‘ও পুলিশ ভাই আমার নাতিডা নির্দোষ, রাজনীতি করে না’

নারায়ণগঞ্জ
নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতের সামনে নাতির জন্য ঝুনু বেগমের কান্না। ছবি: সৌরভ হোসেন সিয়াম/ স্টার

ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর সাড়ে ১২টা। তপ্ত রোদে নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতের সামনে হাত-পা ছড়িয়ে বিলাপ করছিলেন ৬৫ বছর বয়সী ঝুনু বেগম। তার সামনে পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যান। তাতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে নাশকতা ও সহিংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার অভিযুক্তদের তোলা হচ্ছিল। আসামিদের তালিকায় রয়েছে ঝুনুর ১৯ বছর বয়সী দিনমজুর নাতি আরিফ হোসেনও।

'ও পুলিশ ভাই আমার নাতিডা নির্দোষ। ওয় কোনো রাজনীতি করে না। ওয় কিছু করে নাই', পুলিশের উদ্দেশ্যে কথাগুলো বলে যখন কাঁদছিলেন ঝুনু বেগম, তখন পুলিশ সদস্যরা আসামিদের ভ্যানে তুলতে ব্যস্ত।

আরিফের পরিবারের সদস্যরা জানান, বছরখানেক আগে বিয়ে করা আরিফ তার স্ত্রীকে নিয়ে সোনারগাঁ উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের পরমেশ্বরদী গ্রামে নানিবাড়িতে থাকেন। গত ২৩ জুলাই রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যায়।

পরদিন ৫৪ ধারায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে আদালতে পাঠায় সোনারগাঁ থানা পুলিশ। পরে সোনারগাঁ থানায় পুলিশের দায়ের করা নাশকতার অভিযোগে বিস্ফোরক আইনের একটি মামলা হলে ওই মামলায় আরিফকে অজ্ঞাত আসামির তালিকায় রেখে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। ওই মামলায় জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন প্রধান আসামি বলে জানান আরিফের আইনজীবী ও সোনারগাঁ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট শামসুল ইসলাম ভূঁইয়া।

আওয়ামী লীগ নেতা শামসুল ইসলাম ভূঁইয়া গ্রেপ্তার আরিফের শাশুড়ির চাচাত ভাই।

ঝুনু বেগম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আরদিন কামেরতে আহে আছরের (বিকেলে) পরই। ওইদিন কামেরতে আইতে দেরি হইয়া গেছে। মাগরিবের ওয়াক্তে (সন্ধ্যা) বাড়িত আইয়া দুইডা খাইয়া হুইছে পরেই ঘুম গেছে গা। রাইত পৌনে ১১টার দিকে বাড়িতে পুলিশ আহে। তারে ঘুমেরতে তুইল্লা নিয়া গেল।'

'পুলিশগো কইলাম, বাবা দেহো, হ্যায় রাজমিস্ত্রির কাম করে, হ্যায় কোনো বিএনপি-মিএনপি করে না। কিচ্ছু হুনলো না গো বাবা। টানতে টানতে লইয়া গেলো গা। কইছে তোমারে আবার আইন্না (বাড়িতে) দিয়া যামু। থানায় যদি তোমার নাম না থাহে, ছবি না থাহে, তাইলে আবার দিয়া যামু। এই কথা কইয়া নিছে গো, আর তো ছাড়ল না। সকালে থানায় গেছি, ঢুকতেই দেয় নাই', যোগ করেন আরিফের নানি।

ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধা তার স্বামীকে হারিয়েছেন সাত বছর হয়েছে। তার দুই মেয়ে। বড় মেয়ের ছেলে আরিফের উপার্জনে চলতো তার জীবন। অসহায় এই নারী তার পরম স্নেহের নাতিকে কীভাবে জেল থেকে বের করবেন, তা ভেবে পাচ্ছেন না।

তিনি বলেন, 'আমার স্বামীও নাই, পোলাও নাই। দুইডা মাইয়া। বড় ঘরের নাতিডায় আমারে কামাই কইরা খাওয়ায়। অহোনে আমি কইত্তে ট্যাকা-পয়সা ভাঙমু? আমি ওরে যে বাইর করমু ট্যাকা কই পামু?'

এই বলেই আবারও হাত-পা ছড়িয়ে বিলাপ করতে শুরু করেন ঝুনু বেগম।

ছবি: স্টার

নারায়ণগঞ্জ আদালত চত্বরে ঝুনু বেগমই একমাত্র ব্যক্তি নন যিনি স্বজনের জন্য কাঁদছিলেন। এই প্রতিবেদক আরও কয়েকটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে যারা দাবি করেছেন, তাদের স্বজনরা 'নাশকতার' ঘটনার সঙ্গে জড়িত নয়।

মঙ্গলবার রাতে পরমেশ্বরদী গ্রাম থেকে আরও চারজনকে আটক করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাদের মধ্যে দুইজনের বয়স ১৮ বছরের নিচে বলে দাবি করেছেন তাদের পরিবারের সদস্যরা।

১৮ বছর বয়সী মো. আলমকে ওইরাতে স্থানীয় একটি মাছের ঘের থেকে আটক করে পুলিশ। আলমের বাবা আক্তার হোসেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের একজন সক্রিয় কর্মী বলে জানান তার বড় বোন শিরিনা।

তিনি বলেন, 'আমার ভাই দিনে দিনমজুরি করে আর রাতে একটি মাছের ঘের দেখাশোনা করে। ওই রাতে ঘেরেই ছিল সে। ঘের থেকেই চারজনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পুলিশ। আমরা থানায় গিয়ে পুলিশকে বলছি যে, আমাদের পরিবার আওয়ামী লীগ পরিবার। আমরা কোনো ঝামেলার সঙ্গে নাই। কিন্তু পুলিশ কোনো কথাই শোনে নাই।'

শিরিনা একটি প্রত্যয়নপত্রও দেখান, যাতে নোয়াগাঁও ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সই রয়েছে। ওই প্রত্যয়নপত্রে আলমসহ আরও দুইজনের নাম উল্লেখ করে লেখা রয়েছে 'তারা নোয়াগাঁও ইউনিয়নের সাত নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা এবং তারা বাংলাদেশ আওয়ামী পরিবারের সন্তান। তারা আওয়ামী লীগের বিভিন্ন মিছিল-মিটিংয়ে সবসময় সম্পৃক্ত থাকেন। তারা দীর্ঘদিন যাবৎ আওয়ামী লীগ আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত।'

পরমেশ্বরদী গ্রামের বাসিন্দা ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুল ইসলাম ভূঁইয়া নিজেও এই বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি ওইরাতে গ্রেপ্তার চারজনের মধ্যে তিনজনের জামিনের জন্য আদালতে লড়ছেন।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আরও চারটি পরিবারের কথা হয়েছে, যাদের স্বজনরা নাশকতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তারা সবাই নিম্ন আয়ের। কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নন বলে পরিবারের সদস্যরা দাবি করেছেন।

নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালতের সামনে গ্রেপ্তারকৃতদের দেখতে স্বজনদের ভিড়। ছবি: স্টার

রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরসাইকেল চালাতেন হোসেন মাহমুদ। কয়েক মাস আগে কিস্তিতে মোটরসাইকেলটি কেনেন ২৬ বছর বয়সী এই যুবক। গত মঙ্গলবার রাতে যখন তাকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়কের জালকুড়ি এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়, তখন তিনি একজন যাত্রীকে সেখানে নামিয়ে অপর যাত্রীর জন্য অপেক্ষা করছিলেন বলে জানান স্ত্রী জান্নাতুল ইসলাম মিতু।

হোসেন তার স্ত্রী ও শিশু সন্তানকে নিয়ে সদর উপজেলার ভূঁইগড় এলাকায় থাকেন। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালীন গত ১৯ জুলাই তার বাড়ির অদূরে অবস্থিত এসবি স্ট্যাইল কম্পোজিট লিমিটেড কারখানায় আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা।

মিতু বলেন, আন্দোলনের পাঁচদিন বাড়িতেই ছিলেন হোসেন। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে কারফিউর মধ্যেই জীবিকার তাগিদে মঙ্গলবার মোটরসাইকেল নিয়ে বের হন তিনি। তাকে আটকের পর এসবি কম্পোজিটে আগুন দেওয়ার ঘটনায় দায়ের করা বিস্ফোরক আইনের মামলায় আসামি করা হয়।

'আমার শ্বশুর বাঁইচা নাই, শাশুড়ি চোখে দেখেন না। আত্মীয়-স্বজনদের কেউ এই সময়ে থানা-পুলিশের কাছে যাইতে চায় না। বাধ্য হয়ে ছোট শিশুটাকে কোলে নিয়ে একবার থানায়, আরেকবার কোর্টে দৌঁড়াচ্ছি আমি। আমাদের কোনো সঞ্চয় নাই। ধার-দেনা কইরা একজন উকিল ধরছি। কিন্তু কোর্টে তার জামিন হয় নাই', শিশু আমির হামজাকে কোলে নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন হোসেনের স্ত্রী।

জেলা পুলিশ সূত্রে জানা যায়, কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতার ঘটনায় রোববার পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জ জেলার পাঁচটি থানায় ২৭টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। অধিকাংশ মামলার বাদী পুলিশ। এসব মামলায় পাঁচ হাজারের অধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। রোববার পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৫১২ জনকে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) গোলাম মোস্তফা রাসেল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পুলিশ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান চালাচ্ছে। পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন দাবি করতেই পারেন, এ অধিকার তাদের আছে। কিন্তু পুলিশ কাউকে অযথা হয়রানি করছে না।'

মামলার নথি দিচ্ছে না পুলিশ, অভিযোগ আইনজীবীদের

একদিকে জেলাজুড়ে দুই ডজনের বেশি মামলা, অন্যদিকে পাঁচ শতাধিক গ্রেপ্তার। ফলে রোববার সপ্তাহের প্রথম দিনে নারায়ণগঞ্জ জেলা আদালত চত্বরে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীদের উপস্থিতি ছিল অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশি।

একদল আইনজীবী অভিযোগ করে বলছেন, আদালত পুলিশের কর্মকর্তারা সাম্প্রতিক মামলাগুলোর নথিপত্র সরবরাহ করছেন না। এমনকি মামলার এজাহার পর্যন্ত দেখতে পারছেন না আইনজীবীরা। এমন চর্চা তারা আগে কখনো দেখেননি। ফলে কোনো ধরনের 'কেস স্টাডি' ছাড়াই জামিন শুনানিতে অংশ নিতে হচ্ছে তাদের।

নারায়ণগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য মাজেদুল হক রাজন ডেইলি স্টারকে জানান, তার কাছে দুটি মামলায় গ্রেপ্তার আসামির স্বজনরা এসেছেন। তাদের পক্ষে তিনি আদালতে জামিন শুনানিতে অংশ নিয়েছেন কেবল নাম ও জাতীয় পরিচয়পত্রের ওপর ভিত্তি করে। আদালত পুলিশের কাছে গিয়েও ওই সংক্রান্ত মামলা দুটির কোনো নথি তিনি পাননি।

'যেকোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক আন্দোলন হতেই পারে। সেখান থেকে মামলার উদ্ভব হবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সংবিধান রাষ্ট্রের যেকোনো নাগরিককে আইনের আশ্রয় নেওয়ার অধিকার নিশ্চিত করেছে। তা ছাড়া, মামলার এজাহার তো কোনো গোপন বিষয় না। আমরা মামলার এজাহার না পাওয়ায় কেবল নাম ও আইডি কার্ডের ওপর নির্ভর করে জামিন শুনানি করছি। কিন্তু জামিন পাইনি। মামলার মেরিট জানতে পারলে হয়তো শুনানিতে আরও সুবিধা হতো, জামিন পাওয়া সহজ হতো। আমি আমার আট বছরের পেশাগত জীবনে এমনটা কখনো দেখিনি। এই বিষয়টি একজন নাগরিককে তার আইনের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত করছে', যোগ করেন তিনি।

এ বিষয়ে অন্তত ১০ জন আইনজীবীর একটি দল রোববার দুপুরে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে দেখা করেছেন বলে জানান আইনজীবী ওমর ফারুক নয়ন। ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, 'এমনটা আমরা কখনো দেখিনি যে আইনজীবীরা মামলার এজাহার পাচ্ছেন না। আমরা বিষয়টি চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েছি। তিনি এ বিষয়ে নির্দেশনা দেবেন বলে আশ্বস্ত করেছেন।'

জানতে চাইলে আদালত পুলিশের পরিদর্শক আব্দুর রশীদ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বর্তমান পরিস্থিতি অন্য স্বাভাবিক সময়ের মতো না। আমরা সাধারণ মামলাগুলোর নথিপত্র আইনজীবীরা চাইলে সরবরাহ করি। কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে আইনজীবীরা সংশ্লিষ্ট আদালতের অনুমতি নিয়ে এলে নথি সরবরাহ করা হবে বলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা আছে।'

Comments

The Daily Star  | English

What's causing the unrest among factory workers?

Kalpona Akter, labour rights activist and president of Bangladesh Garment and Industrial Workers Federation, talks to Monorom Polok of The Daily Star about the recent ready-made garments (RMG) workers’ unrest.

8h ago