আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহী রাজনৈতিক দলগুলোতে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টি তাদের মনোনীত প্রার্থীদের তালিকা ঘোষণা করেছে এবং সেখানে জায়গা পেয়েছেন বেশ কয়েকজন তারকাও।
সাকিব আল হাসান, ফেরদৌস আহমেদ, আসাদুজ্জামান নূর, মমতাজ বেগম, মাশরাফি বিন মুর্তজা এবং আবদুস সালাম মুর্শেদী রাজনীতির বাইরে তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে কাজের জন্য বিখ্যাত।
এই নির্বাচন সাকিব ও ফেরদৌসের জন্য প্রথম হলেও বাকিরা ইতোমধ্যে অন্তত এক মেয়াদে সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
প্রশ্ন আসে, অতীতে কী তারকারা আইনপ্রণেতা হিসেবে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে তাদের খ্যাতি কাজে লাগাতে পেরেছেন?
বাংলাদেশে খ্যাতিমান তারকা থেকে রাজনীতিবিদ হয়ে ওঠা ব্যক্তিদের মধ্যে সংসদ সদস্য হিসেবে আসাদুজ্জামান নূর সবচেয়ে অভিজ্ঞ। নীলফামারী-২ আসন থেকে টানা চারবার সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে পঞ্চমবারের মতো নির্বাচন করবেন।
২০১৩ সালে জাতীয় নির্বাচনের আগে তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় হামলার ঘটনা ঘটে এবং এ ঘটনায় পাঁচজন নিহত হন। এরপর থেকে রাজনীতিবিদ হিসেবেই থিতু হয়েছেন তিনি। ২০১৪ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তিনি সাংস্কৃতিক বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রীসভাতেও জায়গা করে নিয়েছিলেন।
সঙ্গীতশিল্পী মমতাজ বেগম আগামী নির্বাচনে টানা তৃতীয়বারের মতো সংসদ সদস্য হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে যাচ্ছেন। তিনি নবম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে দায়িত্ব পালন করেন এবং এরপর ২০১৪ সাল থেকে মানিকগঞ্জ-২ আসনের টানা দুইবারের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশের অন্যতম বিখ্যাত লোকশিল্পী মমতাজ বেগম বিভিন্ন সময়ে জাতীয় সংসদে গান গেয়ে শিরোনাম হয়েছেন। এই বছর তিনি বাজেট বিতর্কের সময় দুটি গান গেয়েছেন এবং ২০১৪ সালে তৎকালীন স্পিকার তার জন্য বরাদ্দকৃত সময়ও বাড়িয়েছিলেন, যাতে তিনি প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতাকে নিয়ে তার দুটি গান গেয়ে শেষ করতে পারেন।
নিজ এলাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মমতাজ বেগম দাবি করেছেন যে তিনি সংসদ সদস্য থাকাকালীন তার নির্বাচনী এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগের হার ৩০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০০ শতাংশ করেছেন।
২০১৮ সালের নির্বাচনে নড়াইল-২ আসন থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য মাশরাফি বিন মুর্তজা সম্ভবত বাংলাদেশের সবচেয়ে নন্দিত ক্রিকেট অধিনায়ক। ২০১৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপের আগে তিনি এই নির্বাচনে অংশ নেন এবং ওই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল এবং অধিনায়ক হিসেবে তিনি নিজে খারাপ পারফরম্যান্স করেন। এরপর থেকেই তার ক্রিকেট ক্যারিয়ার স্থবির হয়ে পড়ে। তবে সংসদ সদস্য হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য।
বর্তমান ক্রিকেটারদের মধ্যে নানা সময়ে বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য সক্রিয় ভূমিকা পালন করেও মাশরাফি খবরে থেকেছেন।
এবারের বিশ্বকাপের আগে তামিম ইকবালের অবসরের ঘোষণা দেওয়ার পর তামিম ইকবাল ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। প্রধানমন্ত্রী তামিমকে অবসর নেওয়ার ঘোষণা প্রত্যাহার করতে এবং খেলা চালিয়ে যেতে রাজি করান।
আবদুস সালাম মুর্শেদী বাংলাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ফুটবল তারকাদের তালিকায় শীর্ষে রয়েছেন। অবসর গ্রহণের পর থেকে তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) ও তৈরি পোশাক শিল্পখাতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব এবং বিজিএমইএর সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি একটি বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালকের দায়িত্বেও রয়েছেন। ২০১৮ সালে তিনি খুলনা-৪ আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।
সম্প্রতি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্ত কমিটি জানতে পারে যে তিনি গুলশানে অবৈধভাবে একটি বাড়ি দখল করে রেখেছেন। এ নিয়ে তিনি আলোচনায় আসেন।
আরেকটু অতীতে তাকালে আরও অনেক বিখ্যাত তারকার নাম দেখা যায় রাজনীতির মাঠে। কিংবদন্তি চলচ্চিত্র অভিনেতা কবরী সারোয়ার নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য হয়েছিলেন এবং তিনি মাত্র একটি মেয়াদে দায়িত্ব পালন করেন। রূপালী পর্দায় তার সমসাময়িকদের একজন আকবর হোসেন পাঠান ফারুক ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঢাকা-১৭ থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি সংসদ সদস্য হিসেবে মেয়াদ শেষ করার আগেই মৃত্যুবরণ করেন।
ক্রিকেট মাঠ থেকে তারকাখ্যাতি পাওয়া নাঈমুর রহমান দুর্জয় ২০১৪ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে দুই মেয়াদে সংসদে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু তিনি তার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ থেকে তৃতীয় মেয়াদে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন পাননি।
তারকাদের নিজ খ্যাতি ব্যবহার করে রাজনীতিতে ক্ষমতাসীন হওয়ার এই প্রচেষ্টা নতুন নয়। আমাদের প্রতিবেশি দেশগুলোতেও তারকারা রাজনীতিবিদ হিসেবে ক্ষমতার চূড়ায় উঠতে সক্ষম হয়েছেন।
উদাহরণ হিসেবে দেখা যেতে পারে ইমরান খানের কথা। ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু, এখনও সম্ভবত তিনি পাকিস্তানকে একমাত্র ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতানো অধিনায়ক হিসেবেই বেশি পরিচিত। ১৯৯৬ সালে গঠিত হয় তার রাজনৈতিক দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ। ২০০০ এর পুরো দশক জুড়েই তার রাজনৈতিক জীবনের উত্থান। তিনি প্রথমে একজন পার্লামেন্ট মেম্বার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং তারপর পাকিস্তানের রাজনীতিতে অচলাবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ গড়ে তোলেন।
পাকিস্তানে ২০১৩ সালের নির্বাচনের পর তিনি বিরোধী দলের নেতা হন এবং অবশেষে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী হন। পরবর্তীতে ২০২২ সালে অনাস্থা ভোটে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের দেশ ভারতে তারকা রাজনীতিবিদদের একটি দীর্ঘ তালিকা রয়েছে। বিজেপি সরকার, জাতীয় থেকে শুরু করে রাজ্য পর্যন্ত বিভিন্ন আইনসভার সদস্য হিসেবে তারকাদের বেছে নিয়েছে। সানি দেওল, হেমা মালিনী, কিরণ খের এমন তিনজন বলিউড তারকা, যারা বিজেপির প্রতিনিধিত্ব করছেন এবং ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভার বর্তমান সদস্য। ভারতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে দুটি আইসিসি ফাইনাল জয়ের নায়ক গৌতম গম্ভীরও বিজেপি থেকে লোকসভার সদস্য হয়েছেন।
'কিউ কি সাস ভি কাভি বহু থি' টিভি সিরিয়ালে আদর্শ গৃহীনির ভূমিকায় 'তুলসী' চরিত্রে অভিনয় করে খ্যাতি অর্জন করেন স্মৃতি ইরানি। কিন্তু রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে তিনি আরও বেশি খ্যাতি পেয়েছেন। তিনি ভারতের সর্বশেষ নির্বাচনে লোকসভার সদস্য হিসেবে নিজ নির্বাচনী এলাকায় জয় নিশ্চিত করেছেন এবং তার প্রতিপক্ষ কংগ্রেসের রাহুল গান্ধীকে পরাজিত করেছেন। তিনি এখন ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির বাইরে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক দল সর্বভারতীয় তৃণমূল কংগ্রেস সবচেয়ে বেশি চলচ্চিত্র তারকাকে তাদের পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে টিকিট দিয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন মিমি চক্রবর্তী, দেব, নুসরাত জাহানসহ অনেকেই।
ভারতীয় পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে তারকাদের মধ্যে যারা রয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম জয়া বচ্চন। ভারতের সমাজবাদী দলের এমপি হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। তার স্বামী মেগাস্টার অমিতাভ বচ্চন ৮০'র দশকের শেষদিকে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে এমপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
শ্রীলঙ্কার বিখ্যাত ক্রিকেটার সনাথ জয়সুরিয়া এবং অর্জুনা রানাতুঙ্গার দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার রয়েছে। তবে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে অন্যতম বড় তারকা হচ্ছেন তাদের সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দা রাজাপাকসে। ১৯৯৪ সালে তিনি সিংহলী চলচ্চিত্র 'নোমিয়েনা মিনিসুন'তে অভিনয় করেন।
পশ্চিমের দিকে তাকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এমন নজির নেহায়েত কম নয়। রিপাবলিকান দলের হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করার আগে ডোনাল্ড ট্রাম্প মূলত একজন রিয়েলিটি টিভি তারকা হিসেবই বিখ্যাত ছিলেন। তিনি ২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত দেশটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন এবং এখনো আমেরিকান রাজনীতিতে সবচেয়ে প্রভাবশালী রাজনৈতিক কণ্ঠস্বর হয়ে রয়েছেন। ২০২০ সালের নির্বাচনে হেরে গেলেও আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তার আবারও প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
শুধু ট্রাম্প নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়া তারকাদের মধ্যে রয়েছেন রোনাল্ড রিগানও। তিনি তরুণ বয়সে হলিউডের বেশকিছু সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তিনি ৫০টিরও বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন।
টার্মিনেটর সিনেমায় অভিনয়ের জন্য বিখ্যাত আর্নল্ড শোয়ার্জনেগার যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার গভর্নর ছিলেন এবং দুই মেয়াদে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেছেন।
বিশ্বের সবচেয়ে আলোচিত রাজনীতিবিদদের মধ্যে অন্যতম ইদি আমিন। উগান্ডার কুখ্যাত এই স্বৈরশাসক ১৯৫০ এর দশকের বক্সিং চ্যাম্পিয়ন ছিলেন। এমনকি তিনি সাঁতার ও রাগবিও খেলতেন।
সারা বিশ্বের মানুষ প্রায়শই অভিযোগ করেন যে রাজনীতিবিদরাই তাদের দেশের সবচেয়ে বুদ্ধিমান বা সবচেয়ে প্রতিভাবান ব্যক্তি নন। তবে রাশিয়ায় সর্বকালের সবচেয়ে স্মার্ট পুরুষদের মধ্যে দুজন—দাবা কিংবদন্তি আনাতোলি কার্পভ ও গ্যারি কাসপারভ—রাজনীতিতে এসেছিলেন। গ্যারি কাসপারভ ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। কিন্তু ফলাফল সেটাই হয়েছিল যেটা আপনি ভাবছেন; তিনি হেরে যান।
শেষ করার আগে এমন একজন তারকা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যেতে পারে যিনি তার দেশে শান্তি আনতে ভূমিকা পালন করেছেন এবং সফল হয়েছেন। তিনি ফুটবলার দিদিয়ের দ্রগবা।
আইভরি কোস্টের এই তারকা ফুটবলার একবার নিজের দেশে বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব খেলেছিলেন। খেলায় তার দল জিতে যায়। বিজয়ী দলের বক্তব্য রাখার সময় তিনি তার দেশে চলমান গৃহযুদ্ধ বন্ধ করার জন্য যোদ্ধাদের কাছে অনুরোধ জানান। তার এই অনুরোধ কাজে আসে। দেশটিতে পাঁচ বছর চলা যুদ্ধে যুদ্ধবিরতি দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত কোনো রক্তপাত ছাড়াই একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
Comments