জাতীয় নির্বাচন: ‘বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে’ সম্ভাব্য প্রার্থীদের তথ্য সংগ্রহ করছে পুলিশ

আসন্ন জাতীয় নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সহিংসতামুক্ত রাখতে দেশব্যাপী সম্ভাব্য প্রার্থীদের তথ্য সংগ্রহ শুরু করেছে পুলিশ সদর দপ্তর।
গত সপ্তাহ থেকে এই তথ্য সংগ্রহ শুরু হয়েছে এবং সব থানাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, সম্ভাব্য প্রত্যেক প্রার্থীর ১১টি প্রধান বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য সংগ্রহ করে প্রতিবেদন জমা দিতে—এর মধ্যে রয়েছে অপরাধমূলক কার্যক্রম, পুলিশের রেকর্ড ও সহিংসতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির সম্ভাবনা।
প্রাপ্ত এসব তথ্যের ভিত্তিতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো প্রতিটি আসনে নিরাপত্তার চাহিদা মূল্যায়ন করবে এবং নিরাপত্তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ প্রার্থীদের চিহ্নিত করবে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, 'বিভিন্ন সংস্থার নজরদারিতে অসামঞ্জস্য' থাকলে পুলিশের এই উদ্যোগের অপব্যবহারও হতে পারে।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'নির্বাচনে নিরাপত্তার কৌশল নির্ধারণ করার জন্য এসব তথ্য সংগ্রহ করছি। এর মাধ্যমে আমরা এমন এলাকা চিহ্নিত করতে পারব, যেখানে বাড়তি নিরাপত্তা দরকার এবং কোন প্রার্থী বা কোন প্রার্থীর সমর্থকরা সহিংসতা উসকে দিতে পারে সেটাও মূল্যায়ন করতে পারব।'
এই উদ্যোগকে অত্যন্ত জরুরি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'এর লক্ষ্য হলো, সহিংসতা বা অনিয়ম হওয়ার আগেই তা প্রতিরোধ করা।'
দেশের প্রতিটি থানায় পাঠানো এক চিঠিতে পুলিশ সদর দপ্তর নির্দেশ দিয়েছে একটি টেবিল ফরমেটে তথ্য জমা দিতে। দ্য ডেইলি স্টারের হাতে থাকা চিঠির একটি অনুলিপি থেকে দেখা গেছে, সেখানে প্রতিটি প্রার্থীর দলীয় পরিচয়, রাজনৈতিক অবস্থান, অপরাধ ও পুলিশ রেকর্ড, শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অন্যান্য পরিচিতি সম্পর্কে তথ্য নিতে বলা হয়েছে।
এতে আরও বলা হয়েছে, সম্ভাব্য প্রার্থীদের পিতা-মাতার নাম, ঠিকানা, মোবাইল নম্বর ও জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর যাচাই করে সেগুলোও অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
পুলিশ সূত্র জানায়, তাদের এই কার্যক্রম নির্বাচনের দিন পর্যন্ত চলবে। সেখানে শুধু প্রার্থীদের নয়, তাদের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও দলীয় কর্মীদেরও তথ্যও সংগ্রহ করা হবে।
প্রতিটি থানার স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) মাধ্যমে সংকলিত এসব তথ্য পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হচ্ছে। এসব তথ্যের ভিত্তিতেই আসনভিত্তিক নিরাপত্তা পরিকল্পনা করা হবে। যেমন: কোন এলাকায় অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন প্রয়োজন, কোথায় মোবাইল টহল বাড়ানো দরকার, কোথায় পুলিশ বা র্যাবের উপস্থিতি বৃদ্ধি করা দরকার।
এমনকি, প্রার্থীদের জন্য বাড়তি নিরাপত্তা প্রয়োজন হলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতেও এই তথ্য সহায়তা করবে।
ঢাকা জেলার পুলিশের অন্তর্গত একটি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'বিষয়টি নিয়ে কাজ করতে একটি গোপন সেল গঠন করা হয়েছে। আমরা দিন পাঁচেক আগে আসন্ন নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের একটি তালিকা পেয়েছি। এখন নির্দেশনা অনুযায়ী তদন্ত ও তথ্য যাচাই করছি।'
দ্য ডেইলি স্টারের সঙ্গে আলাপকালে অন্তত ছয়জন ওসি এই কার্যক্রমের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য করতে রাজি হননি। তাদের ভাষ্য, বিষয়টি 'অত্যন্ত গোপনীয় ও স্পর্শকাতর'।
গতকাল শনিবার পুরান ঢাকার মিল ব্যারাকে ঢাকা জেলা পুলিশ লাইনস এবং ট্রাফিক ও ড্রাইভিং স্কুল পরিদর্শনের পর পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম জানান, পুলিশ তাদের তালিকা প্রস্তুত করছে, যারা এলাকাভিত্তিক আধিপত্য বিস্তার করছে, বিশেষ করে ঢাকায়।
তিনি বলেন, 'সামগ্রিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নত করতে রাজনৈতিক দলগুলোরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এ বিষয়ে তাদের সহযোগিতা অত্যাবশ্যক।'
দ্য ডেইলি স্টারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, 'এটা যদি নিয়মিত কাজের অংশ হয়, তাহলে ঠিক আছে। কিন্তু এর পেছনে যদি কোনো অসৎ উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে সেটা উদ্বেগের কারণ।'
এই কার্যক্রম বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, 'নির্বাচন শান্তিপূর্ণ করতে হলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিতেই হবে। কিন্তু, এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ থাকতেই পারে। কারণ, এর ফলে কার্যত প্রার্থীদের ওপর নজরদারি করা হবে। এর অপব্যবহার ঠেকাতে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ব্যবস্থা নিতে হবে।'
তিনি বলেন, 'প্রার্থীদের তথ্য শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের কাছে থাকা উচিত। কোনো প্রার্থী কোনো ভুল করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার বিধান রয়েছে। কিন্তু যদি বিভিন্ন সংস্থা সমন্বয় ছাড়াই তথ্য সংগ্রহ করে, তাহলে এগুলো অপব্যবহারের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।'
পুলিশের নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রশিক্ষণ
আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে পুলিশ সদর দপ্তর সারা দেশের পুলিশ সদস্যদের জন্য প্রথমবারের মতো প্রশিক্ষণ কর্মসূচি শুরু করেছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, এই প্রশিক্ষণ নির্বাচনী প্রস্তুতির অংশ।
তিনি বলেন, 'নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন, আমরা না। কিন্তু, আমরা ডিসেম্বরের মধ্যেই সব প্রস্তুতি শেষ করতে চাই।'
পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক এনামুল হক সাগর বলেন, 'প্রথমে ঢাকার কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এরপর ধাপে ধাপে অন্যান্য জেলায় প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করা হবে।'
Comments