চট্টগ্রাম কারাগারে হাজতির অস্বাভাবিক মৃত্যু, নির্যাতনের অভিযোগ পরিবারের

চট্টগ্রাম কারাগারে হাজতির অস্বাভাবিক মৃত্যু, নির্যাতনের অভিযোগ পরিবারের
রুবেল দে | ছবি: সংগৃহীত

চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ৩৮ বছর বয়সী এক হাজতির অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। সোমবার সকালে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (চমেক) জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

ওই হাজতির নাম রুবেল দে। তিনি বোয়ালখালীর শ্রীপুর-খরণদ্বীপ ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের দক্ষিণ জ্যৈষ্টপুরার বাসিন্দা সুনীল দে-এর ছেলে। তিনি কারাগারের ৩ নম্বর পদ্মা ওয়ার্ডে বন্দি ছিলেন।

রুবেলের শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে তার স্বজন অভিযোগ তুলেছে, কারাগারে ভেতরে কারারক্ষী বা অন্য কয়েদিরা তাকে নির্যাতন করেছেন।

মামলার নথি অনুসারে, বাড়ির পাশের এলাকা নন্দীপাড়া হরিমোহন এলাকায় চোলাই মদ বিক্রির সময় বোয়ালখালী থানা পুলিশের একটি দল গত ২৭ জানুয়ারি রাতে রুবেলকে আটক করে। পুলিশ তার কাছ থেকে ২০০ লিটার মদ জব্দ করে। বোয়ালখালী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) এসএম আবু মুসা বাদী হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলাটি দায়ের করেছিলেন।

ওই মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে পরের দিন বিকেলে আদালত রুবেলকে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে নেওয়ার আদেশ দেন। এরপর থেকে রুবেল কারাগারেই ছিলেন।

রুবেলের পরিবারের সদস্য ও স্বজনের ভাষ্য, রুবেল পেশায় কৃষক, মাদক বিক্রেতা নন। তবে মাঝে মাঝে তিনি মদ্যপান করতেন।

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রুবেলের খালাতো ভাই রাজীব দে দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'গ্রেপ্তারের পরে আদালত ভবনের হাজতখানায় আমরা দেখা করেছিলাম। ২৮ জানুয়ারি বিকেলে প্রিজন ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়ার সময় রুবেল সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। এরপর ২ ফেব্রুয়ারি তার সঙ্গে দেখা করতে আমরা চট্টগ্রাম কারাগারে গিয়েছিলাম। সেদিন আমরা দেখেছি, চারজন কারারক্ষী তাকে হুইলচেয়ারে করে ধরে ধরে নিয়ে আসছেন।

'রুবেল তাকাতে পারছিল না, মুখ থেকে লালা ঝরছিল। কারারক্ষীদের কাছে আমরা জানতে চেয়েছিলাম ওই অবস্থা কীভাবে হয়েছে কিন্তু তারা কোনো সদুত্তর দেননি। আমরা রুবেলের ডান ভ্রু ও শরীরের আঘাতের চিহ্ন দেখতে পেয়েছি। সে সময় রুবেল এক রকম অচেতন অবস্থায় ছিল, আমরা কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু ব্যর্থ হয়ে ফেরত আসি,' বলেন রাজীব।

রাজীব পেশায় গাড়ির মেকানিক। চট্টগ্রামের মুরাদপুরে তার গ্যারেজ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, 'রুবেলের ও রকম অবস্থা দেখে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলি। রোববার আমাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তার উন্নত চিকিৎসায় জেল সুপারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন আদালত।'

চমেক হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে দাঁড়িয়ে রাজীব এই প্রতিবেদককে আরও বলেন, 'স্থানীয় একজন ওয়ার্ড মেম্বার সকাল ৮টার দিকে বোয়ালখালীতে আমার দিদিকে (রুবেলের স্ত্রী) জানান, আমার ভাই সকালে হাসপাতালে মারা গেছেন। জানার পরে আমি মেডিকেলে এসে দেখি রুবেলের লাশ স্ট্রেচারে। এক কারারক্ষী পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।

'ওই কারারক্ষী জানান, বুকে ব্যথা শুরু হলে ভোরে রুবেলকে হাসপাতালে আনা হয়। সে সময় কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আমরা লাশের বুকে, পিঠে, গোপনাঙ্গ ও হাতে ছোপছোপ অস্বাভাবিক দাগ পেয়েছি। যা থেকে বোঝা যায়, মৃত্যুর আগে তাকে নির্যাতন করা হয়েছে,' বলেন রাজীব।

এই প্রতিবেদকের সঙ্গে রাজীবের কথা শেষ হওয়ার আগেই চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ আলামিন একজন ডেপুটি জেলারসহ হাসপাতালে আসেন এবং দুপুর দেড়টার দিকে সুরতহাল করেন।

আলামিন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সুরতহাল করার সময় চোখের উপরে কপালে একটি আঘাতের চিহ্ন, শরীরের কয়েকটি স্থানে ও দুই হাতের কব্জিতে দাগ পেয়েছি। ময়নাতদন্তের মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ জানা যাবে।'

স্বজন জানান, রুবেলের দুই মেয়ে রয়েছে এবং তার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। বড় মেয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ে এবং ছোট মেয়ের বয়স প্রায় ১০ বছর, সে স্থানীয় একটি স্কুলের শিক্ষার্থী।

রুবেল মাদকাসক্ত দাবি করে চট্টগ্রাম কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মুহাম্মদ মঞ্জুর হোসেন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মাদক নেওয়ার কারণে হাজতি রুবেলের মানসিক সমস্যা—উইথড্রল সিন্ড্রোম ছিল। আমরা প্রথমে তাকে আলাদা ওয়ার্ডে রেখেছিলাম। পরে তাকে পদ্মা ৩ নম্বর ওয়ার্ডে অন্য বন্দিদের সঙ্গে রাখা হয়। সেখানে মানসিক সমস্যা আছে এমন একাধিক বন্দিদের রাখা হয়েছে। ভোর রাতে বুকে ব্যথার কথা বললে আমরা তাকে কারা হাসপাতালে নিয়ে যাই।

'সেখানে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে উন্নত চিকিৎসার জন্য চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়। কারাগারে কারারক্ষী বা অন্য বন্দি তাকে নির্যাতন করেনি,' বলেন মঞ্জুর হোসেন।

কপালে আঘাতের চিহ্ন এবং শরীরের দাগের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'যেহেতু তার মানসিক সমস্যার লক্ষণ ছিল, তিনি নিজে ঠিক মতো হাঁটাচলা করতে পারতেন না, তাই টয়লেটে যাওয়ার সময় ছোটখাটো আঘাত পেয়ে থাকতে পারেন। তা ছাড়া, অনেক সময় কব্জিতে হাতকড়া চেপে লাগানোর কারণে দাগ তৈরি হতে পারে।'

রুবেলকে গ্রেপ্তার করা উপপরিদর্শক (এসআই) মুসা ভিন্ন কথা বলেন।

'গ্রেপ্তারের সময় তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে পুরোপুরি সুস্থ ছিলেন। আমাদের হেফাজতে থাকাকালে তার কোনো ধরনের অস্বাভাবিক উপসর্গ খুঁজে পাইনি,' বলেন মুসা।

রুবেলের পরিবারের সদস্যরা আরও অভিযোগ করেন, গ্রেপ্তারের পরে রুবেলকে ছেড়ে দিতে পুলিশ এক লাখ টাকা দাবি করে। তবে সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মুসা।

তিনি বলেন, 'রুবেল একজন পেশাদার মদ বিক্রেতা। আমাদের সাক্ষী আছে এবং সবার চোখের সামনেই আমাদের অপারেশন হয়েছিল।'

রুবেলের আইনজীবী অজয় ধর বলেন, 'রোববার ষষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত জেল সুপারকে রুবেলের উন্নত চিকিৎসার জন্য তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন, আর রাতেই তার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়। জেল সুপার এই দায় এড়াতে পারেন না, কারণ আমার মক্কেল পুলিশ হেফাজতে পুরোপুরি সুস্থ ছিল।'

আদালতের আদেশের নথি পাওয়ার কথা স্বীকার করে জেল সুপার বলেন, 'আমরা আদালতের কাগজ পেয়েছি। আমাদের জবাব আমরা প্রতিবেদন আকারে দেওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয়।'

এদিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে রুবেলের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।

Comments

The Daily Star  | English

Nowfel gained from illegal tobacco trade

Former education minister Mohibul Hassan Chowdhury Nowfel received at least Tk 3 crore from a tobacco company, known for years for illegal cigarette production and marketing including some counterfeit foreign brands. 

2h ago