সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমন্বিত প্রচারণায় আ. লীগ, পিছিয়ে বিএনপি
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রচারণায় একটি সমন্বিত কৌশল ব্যবহার করছে। প্রোফাইল, গ্রুপ ও পেজগুলো সমন্বয়ের মাধ্যমে ফেসবুকে নানা তথ্য প্রকাশ করছে এই রাজনৈতিক দলটি।
কিন্তু এসব প্রোফাইল, গ্রুপ ও পেজের ৮০ শতাংশেই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা দেওয়া হয়নি।
আওয়ামী লীগের তথ্য শেয়ার করে এমন মাত্র ১৯ শতাংশ পেজ, ভেরিফায়েড প্রোফাইল ও গ্রুপের নামের সঙ্গে 'আওয়ামী লীগ' শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। বিএনপির ক্ষেত্রে এর হার ৬৪ শতাংশ।
গতকাল বৃহস্পতিবার টেকগ্লোবাল ইন্সটিটিউটের (টিজিআই) প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম, 'যেভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক যুদ্ধক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে ফেসবুক'।
রাজনৈতিক দলগুলোর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই নেটওয়ার্ককে 'অত্যন্ত জটিল' বলে অভিহিত করেছে টিজিআই।
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, 'আওয়ামী লীগের কনটেন্ট প্রায়ই ফেসবুকের বিভিন্ন পেজে ও গ্রুপে শেয়ার করা হয়। কিন্তু এসব গ্রুপ বা পেজের নামের সঙ্গে দলটির ঐতিহ্য বা রাজনৈতিক মতাদর্শের কোনো সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া যায় না।'
প্রতিবেদন তৈরিতে প্রায় পাঁচ লাখ ফেসবুক পোস্ট বিশ্লেষণ করা হয়েছে, যেগুলো ১ কোটি ৪৪ লাখ ফলোয়ারদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এসব পোস্টে ৯ কোটি ৭৫ লাখ 'ইন্টার্যাকশন' হয়েছে। পাশাপাশি প্রায় ৬০০ ফেসবুক পেজ ও গ্রুপের আচরণ যাচাই করেছে, যেগুলো সম্ভবত আওয়ামী লীগ অথবা বিএনপি সংশ্লিষ্ট।
প্রতিবেদনে বলা হয়, 'দলের নাম নেই বা দল-সংশ্লিষ্টতা উল্লেখ করে না এমন গ্রুপ বা পেজ থেকে প্রায়ই পক্ষপাতমূলক কনটেন্ট শেয়ার করা হয়। উদাহরণ হিসেবে "শুভ সকাল বাংলাদেশ" বা "আমাদের ঢাকা"—এ ধরনের নামের গ্রুপ বা পেজের কথা বলা যায়। এসব গ্রুপ বা পেজ নিয়ন্ত্রণকারী প্রকৃতপক্ষে কোনো একটি রাজনৈতিক দলের পক্ষে থাকলেও নিজেদের নিরপেক্ষ দাবি করে ব্যবহারকারীদের বিভ্রান্ত করেন এবং অত্যন্ত পক্ষপাতমূলক কনটেন্ট শেয়ার করেন।'
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, এ ধরনের গ্রুপ অথবা পেজের পক্ষপাতমূলক কনটেন্ট দীর্ঘ মেয়াদে জনমতের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
এই প্রতিবেদনে দীর্ঘমেয়াদে বিএনপি সমর্থিত ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত পোস্টের প্রভাবের তুলনা করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারসাজির প্রমাণ দেখানো হয়েছে।
বলা হয়েছে, 'প্রথম পাঁচ মিনিটের মধ্যে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পোস্টগুলো তাদের মোট শেয়ারের এক শতাংশ পায়। পরবর্তী ১০ মিনিটের মধ্যে বিএনপির পোস্টটি কেউ শেয়ার না করলেও আওয়ামী লীগের পোস্টটি এর মোট শেয়ারের ২৫ শতাংশ পায়।
'তিন ঘণ্টার ব্যবধানে আওয়ামী লীগের পোস্টের ৭১ শতাংশ শেয়ার হয়। এই সময়ের মাঝে বিএনপির পোস্টের একটিও শেয়ার ছিল না।'
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, 'তিন থেকে ১২ ঘণ্টার মধ্যে বিএনপির দেওয়া পোস্ট এর মোট শেয়ারের ৬৮ শতাংশ পায়। এ সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগের পোস্টে আরও ১৮ শতাংশ শেয়ার যোগ হয়।
যদিও প্রথম ও তৃতীয় দিনের মধ্যে বিএনপির পোস্টের শেয়ারের পরিমাণ আরও ২০ শতাংশ বাড়ে। আর আওয়ামী লীগেরটা বাড়ে চার শতাংশ।
প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, বিএনপির তুলনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আওয়ামী লীগের কনটেন্ট ছড়িয়ে দেওয়ার কৌশল অনেকটাই কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। অর্থাৎ, দলটির বেশিরভাগ কনটেন্ট অল্প কয়েকটি মাধ্যম থেকে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। অপরদিকে, বিএনপির কৌশল ভিন্ন। খুব সম্ভবত তাদের সমর্থকরাই তাদের কনটেন্টের অরগ্যানিক রিচ বাড়াতে সহায়তা করে।
আওয়ামী লীগের ভেরিফায়েড পেজে রয়েছে ৩৪ লাখ ফলোয়ার। টিজিআই'র বিশ্লেষণ চলাকালীন এই পেজ থেকে তৃতীয় পক্ষের লিংক বাদে নয় হাজার ৫০০ কনটেন্ট শেয়ার করা হয়েছে। দলটি দিনের মধ্যে প্রতি ঘণ্টায় অন্তত একটি করে কনটেন্ট শেয়ার করেছে। প্রতিবেদন অনুসারে, আওয়ামী লীগ গত এক বছরে দৈনিক অন্তত ২৫টি করে কনটেন্ট ওই ভেরিফায়েড পেজ থেকে শেয়ার করেছে।
আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে মূল পোস্ট আসার ১৩ দিনের মধ্যে ৯১টি মাধ্যম (ব্যবহারকারী, পেজ বা পাবলিক গ্রুপ) একই কনটেন্ট অন্তত এক বার করে শেয়ার করেছে। বিপরীতে বিএনপির ক্ষেত্রে এমন মাধ্যমের সংখ্যা ৫০।
প্রতিবেদন অনুসারে, আওয়ামী লীগ ২০১৩ সালে আনুষ্ঠানিক ও ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ চালু করে। এর দীর্ঘদিন পর ২০১৯ সালে বিএনপি তাদের পেজ চালু করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও, অনানুষ্ঠানিক ইনফ্লুয়েনসারদের উদ্যোগে ততদিনে ফেসবুকে বিরোধী দলের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
প্রতিবেদনে জানানো হয়, ৭ জানুয়ারির নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের উপস্থিতি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
'জুলাইয়ে বিএনপির পেজগুলোতে প্রায় সাড়ে চার হাজার পোস্ট করা হয়, যা এর আগের মাসের তিন হাজারের তুলনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। সেপ্টেম্বরে এই পেজগুলোতে প্রায় চার হাজার পোস্ট করা হলেও নভেম্বরে প্রায় তিন গুণ হয়ে সংখ্যাটি দাঁড়ায় ১১ হাজারে।'
প্রতিবেদনে বলা হয়, 'কোনো একটি রাজনৈতিক দলের নামযুক্ত পেজ বা গ্রুপগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে সেই দল সংশ্লিষ্ট কি না, পেশাদারিভাবে সেটা পরিচালিত হয় কি না, অথবা দলের অর্থায়নে পরিচালিত হয় কি না, সেটা অনলাইন নীতিনির্ধারকরা জানতে পারে না।
'ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটার নীতিমালা অনুযায়ী পেজ বা গ্রুপগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে তারা কোনো রাজনৈতিক দল সংশ্লিষ্ট কি না, সেটা প্রকাশ করতে হয়। আর এই নীতিমালাগুলো আনুষ্ঠানিক পেজ-গ্রুপের বিপরীতে দলের অর্থায়নে বা পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত অনানুষ্ঠানিক পেজ-গ্রুপকে আলাদা করে চিহ্নিত করার জন্য যথেষ্ট নয়।'
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, 'মানুষ কোনো একটি পেজ ফলো করে অথবা গ্রুপে যোগ দেয়, কিন্তু তারা জানতে পারে না সেই গ্রুপ-পেজ কোনো পক্ষসংশ্লিষ্ট কি না; বিশেষ করে যখন কোনো রাজনৈতিক দল তাদের বার্তা ছড়িয়ে দিতে নিরপেক্ষ কোনো নাম ব্যবহার করে।'
টিজিআই'র সুপারিশ, 'যখন কোনো গ্রুপ, পেজ বা ভেরিফায়েড প্রোফাইল থেকে রাজনৈতিক পক্ষপাত সম্বলিত কনটেন্ট শেয়ার করা হয়, তখন এগুলোর উচিত সেই দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি নিয়ে স্বচ্ছ থাকা। বিশেষত, যখন এই গ্রুপ বা পেজগুলো সুনির্দিষ্টভাবে দলের নামটি উল্লেখ করে না। দ্বিতীয়ত, রাজনৈতিক দলের নাম সম্বলিত পেজ বা গ্রুপগুলোকে অবশ্যই ভেরিফিকেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, যাতে অন্য কোনো পেজ বা প্রোফাইল এগুলোর চেহারা ধারণ করতে না পারে, কিংবা ব্যবহারকারীদের বিভ্রান্ত করতে না পারে।'
Comments