হাসিনা সরকারের পতন: ৫১ দিনে ১৪৭৪ মামলায় ৯২ হাজারের বেশি আসামি

ছবি: সংগৃহীত

জুলাই-আগস্টে সংঘটিত সহিংসতার ঘটনায় সারা দেশে অন্তত এক হাজার ৪৭৪টি মামলা হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এসব মামলা করা হয়।

পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এসব মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক মন্ত্রী, রাজনৈতিক নেতা ও পুলিশ সদস্যসহ মোট ৯২ হাজার ৪৮৬ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং এসব মামলার বেশিরভাগই হত্যার অভিযোগে করা হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জুলাই-আগস্টে সহিংসতার মামলায় ৫ আগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে মাত্র ৭৭৯ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে ২৪৬ জনকে সন্দেহভাজন হিসেবে আটক করা হয়েছে।

তবে, চলতি মাসে গ্রেপ্তার বেড়েছে। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই সাত হাজার ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতদের মধ্যে মাদক চোরাকারবার, খুন, ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধের আসামি এবং জুলাই-আগস্টের সহিংসতার মামলার আসামিরা রয়েছেন।

পুলিশ সদরদপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) এনামুল হক সাগর বলেন, পুলিশ পূর্ণ সক্ষমতায় অভিযান চালানোর কারণেই গ্রেপ্তার বেড়েছে।

তিনি বলেন, '৫ আগস্টের পর আমরা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে ছিলাম। প্রায় ৪০৭টি থানা ও ফাঁড়ি এবং প্রায় এক হাজার গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়েছে। অভিযান চালানোর জন্য গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে যেতে হয়েছে।'

তিনি বলেন, নতুন পুলিশ সুপার (এসপি) ও কমিশনারদের জেলা ও মেট্রোপলিটন এলাকায় নিয়োগ দিয়ে ইউনিট প্রধান পরিবর্তন করা হয়েছে।
দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি আরও বলেন, 'প্রাথমিকভাবে, এসপি ও কমিশনাররা পুলিশ সদস্যদের মনোবল বাড়িয়েছেন। এখন আমরা পুনরায় পুরোদমে কার্যক্রম শুরু করেছি।'

আওয়ামী শাসনামলে বিভিন্ন অপরাধে সারা দেশে দৈনিক গড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হতো। সে তুলনায় চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে গড়ে প্রতিদিন প্রায় এক হাজার জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

গ্রেপ্তার বেড়ে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে এআইজি এনামুল বলেন, '৫ আগস্টের পর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলা হয়েছে এবং আমরা অনেক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা কার্যকর করতে পারিনি। তবে, আমরা এখন নিয়মিত অভিযানের অংশ হিসেবে সেসব পরোয়ানার আসামিদের গ্রেপ্তার করছি।'

সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা

পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ৬ আগস্ট থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩৯০ জন সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা ও সিটি করপোরেশনের মেয়রদের বিরুদ্ধে মোট এক হাজার ১৭৪টি মামলা হয়েছে।

আসামিদের মধ্যে সাবেক মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, হাসিনার উপদেষ্টাসহ ৫৯ জনকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিজেই সর্বোচ্চ ২২০টি মামলার আসামি। এ ছাড়া, তার বোন শেখ রেহানা ২২টি, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ১৯টি, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল চারটি এবং ভাতিজা রিদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি একটি মামলার আসামি।

সাবেক মন্ত্রিসভার সদস্যদের মধ্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৯৯টি মামলার আসামি। এ ছাড়া, সাবেক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ১৬৯টি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ ৭২টি এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ৫৯টি মামলায় আসামি হয়েছেন।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানককে ৪১টি মামলায় এবং সাবেক বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানকে ২৪টি মামলার আসামি করা হয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের বিরুদ্ধে ৩৮টি এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ২০টি মামলা রয়েছে।

মামলার মুখোমুখি অন্যান্য উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান। তাদের বিরুদ্ধে যথাক্রমে ৫৪, ৪৪ ও ৪১টি মামলা হয়েছে।

ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনানের নামে যথাক্রমে ৩১ ও ৩০টি মামলা রয়েছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সাবেক সভাপতি শাহরিয়ার কবিরকে নয়টি মামলায় আসামি করা হয়েছে।

এ ছাড়া, বর্তমান ও সাবেক ৪৪৯ জন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রায় ৩০০ মামলা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে পুলিশের দুই সাবেক মহাপরিদর্শকসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

মামলার মধ্যে চার সাবেক আইজিপির বিরুদ্ধে ১৩৬টি, সাবেক ১৬ অতিরিক্ত আইজিপির বিরুদ্ধে ১৮২টি, চারজন অতিরিক্ত আইজিপির বিরুদ্ধে ২৫টি, সাবেক ছয় ডিআইজির বিরুদ্ধে ২৩টি, সাত ডিআইজির বিরুদ্ধে ১৪০টি, ২৬ অতিরিক্ত ডিআইজির বিরুদ্ধে ১৯৭টি এবং ৪২ জন এসপির বিরুদ্ধে ৯৭টি মামলা হয়েছে।

এসব মামলা হওয়ার পর অনেক পুলিশ কর্মকর্তা আত্মগোপনে, আবার অনেকে দেশ ছেড়েছেন বলে পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।

সূত্রগুলো দাবি করেছে, পুলিশ সদরদপ্তর এ মাসের শুরুতে জেলা এসপি এবং মেট্রোপলিটন কমিশনারদের সতর্কতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জুলাই-আগস্টে সহিংসতার জন্য দায়ীদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দিয়েছে। নিরস্ত্র শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারকারীদের গ্রেপ্তার করতে তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

খুলনা রেঞ্জ পুলিশের একজন পরিদর্শক বলেন, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার বৃদ্ধি ও তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সদরদপ্তরের এসব নির্দেশাবলী সম্পর্কে মন্তব্য জানতে বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে দ্য ডেইলি স্টার। কিন্তু তাদের কেউই নাম প্রকাশ করে মন্তব্য জানাতে রাজি হননি।

সদর দপ্তরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, জুলাই-আগস্টে সহিংসতার সঙ্গে জড়িতদের তদন্ত সাপেক্ষে দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তাওহিদুল হক বলেন, 'সহিংসতা ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তবে, তারা জড়িত ছিল কি না, সেটা নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে।'

'পুলিশের গণহারে গ্রেপ্তার করা উচিত হবে না। কারণ, এর ফলে বাহিনীর ভাবমূর্তিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Postgrad doctors block Shahbagh demanding stipend hike

The blockade resulted in halt of traffic movement, causing huge suffering to commuters

54m ago