফর্মের কাছ থেকে। যারা ভিকটিমদের গ্রেপ্তার হওয়ার তারিখ ও ফিরে আসার তারিখগুলো নথিবদ্ধ করেছেন।
মানবাধিকার সংগঠন অধিকার গত বছরের এমন ৩১টি ঘটনা পর্যালোচনা করেছে। দেখা গেছে, এর মধ্যে ২২ জন জীবিত ফিরে এসেছেন। ছয়জনকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গেছে। আর তিন জনের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
এর আগের বছর এমন ৩৪টি ঘটনার মধ্যে ১৭ জন জীবিত ফিরেছিলেন। আর নয়জন চিরতরে নিখোঁজ হয়ে যান।
মানবাধিকার কর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক প্রধান নূর খান লিটন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, আইনে প্রদত্ত ২৪ ঘণ্টা সময়সীমার বাইরে কাউকে আটকে রাখাটা অপরাধ। কিন্তু গুমের ক্ষেত্রে এটা খুবই পরিচিত একটা ধরন। যেখানে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে উপস্থাপন করার আগে ভিকটিম কয়েক দিন, সপ্তাহ, এমনকি মাসব্যাপী নিখোঁজ থাকেন।'
লিটনের ভাষ্য, 'এখন পর্যন্ত কিশোরের আগে কেউ আদালতে নিখোঁজ থাকার এই ব্যাপারটি নিয়ে চ্যালেঞ্জ জানাননি। আসলে এই মানুষদের বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি যথেষ্ট আস্থা নেই, যে তারা নির্বিচারে আটক রাখার বিষয়টিকে চ্যালেঞ্জ জানাবেন।'
চলতি মাসে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ বিষয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে ২০১৬ সালের সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় মেনে চলার জন্য সুপারিশ করে। যে রায়ে আটকের ১২ ঘণ্টার মধ্যে আটককৃত ব্যক্তির পরিবারকে বিষয়টি অবহিত করা ও আইনজীবীর সহযোগিতা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) গতকাল এক বিজ্ঞপ্তিতে গুমসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানায়।
একইসঙ্গে গুম বন্ধের পাশাপাশি এর প্রতিটি অভিযোগ তদন্তের উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি দাবি জানায় সংগঠনটি।
পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনার বিচার নিশ্চিতে বিদ্যমান আইনের কাঠামোতে পরিবর্তন আনা এবং অপহরণ হিসেবে নয়, বরং গুমকে সুনির্দিষ্ট অপরাধ হিসেবে আইনে অন্তর্ভুক্ত করার দাবিও জানায় আসক।
প্রতিবেদনটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মামুনুর রশীদ।
Comments