শেখ হেলালদের শুল্কমুক্ত গাড়ির লালসা

শেষ এক দশকে প্রহসনের নির্বাচনগুলোতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার অর্থ অনেকটা এমনটাই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল যে, মনোনয়ন পাওয়া মানেই সংশ্লিষ্ট আসনে সেই প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত হয়ে যাওয়া।

এই পরিপ্রেক্ষিতে মনোনয়নের জন্য প্রার্থীদের মোটা অঙ্কের অর্থ, দামী উপহার কিংবা উপঢৌকন দিতে হতো দলের শীর্ষ নেতাদের। এক্ষেত্রে দক্ষিণের জেলাগুলোর প্রার্থীদের জন্য একটি অলিখিত নিয়ম ছিল। সেটা হলো, উপহারের তালিকায় একটি শুল্কমুক্ত গাড়ি থাকতে হবে, যা সংসদ সদস্যরা ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য আমদানি করতে পারেন।

নির্বাচিত হওয়ার পর আমদানি করা ওই গাড়ির জায়গা হতো ক্ষমতাচ্যূত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচাতো ভাইদের গ্যারেজে।

শেখ পরিবারের এই পাঁচ ভাই হলেন- শেখ হেলাল উদ্দিন (শেখ হেলাল), শেখ সালাহ উদ্দিন (শেখ জুয়েল), শেখ সোহেল উদ্দিন (শেখ সোহেল), শেখ জালাল উদ্দিন (শেখ রুবেল) ও শেখ বেলাল উদ্দিন (শেখ বাবু)।

এ পাঁচ ভাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই শেখ আবু নাসেরের ছেলে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতে বঙ্গবন্ধু পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে শেখ আবু নাসেরও হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।

শেখ জুয়েল ছিলেন খুলনা-২ আসনের সংসদ সদস্য। বাগেরহাট-১ আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন শেখ হেলাল।

২০১৮ সালে বাগেরহাটের আরেকটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর শেখ হেলালের ছেলে শেখ সারহান নাসের তন্ময় (শেখ তন্ময়) এই চক্রে যুক্ত হন।

হেলাল কিংবা তার ভাইদের কারও কেন্দ্রীয় বা দলের গুরুত্বপূর্ণ কোনো পদ ছিল না। দলীয় সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও প্রভাব ছিল না খুব একটা। কিন্তু দলে কেউ গুরুত্বপূর্ণ পদ পেতে হলে তাদের সায় থাকতে হতো। জাতীয় কিংবা স্থানীয় নির্বাচনে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা ও ঝিনাইদহ জেলার মনোনয়নপ্রত্যাশীদেরও এই পরিবারের আশীর্বাদ নেওয়া অনেকটাই বাধ্যতামূলক ছিল।

এক্ষেত্রে তারা শেখ হাসিনার চাচাতো ভাই- এ পরিচয়টাই তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল। এটি ব্যবহার করে তারা সম্ভাব্য কিংবা 'নির্বাচিত' সংসদ সদস্যদের কাছ থেকে যথাসম্ভব সুবিধা আদায় করে নিতেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, সরকারি চাকরিতে নিয়োগ, বদলি ও উন্নয়ন কাজের টেন্ডারের ক্ষেত্রে এই পরিবারের শক্ত প্রভাব ছিল বলে তারা বিশ্বাস করতেন। এটাও ভাবতেন যে, এই পরিবারকে সন্তুষ্ট না করে তাদের পক্ষে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রায় অসম্ভব।

মনোনয়ন দৌঁড়ে নিচের দিকে থাকা নেতাদের রীতিই ছিল এই পরিবারকে উপঢৌকনে ভাসিয়ে দেওয়া। আর নির্বাচিত হলে আমদানি করা শুল্কমুক্ত গাড়িটি হস্তান্তরের বিষয়টি ছিল অলিখিত এক নিয়ম।

এদের কেউ কেউ হয়তো তাদের আমদানি করা ব্র্যান্ডনিউ এসইউভিটি দেখেননি। কিন্তু নিবন্ধন থেকে শুরু করে ফিটনেস সার্টিফিকেট ও ট্যাক্সের টাকা তাদেরই পরিশোধ করতে হয়েছিল।

খুলনার সাবেক এক সংসদ সদস্য যেমন বললেন, 'আমি কেবল ফর্মে সই করেছি। নিজের গাড়িটি কখনো দেখিনি। কিন্তু বছরের পর বছর ট্যাক্স দিয়েছি।'

গাড়িটি এখন কোথায় আছে কিংবা আদৌ সেটি অক্ষত আছে কি না- সেটাও তিনি জানেন না বলে মন্তব্য করেন ওই সংসদ সদস্য।

সাবেক এই সংসদ সদস্য আরও বলেন, '৫ আগস্টের পর গাড়িটি পুড়ে গেছে কি না জানি না। এখন এটার জন্য আমাকে ট্যাক্স দিতে হবে কি না, সেটা নিশ্চিত হতে পারছি না।'

একই আসনের আরেক সংসদ সদস্যের ভাগ্য অবশ্য ভালো ছিল। কারণ আমদানির পর গাড়িটি তিনি অন্তত একদিন ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। এরপরেই সেটি শেখ পরিবারকে বুঝিয়ে দিতে হয়।

২০১৮ থেকে ২০২৪ মেয়াদে পাশের জেলার আরেক সংসদ সদস্য ছিলেন ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতা। তিনিও শেখ পরিবারকে আমদানি করা গাড়ি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই গাড়ি আমদানির সুযোগ তিনি পাননি।

এই সংসদ সদস্যরা বলছেন, এই পাঁচ ভাইয়ের পরিবার সাধারণত নির্বাচনের আগ থেকেই যশোর, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা এবং ঝিনাইদহের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করত।

মনোনয়ন পেতে এ পরিবারের সমর্থনও চাইতেন তারা।

সাবেক এই সংসদ সদস্যরা বলেন, তারা প্রভাবশালী এবং প্রতিটি আসনে শেখ হাসিনা কাকে বেছে নিয়েছেন তা খুঁজে বের করা তাদের জন্য কঠিন কিছু ছিল না।

কিন্তু বাস্তবে দলের মধ্যে তাদের প্রভাব ছিল খুবই কম। অথচ তারা এমন ভাব করতেন যে মনোনয়ন চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় তাদের যথেষ্ট প্রভাব আছে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা সেই প্রার্থীদের টার্গেট করতেন।

কিন্তু এই হিসাবে ভুল হওয়ার ঘটনাও আছে।

যেমন- গত জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এই পরিবারের একজন নামের মিলে একজন ভুল প্রার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন।

তাদের একজন শেখ রাশেদুল ইসলাম ও অন্যজন খুলনা-৬ আসনের আসনের রশীদুজ্জামান মোড়ল।

সূত্র বলছে, শেখ পরিবারের একজন মনোনয়ন নিয়ে রাশেদুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলেন। কিন্তু শেখ হাসিনা রশীদুজ্জামানকে মনোনয়ন দেন।

অথচ রাশেদুল ইসলাম শেখ পরিবারবে এত এত উপহার দিয়েছিলেন যে, তিনি তার মনোনয়নপ্রাপ্তির ব্যাপারে একপ্রকার নিশ্চিতই ছিলেন।

আর মনোনয়ন নিশ্চিত হওয়ার পর রশীদুজ্জামানের কাছ থেকে উপঢৌকন দাবি করেন শেখ পরিবারের সেই সদস্য।

সাবেক ওই সংসদ সদস্যের ঘনিষ্ঠ এক সহযোগী বলেন, নির্বাচনের অনেক আগেই রশীদুজ্জামান শেখ পরিবারকে সন্তুষ্ট করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন।

তবে গাড়ি আমদানির জন্য পর্যাপ্ত সময় পাননি সাবেক এই এমপি।

বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য শেখ পরিবারের সদস্যদের কারও খোঁজ পাওয়া যায়নি।

Comments

The Daily Star  | English
CSA to be repealed

CSA to be repealed within a week: Nahid Islam

About the election, Nahid said an election based on national consensus will be held after completing all necessary reforms.

3h ago