গুম-বিচারবহির্ভূত হত্যা তদন্তে স্বাধীন সংস্থা গঠনের প্রস্তাব মিশেল ব্যাচেলেটের
![মিশেল ব্যাচেলেট মিশেল ব্যাচেলেট](https://tds-images-bn.thedailystar.net/sites/default/files/styles/big_202/public/images/2022/08/17/220613182452-michelle-bachelet-file-super-tease.jpg?itok=XyLIgjP4×tamp=1660751457)
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতনের অভিযোগ থাকলেও, এসব বিষয়ে জবাবদিহিতার অভাব আছে বলে মন্তব্য করেছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট।
বাংলাদেশে ৪ দিনের সফরের শেষ দিন আজ বুধবার একটি বিবৃতি দেন ব্যাচেলেট। বিবৃতিতে এসব অভিযোগ তদন্তে একটি স্বাধীন বিশেষ সংস্থা গঠনের প্রস্তাব করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যার অভিযোগ আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'জাতিসংঘ কমিটি অ্যাগেইনস্ট টর্চারসহ জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক বিভিন্ন সংস্থা গত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে জোরপূর্বক গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। এসব অভিযোগের অনেকগুলোতেই র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নকে (র্যাব) দায়ী করা হয়েছে।'
'এসব ঘটনার জন্য জবাবদিহিতার অভাব আছে' উল্লেখ করে হাইকমিশনার বলেন, 'আমি সরকারের মন্ত্রীদের কাছে এই গুরুতর অভিযোগ সম্পর্কে আমার গভীর উদ্বেগ উত্থাপন করেছি। আমি এসব অভিযোগের বিষয়ে একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের প্রয়োজনীয়তার পাশাপাশি বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেছি।'
তিনি বলেন, 'নিয়মিতভাবে স্বল্প-মেয়াদে ও দীর্ঘমেয়াদে গুমের অভিযোগ আসছে এবং এসব ক্ষেত্রে যথাযথ প্রক্রিয়া ও আইনি নিরাপত্তার অভাব আছে, যা উদ্বেগজনক। বিশেষ করে তদন্তে অগ্রগতির অভাব এবং ন্যায়বিচার পেতে কিছু বাধা থাকায় এ বিষয়ে দীর্ঘস্থায়ী হতাশা তৈরি হয়েছে।'
এসব ঘটনা তদন্তে স্বাধীন ও বিশেষ একটি সংস্থা গঠনের প্রস্তাব রেখে মিশেল ব্যাচেলেট বলেন, 'আমি সরকারকে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ তদন্তে ভুক্তভোগী, তাদের পরিবার এবং সুশীল সমাজের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতে একটি স্বাধীন ও বিশেষ কৌশল অবলম্বন করতে উত্সাহিত করছি।'
'আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কীভাবে এ ধরনের সংস্থা গঠন করা যেতে পারে সে সম্পর্কে পরামর্শ দেওয়ার জন্য আমার অফিস প্রস্তুত,' বলেন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার।
তিনি আরও বলেন, 'এ বিষয়ে বাংলাদেশের কাজ করার সদিচ্ছার অঙ্গীকারের অন্যতম কৌশল হতে পারে জাতিসংঘের গুমবিষয়ক ওয়ার্কিং গ্রুপকে আমন্ত্রণ জানানো। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সর্বোচ্চ সেনা পাঠানো দেশ হিসেবে বাংলাদেশের উচিত, মানবাধিকার রক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে সতর্কভাবে নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মীদের বাছাই করা হয়, এমন একটি শক্তিশালী ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।'
হাইকমিশনার বলেন, 'মানবাধিকার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশের সংবিধান, আইন ও আন্তর্জাতিক অঙ্গীকার যথেষ্ট শক্তিশালী। বাংলাদেশ জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত সব চুক্তির একটি অংশীদার হলেও, ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব অল পারসন ফ্রম ফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্সের অংশীদার নয়। আমি বাংলাদেশ সরকারকে এই কনভেনশন অনুমোদনের আহ্বান জানিয়েছি।'
এছাড়া ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনের আলোচনা শুরু হয়েছে বলে জানান মিশেল ব্যাচেলেট।
তিনি বলেন, 'আমার কার্যালয় ও বাংলাদেশ সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের পর্যালোচনা নিয়ে আলোচনায় শুরু করেছে। আমি বিদ্বেষাত্মক মন্তব্য, বিভ্রান্তিকর তথ্য এবং সাইবার অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করতে আমি অনলাইন জগত নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করছি। যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ সবসময় স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের ঝুঁকি তৈরি করে বলে এসব উদ্বেগ মোকাবিলা করা সহজ নয়।'
'আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন এবং মানদণ্ড নিশ্চিত করতে এবং নির্বিচারে এই আইনের প্রয়োগ বা অপব্যবহার রোধ করতে আমরা এর কিছু ধারা বাতিল ও সংশোধনের সুপারিশ করেছি। আমরা পর্যালোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের জবাবের অপেক্ষা করছি,' যোগ করেন তিনি।
এছাড়া নতুন ডেটা সুরক্ষা আইন এবং ওটিটি আইনে মানবাধিকার নিশ্চিত করে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নিশ্চিত করতে সুশীল সমাজ ও জাতিসংঘের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার গুরুত্ব নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
চ্যালেঞ্জকে স্বীকার করে নেওয়াই একে অতিক্রম করার প্রথম পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করেন হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেট।
সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুশীল সমাজে দক্ষ ব্যাক্তিরা আছেন। কিন্তু জাতিসংঘের পরপর কয়েকটি মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশে নাগরিকদের কথা বলার স্থান সংকীর্ণ হয়ে আসা, নজরদারি বাড়ানো, ভয়ভীতির তথ্য পাওয়া গেছে যেখানে জনগণকে নিজেকেই নিজের সেন্সর করতে হয়।'
'বেসরকারি সংস্থাগুলো নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন আইন ও বিধিবিধান মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ব্যাপকভাবে সীমিত করে এবং তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করাকে কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে,' বলেন তিনি।
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের সময়টি বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে হাইকমিশনার বলেন, 'মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক কর্মী, মানবাধিকার কর্মী, বিরোধী দল এবং সাংবাদিকদের শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করাসহ নির্বাচনের সময়টি বাংলাদেশের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনো বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ সামলাতে গিয়ে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা যেন অতিরিক্ত শক্তি প্রয়োগ না করে সেটার জন্যও প্রশিক্ষণ প্রয়োজন আছে।'
'সামাজিক বিশৃঙ্খলা প্রতিরোধে রাজনৈতিক দল এবং সুশীল সমাজের জন্য আলোচনার জায়গা আরও উন্মুক্ত থাকা দরকার,' যোগ করেন তিনি।
Comments