‘১০-১২ ফুট ঢেউয়ের সঙ্গে আমরা পশ্চিমে ভেসে যেতে থাকলাম’

মাঝিমাল্লা
আকস্মিক ঝড়ের পর সাগর থেকে ঘরে ফেরা জেলেদের একাংশ। ছবি: সংগৃহীত

'বুধবার সন্ধ্যায় যখন ভোলার দুলারহাট লঞ্চঘাট থেকে রওনা দিলাম তখন প্রায় সন্ধ্যা। আমরা ১৫ জেলে ৪ ব্যারেল তেল, ১০০ ক্যান বরফ ও জাল নিয়ে ইলিশ ধরতে রওনা হলাম। তখন আকাশ বেশ পরিষ্কার ছিল।'

'সোনারচরের পূর্ব দিকে জাল পাতলেও কিছু পেলাম না। পরে আরও ৫ ঘণ্টা ট্রলার চালিয়ে কালকিনির চরের কাছে গিয়ে আবার জাল পাতি।'

'বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টায় যখন জাল টানি তখন প্রচণ্ড বাতাসে জাল পেঁচিয়ে যাচ্ছিল। অর্ধেক জাল সাগরে ভেসে যায়, বাকি অর্ধেক কোনো রকমে টেনে তুলি।'

গত বৃহস্পতিবার ঝড়ে দিক হারিয়ে ভারতীয় জলসীমায় ঢুকে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসে সেই ভয়ংকর সময়ের কথা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন আলী হোসেন। গত বুধবার তিনিসহ ১৫ জেলে মাছ ধরতে ট্রলার নিয়ে বের হয়েছিলেন।

আলী হোসেন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পূবের বাতাসে বোট ঠেলে পশ্চিম দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। প্রচণ্ড ঢেউ। ১০-১২ ফুট ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমরা পশ্চিমে দিকে ভেসে যেতে থাকলাম।'

'ভোর ৩টার দিকে দেখলাম একদল মানুষ সাগরে ভেসে যাচ্ছে। আমরা দ্রুত ৭ জনকে টেনে তুললাম। তাদের মধ্যে ২ জন বাংলায় কথা বলতে পারে। বাকি ৫ জনের ভাষা ভিন্ন। তারা জানালো যে সেটি ছিল ভারতীয় জলসীমা। কাছাকাছি শ্রীলঙ্কার জলসীমাও আছে।'

'প্রচণ্ড ঢেউয়ে তাদের বোট ডুবে যায়। উদ্ধারপ্রাপ্ত জেলেরা পরে একটি ভারতীয় বোটে করে চলে যায়।'

আলী হোসেন আরও বলেন, 'পরে ভারতীয় ফিশিং বোট থেকে ওয়ারলেসে আমাদের বোটটি যেন নিরাপদে বাংলাদেশের জলসীমায় ফিরে যেতে পারে সেই নির্দেশ দেয়। এরপর একটি বোট আমাদের সামনে এসে গার্ড দিয়ে বাংলাদেশের জলসীমার কাছাকাছি নিয়ে যায়।'

'আমরা গত রোববার সকাল ১০টায় বাংলাদেশের জলসীমায় ঢুকি। সেখানে ৩ দিন পর ভাত খাই। রাতে আমরা ট্রলার চালিয়ে ১৫ জনই ফিরে আসি নিজ গ্রামে।'

'বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় যখন সিগন্যাল পেলাম তখন অলরেডি বাতাস শুরু হয়ে গেছে। সেই বাতাসে আমাদের বোটটি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পশ্চিম দিকে চলতে লাগল।'

'২৬ লাখ টাকা দিয়ে বোট বানিয়েছি। এখানে আরও অন্তত ১০ লাখ টাকার সম্পদ ছিল। বোট বাঁচলেও তেল, বরফ ও জালের অর্ধেক ভেসে গেছে। তারপরও খুশি, অন্তত জীবন ফিরে পেয়েছি। নিজ ভিটায় ফিরে আসব আশাই ছিল না,' যোগ করেন আলী হোসেন।

এই বোটে থাকা অপর জেলে জসিম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাগরে আরও অন্তত ৩ বার ভয়ানক অবস্থা দেখলেও, এবারের মতো ঢেউ আর দেখিনি। আমার স্ত্রী ও ৪ সন্তানের মুখ বারবার মনে পড়ছিল।'

বোটে পর্যাপ্ত লাইফ জ্যাকেট ও বয়া ছিল না বলেও জানান তিনি।

৬৫ বছর বয়সী নাসির মাঝি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সাগরের এমন ভয়ঙ্কর রূপ আগে দেখিনি। শো শো বাতাসের সঙ্গে ১২-১৩ ফুটের একেকটি ঢেউ বোটকে প্রায় ডুবিয়ে দিচ্ছিল।'

স্থানীয় নীলকমল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. আলমগীর ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটি ছাড়াও পাশের নূরাবাদ ইউনিয়নের একটি বোট ঝড়ে পড়ে ১৭ মাঝিমাল্লা নিয়ে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের হলদিয়ায় পৌঁছেছিল। তাদের সঙ্গে কথা হয়েছে। বোটটি রোববার রাত সাড়ে ৮টায় দুলারহাট লঞ্চঘাটে এলে গ্রামবাসী তাদের দেখার জন্য ছুটে আসে। আগে তাদের নিখোঁজের সংবাদ পেলে পরিবার-স্বজনদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছিল।'

দুলারহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোরাদ হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গত ২০ আগস্ট ১৪ মাঝিমাল্লা নিখোঁজ আছে বলে জিডি করা হয়। পরে তাদের সবাই ফিরে আসেন।'

ভোলা, পাথরঘাটা, কুয়াকাটা অঞ্চলের শতাধিক ট্রলার গত বৃহস্পতিবার ঝড়ের সময় সাগরে থাকার পর অধিকাংশ ট্রলার ফিরে এলেও, বেশ কয়েকটি ট্রলারের অর্ধশত জেলে এখনো নিখোঁজ আছে বলে স্থানীয় জেলে সমিতি সূত্রে জানা গেছে।

Comments

The Daily Star  | English

Protests disrupt city life, again

Protests blocking major thoroughfares in Karwan Bazar and Shahbagh left the capital largely paralysed

1h ago