অংশীজনদের মতামত উপেক্ষা করেই প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের উদ্যোগ
সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল ১৯৭৪ সালের প্রেস কাউন্সিল আইনে কিছু সংশোধনের প্রস্তাব এনেছে, যার মাধ্যমে সাংবাদিকদের বড় অংকের জরিমানা করার সুযোগ তৈরি হবে। তবে কাউন্সিলের নথিতে দেখা যাচ্ছে, এই উদ্যোগ কাউন্সিল বোর্ডের সাংবাদিক সদস্যদের চিন্তাধারা পরিপন্থী।
গত জুনে এই আইন সংশোধন করে 'মিথ্যা সংবাদ প্রকাশের' অভিযোগে সাংবাদিকদের জরিমানা করার বিধান রাখার প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রীপরিষদ।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জুনে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর সাংবাদিকদের জানান, কাউন্সিল চাইলে 'রাষ্ট্রবিরোধী' সংবাদ প্রকাশের বিরুদ্ধে সুয়োমোটো ব্যবস্থা নিতে পারে।
প্রেস কাউন্সিল ১৯৭৪ সালের এই আইনের সংশোধিত খসড়া তথ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে পাঠায়।
এই সংশোধনীটি মন্ত্রিপরিষদের কাছে পাঠানোর আগে অংশীদারদের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। এমনকি এই আইনের অনুমোদনে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও এটি সম্পাদক ও সাংবাদিকদের কাছেও প্রকাশ করা হয়নি।
গতকাল সম্পাদক পরিষদের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, এ মাসে প্রস্তাবিত খসড়া আইনের একটি অনুলিপি চাওয়া হলেও, প্রেস কাউন্সিল এটি সরবরাহ করতে অস্বীকার করে। কারণ হিসেবে জানানো হয়, এটি মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ারভুক্ত। দ্য ডেইলি স্টারকেও কাউন্সিলের পক্ষ থেকে একই কারণ জানিয়ে সংশোধিত খসড়ার অনুলিপি দেওয়া হয়নি।
বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, কাউন্সিলের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে এবং তারা এই উদ্যোগে শুভকামনা জানিয়েছেন।
তিনি আরও জানান, ২০২১ সালের শেষের দিকে তার মেয়াদ শুরুর আগেই এই আলোচনা হয়েছে।
তবে ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের (২০২১ সালের প্রতিবেদন এখনো প্রকাশিত হয়নি) বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কাউন্সিল শাস্তি বাড়ানোর সংশোধন বিষয়ে বোর্ড সদস্যদের সঙ্গে মাত্র একবার আলোচনা করেছে এবং কোনো সদস্যই সুনির্দিষ্টভাবে এতে একমত প্রকাশ করেননি।
২০১৯ সালের ১৭ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বৈঠকের লিখিত তথ্যমতে, কাউন্সিলের সচিব শাহ আলম উপস্থিত সব সদস্যদের জানান, সংশোধিত প্রেস কাউন্সিল আইনের খসড়া মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। এরপর তিনি খসড়া আইনটি বৈঠকে উপস্থাপন করেন।
বোর্ড খসড়া আইন পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়, এর আরও নিরীক্ষার প্রয়োজন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, নিরীক্ষার পর আইনটি সংশোধন করা হবে।
এ ছাড়াও, নতুন প্রেস কাউন্সিল আইন তৈরি করা হবে, নাকি বর্তমানে প্রচলিত আইনটির সংশোধন করা হবে, সে বিষয়ে আলোচনা করতে একমত হয় কাউন্সিল।
তবে সাংবাদিক ও সম্পাদকরা জানিয়েছেন, এ ধরনের কোনো আলোচনা ছাড়াই প্রস্তাবিত সংশোধিত খসড়া আইন মন্ত্রিপরিষদের নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে।
অপরদিকে কাউন্সিলের ২০১৭ থেকে ২০২০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বোর্ড বেশ কয়েকটি বৈঠকে সাংবাদিকদের আরও সুরক্ষিত করার বিষয়ে আলোচনা করেছে। এমনকি ১৯৮০ সালের প্রেস কাউন্সিল রেগুলেশনের সংশোধিত খসড়াও একটি বৈঠকে চূড়ান্ত করা হয়েছিল।
সম্প্রতি বিচারপতি নাসিম দ্য ডেইলি স্টারকে নিশ্চিত করেন, এ বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি।
তিনি বলেন, 'আমরা এখনো এটা নিয়ে কাজ করছি। এখনো এ কাজ শেষ হয়নি।'
সাংবাদিকদের সুরক্ষা দেওয়া সংক্রান্ত সংশোধনীর বিষয়ে প্রথমবারের মতো আলোচনা হয় ২০১৭ সালের ২৮ মার্চ।
সেদিনের বৈঠকে বোর্ড আনুষ্ঠানিকভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, প্রেস কাউন্সিল রেগুলেশনের সংস্কার করা হবে যাতে সাংবাদিকদের হয়রানি, নির্যাতন ও দায়িত্ব পালনে বাঁধা সংক্রান্ত অভিযোগ গ্রহণ করা যায়।
কাউন্সিলের সাবেক চেয়ারপারসন বিচারপতি মোহাম্মদ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ এই বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন। সেদিনের বৈঠকে নেওয়া ৫ সিদ্ধান্তের মধ্যে এটাই ছিল প্রথম।
কাউন্সিলের বোর্ড সদস্য ও দৈনিক সমকালের সাবেক সম্পাদক প্রয়াত গোলাম সারোয়ার মন্তব্য করেছিলেন, 'সাংবাদিকদের তাদের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করার জন্য প্রেস কাউন্সিলকে কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। নিঃসন্দেহে এই উদ্যোগ প্রশংসার দাবিদার এবং এটি প্রেস কাউন্সিল রেগুলেশনে অন্তর্ভুক্ত করার যোগ্য।'
পরের মাসে আরেকটি বৈঠকে তারা আবারও রেগুলেশন সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেন এবং সংশোধনীর খসড়া চূড়ান্ত করেন।
বৈঠকে উপস্থাপন করা সংশোধনীগুলোর মধ্যে একটিতে বলা হয়, 'প্রকাশক, সম্পাদক ও কর্মরত সাংবাদিকরা যেকোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অথবা সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ আনতে পারবেন এবং কাউন্সিল সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে উপযুক্ত তদন্ত সাপেক্ষে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ জানাতে পারবে।'
এতে আরও বলা হয়, 'কোনো নির্দেশ বা ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ দেওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার সুযোগ দেওয়া হবে।'
আরেকটি সংশোধনীতে বলা হয়েছে, সাংবাদিকরা কাউন্সিলে সরকারি ও সরকারি নয় এরকম সংস্থা ও ব্যক্তির বিরুদ্ধে 'জনগণের স্বার্থ জড়িত আছে এরকম গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ সংগ্রহ ও প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপ এবং শারীরিক আঘাত ও হয়রানির' অভিযোগ আনতে পারেন। কাউন্সিল বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করবে এবং অভিযোগের সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হলে সে অনুযায়ী সরকারি বা সরকারি নয় এরকম সংস্থা অথবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করবে। পরবর্তীতে 'সুপারিশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে', এ বিষয়টি কাউন্সিলকে জানাতে হবে।
উভয় অপরাধের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের লঙ্ঘনের ঘটনা প্রেস কাউন্সিলের নজরে আসলে তারা সুয়োমোটো ব্যবস্থা নিতে পারবে। এ ছাড়াও, প্রেস কাউন্সিল 'ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বিষয়টির তদন্ত' করার জন্য কাউন্সিল সদস্য বা বিশেষজ্ঞদের দায়িত্ব দিতে পারবে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে ২০১৭ সালের রেগুলেশনে আনা সংশোধন মতে, কাউন্সিল অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত ও অপরাধীদের তিরস্কার করতে পারবে অথবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ জানাতে পারবে।
সংশোধনীতে বলা হয়, 'কাউন্সিলের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং এ বিষয়ে কোনো আদালত কোনো প্রশ্ন তুলতে পারবে না।'
এই বৈঠকটির সভাপতিত্ব করেন বিচারপতি মমতাজ উদ্দিন আহমেদ।
একই বছরের আগস্টে তারা আবারও বৈঠক করেন এবং আগে নেওয়া সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার বিষয়ে আলোচনা করেন।
বৈঠকে সাংবাদিক ও কাউন্সিলের বোর্ড সদস্য প্রয়াত রিয়াজ উদ্দীন আহমেদ বলেছিলেন, 'আমরা প্রেস কাউন্সিল রেগুলেশনে সংস্কার করার চেষ্টা চালাচ্ছি, যাতে গণমাধ্যম খাতে কর্মরত সাংবাদিকদের কোনো ধরনের হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হতে না হয় বা তারা যেন তাদের দায়িত্ব পালনে কোনো বাধার সম্মুখীন না হন।'
তবে পরবর্তী ৩ বছরের বৈঠক বিবেচনায়, এটাই এই বিষয়টি নিয়ে কাউন্সিলের শেষ আলোচনা।
গতকাল ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) প্রেস কাউন্সিল আইনের সংশোধিত খসড়া প্রকাশ ও অংশীদারদের সঙ্গে আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, 'আমরা দেখছি, প্রেস কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করতে বিদ্যমান আইনের সংশোধিত খসড়া প্রণয়নের উদ্যোগ বেশ কয়েক বছর ধরে চলমান রয়েছে। কিন্তু এ আইনের খসড়া অপ্রকাশিত রাখার পাশাপাশি অংশীজনকে, বিশেষ করে সম্পাদক পরিষদসহ বিভিন্ন সাংবাদিক সংগঠনকে প্রদানেও অপারগতা প্রকাশ করেছে প্রেস কাউন্সিল। আইনটির সঙ্গে সরাসরি গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমকর্মীদের স্বার্থ, স্বাধীনতা ও মুক্ত গণমাধ্যমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নীতি-নৈতিকতার বিষয়টি জড়িত। তাই এ সংশোধনের প্রতিটি ধাপে এই অংশীজনদের অবহিত করার পাশাপাশি মতামত গ্রহণের পর তা সমন্বয় করা আবশ্যক। এ অবস্থায় প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনীর খসড়া জনস্বার্থে প্রকাশের পাশাপাশি অংশীজনদের মতামত গ্রহণ দরকার।'
তিনি আরও বলেন, 'এ ক্ষেত্রে একটি যৌক্তিক প্রশ্ন আসে, যে সরকার প্রেস কাউন্সিলের মাধ্যমে গণমাধ্যমকে সুরক্ষা দেওয়ার পরিবর্তে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালাচ্ছে কিনা।'
অনুবাদ করেছেন মোহাম্মদ ইশতিয়াক খান
Comments