‘আপনাদের মধ্যে হাইকমান্ড কে’ প্রশ্ন করতেই ব্রাশফায়ার

রফিকুল ইসলাম
রফিকুল ইসলাম। ছবি: টিটু দাস/স্টার

'আমি তখন সবেমাত্র কলেজে উঠেছি। আজম খানের গানের খুব জোয়ার ছিল তখন। আমরাও বন্ধুরা মিলে ব্যান্ডদল গঠন করলাম। নাম দিলাম "ক্রিডেন্স ব্যান্ড"। গাইতাম পপসম্রাট আজম খানের গান। গাইতাম বরিশালের আঞ্চলিক গানও।'

'১৯৭৩ সালে গঠিত এটিই ছিল স্বাধীনতার পর বরিশালের প্রথম ব্যান্ডদল। ব্যান্ডের সভাপতি ছিলেন তৎকালীন মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বড় ছেলে তৎকালীন পৌর চেয়ারম্যান ও বর্তমান মন্ত্রী আবুল হাসনাত আবদুল্লাহ'—বলছিলেন "ক্রিডেন্স" ব্যান্ডের অন্যতম সদস্য রফিকুল ইসলাম।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট গভীর রাতে তৎকালীন মন্ত্রিসভার সদস্য আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ঘটনার ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের একজন তিনি।

ওই রাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৮ দিন চিকিৎসাধীন ছিলেন। তবে বাম পা হারাতে হয় তাকে। বর্তমানে একটি ওষুধের দোকান চালান তিনি।

রফিকুল ইসলাম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'প্রথম দিকে আমি, জিল্লুর, টুটুল, জন মাইকেল, রিন্টু, আলমগীর কায়সার ছিলাম ব্যান্ডে। পরে ললিত দাস, মুকুল দাস, গোলাম মাহবুব, দিলীপ ঘোষ ও তপন যোগ দেন।'

'জিল্লুর ও টুটুল গান গাইতেন, জন মাইকেল গিটার বাজাতেন, ড্রাম বাজাতেন ললিত দাস, সুবীর গিটার ও কি-বোর্ড বাজাতেন। আমাদের আঞ্চলিক গান "মোরা হগল বরিশাইলা" তখন খুব জনপ্রিয় ছিল,' বলেন তিনি।

রফিকুল ইসলাম জানান, ১৯৭৩ সালে এক অনুষ্ঠানে তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী মো. কামরুজ্জামান বরিশাল গেলে, তাকে নাগরিক সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ওই অনুষ্ঠানে "ক্রিডেন্স" ব্যান্ডদল গান গায়।

গান শুনে খুশি হয়ে মন্ত্রী কামরুজ্জামান ব্যান্ডটিকে ঢাকায় তার বাসায় আমন্ত্রণ জানান।

অবশেষে, ৭৫ সালের আগস্টে তাদের ঢাকায় যাওয়ার সেই সুযোগটি আসে।

রফিকুল বলেন, '১৯৭৫ সালের ১২ আগস্ট আবুল হাসনাত আবদুল্লাহর সহযোগিতায় আমরা ১০ সদস্য গাজী রকেটে চেপে দিনের বেলা রওনা হয়ে সন্ধ্যায় ঢাকায় পৌঁছাই। মিটফোর্ড এলাকায় হোটেলে উঠি। পরদিন মিন্টু রোডে মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাসায় যাই। বিকেলে সেখানে মিলাদ ছিল। তখন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ও শেখ রাসেলকে দেখেছিলাম।'

'এক রাত ওই বাসায় থাকার পর ১৪ আগস্ট রাত ৯টা থেকে ১১টা পর্যন্ত মন্ত্রী কামরুজ্জামান সাহেবের ধানমন্ডির বাড়িতে অনুষ্ঠানে অংশ নেই। অনুষ্ঠান খুব ভালো হয়েছিল। সবাই খুব প্রশংসা করেছিলেন। মন্ত্রী নিজে আমাদের হাতে চেক তুলে দিলেন। সব মিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার টাকার চেক পেয়েছিলাম।'

অবশ্য সেই চেক আর কোনো দিনই নগদ করা সম্ভব হয়নি বলে জানান ব্যান্ডদল ক্রিডেন্সের সদস্য রফিকুল।

রাত সাড়ে ১১টার দিকে তারা আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে ফিরে যান উল্লেখ করে রফিকুল বলেন, 'খুব ক্লান্ত ছিলাম। রাত ১টার দিকে মন্ত্রী আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়ির নিচতলার লনে ঘুমিয়ে পড়ি। হঠাৎ গুলির শব্দে ঘুম ভাঙে। তখন আনুমানিক সময় ভোর সাড়ে ৪টা থেকে ৫টা।'

'প্রচণ্ড চিৎকার চেঁচামেচি। আমরা প্রথমে ভেবেছিলাম ডাকাত এসেছে বুঝি,' যোগ করেন তিনি।

'গোলাগুলি শুরু হয়। বাড়ির গার্ডরা গুলি করলে তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কিছু বোঝার আগেই দরজা ভেঙে কালো পোশাক পড়া একদল অস্ত্রধারী ঘরে ঢুকে পড়ে। তারা আমাদের মারতে মারতে ড্রয়িংরুমে নিয়ে যায়। সেখানে গিয়ে দেখি আবদুর রব সেরনিয়াবাতসহ পরিবারের প্রায় সব সদস্যকে নিয়ে আসা হয়েছে,' বলছিলেন রফিকুল।

তিনি আরও বলেন, 'কালো পোশাকধারীরা আমাদের এক লাইনে দাঁড়াতে বলে। তখন মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত সাহেব তাদের জিজ্ঞেস করেন, "আপনাদের মধ্যে হাইকমান্ড কে?" কথা শেষ না হতেই এসএমজি থেকে ব্রাশফায়ার। লুটিয়ে পড়লেন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত।'

'আবুল হাসনাত সাহেবের বড় ছেলে সুকান্ত বাবুকেও মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যেতে দেখলাম। আমার পাশেই ছিলেন বেবি সেরনিয়াবাত। তিনিও পড়ে গেলেন।'

'আবার ব্রাশফায়ার। কিছু বোঝার আগেই আমার শরীর অনুভূতিহীন হয়ে যেতে লাগল। কোমরে হাত দিয়ে দেখলাম গরম রক্ত। নিশ্চিত ছিলাম মারা যাচ্ছি।'

তিনি জানান, অস্ত্রধারীরা চলে গেলে রমনা থানা থেকে ওই বাড়িতে কয়েকটি পিকআপ ভ্যান আসে। সে সময় আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ নিচে নেমে আসেন। তার মা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বোন আমেনা বেগমও আহত হয়েছিলেন।

সে সময় পুলিশ সদস্যরা সেখানে এসে গুরুতর আহতদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় রফিকুলকেও।

'হাসপাতালে নেওয়ার পর দীর্ঘ ৩৬ ঘণ্টা আমি সংজ্ঞাহীন ছিলাম। পরে শুনেছি আরিফ সেরনিবাত, শহীদ সেরনিবাত ও হাসপাতালে আমাদের ব্যান্ড সদস্য আব্দুর নইম খান রিন্টু মারা গেছেন,' বলেন তিনি।

'ডাক্তাররা আমার অপারেশন করেন। কিন্তু, গুলি পান নাই, গুলি শরীর ভেদ করে বেরিয়ে গিয়েছিল। স্পাইনাল কর্ড ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায়, আমার বাম পা শুকিয়ে যেতে শুরু করে। এর ফলে আমি স্বাভাবিক হাঁটাচলার ক্ষমতা হারাই,' বলেন রফিকুল।

তিনি আরও জানান, হাসপাতালে সে সময় চিকিৎসক সংকট ছিল। যারা ছিলেন তারা এক ধরনের ভীতিকর পরিবেশেই তাদের চিকিৎসা করেন, সেবা দেন।

প্রতি রাতেই হাসপাতালে ছোটভাই আব্দুর নইম খান রিন্টুকে দেখতে যেতেন অপসোনিন গ্রুপের বর্তমান এমডি ক্যাপ্টেন (অব.) আব্দুস সবুর খান।

আপ্রাণ চেষ্টা করেও রিন্টুকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।

রফিকুল বলেন, 'আমি প্রথমে হাঁটতে পারতাম না। পরে একটি জুতো ব্যবহার করতাম। পরে সবুর খান সাহেবের প্রচেষ্টায় ভারতে গিয়ে চিকিৎসা নিই। কিন্তু, সেখানেও চিকিৎসকরা জানান যে, আমার পা আর ভালো হবে না।'

'প্রতি বছরই ১৫ আগস্ট আসে। ওই রাতে কিন্তু আমিও যে নৃশংস হামলার শিকার হয়েছিলাম, সে খোঁজ কেউ রাখেন না। কেউ জানতেও চান না। শুধু একবার প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে আমাকে ও জিল্লুরকে ২০ লাখ টাকার আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছিল।'

তিনি বলেন, 'আমরা চাই এই নির্মম ঘটনায় যারা ভুক্তভোগী তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হোক। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের সবাইকে চিহ্নিত করে বিচার করা হোক। কীভাবে একটি সাংস্কৃতিক দলের ওপর তারা নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালাতে পারে?'

'আমাদের ব্যান্ডদলটি এখনো আছে। তবে ওই ঘটনার পর আর আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারিনি,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Interest payments, subsidies soak up almost half of budget

Interest payments and subsidies have absorbed nearly half of Bangladesh’s total budget expenditure in the first seven months of the current fiscal year, underscoring growing fiscal stress and raising concerns over public finances.

3h ago