কৃষি খাতে বিপ্লব আনতে পারে যে যুগান্তকারী গবেষণা

স্টার ফাইল ফটো

বাংলাদেশের সর্বত্রই পানি আর পানি। তবুও মিঠা পানির অভাব অন্যতম উদ্বেগ।

দূষণ, নদী দখল, বন্যা এবং নদীতে ভারত ও চীনের তৈরি বাঁধের কারণে পৃথিবীর এ বৃহত্তম নদী ব-দ্বীপের পানি আজ হুমকির মুখে। সেচ ও শিল্পায়নের জন্য অতিরিক্ত উত্তোলনে ভূগর্ভস্থ পানি ক্রমাগত কমছে।

ভূ-পৃষ্ঠে পানির অভাবে, বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে, গৃহস্থালি, খামার ও শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় পানি জোগাতে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে বাংলাদেশ। বিশ্বের সবচেয়ে উর্বরতম মাটিতে যখন পানির অভাব মারাত্মক হয়ে উঠছে, তখন একটি যুগান্তকারী গবেষণা বাংলাদেশকে বড় স্বস্তির পথ দেখাচ্ছে। এতে করে প্রতি বছর ভূগর্ভস্থ পানি শুকিয়ে যাওয়া এবং এর ফলে জাকার্তার মতো ভূমিধ্বস কমবে।

গত বৃহস্পতিবার লন্ডন থেকে টেলিফোনে এই গবেষণার প্রধান গবেষক মোহাম্মদ শামসুদ্দুহা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সব ধরনের সমস্যার জন্য এটি একটি যুগান্তকারী গবেষণা।'

১ মাস আগে বিখ্যাত জার্নাল সায়েন্সে ৬ জন বিজ্ঞানী গবেষণাপত্রটি প্রকাশ করেন। তাদের মধ্যে ৫ জনই বাংলাদেশি। গবেষণাপত্রে বাংলাদেশের একটি দুর্দান্ত জলাধার সম্পর্কে লেখা হয়েছে, যেটি খুব কমই শুকিয়ে যায়। গবেষকরা এর নাম দিয়েছেন 'বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন'। এর মধ্যে থেকে পানি উত্তোলন করলে ভূপৃষ্ঠ ও নিকটবর্তী পানির উত্স থেকে এটি আরও মিঠা পানির প্রবাহ তৈরি করবে।

এই যন্ত্রটিকে ভূ-বিজ্ঞানীরা বাংলা অববাহিকার মানুষের জন্য প্রকৃতির বিশেষ উপহার হিসেবে বিবেচনা করছেন।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের অধ্যাপক শামসুদ্দুহা ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল আবিষ্কার। বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ প্রকৃতির দেওয়া উপহার পাচ্ছেন। এই আবিষ্কার আমাদের কৃষিতে আরও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারবে। কারণ, সেচ কৌশল এখন বৈজ্ঞানিকভাবে নির্ধারণ করা সম্ভব হবে।'

মিঠা পানির জন্য ভূগর্ভস্থ বিশাল পানির ভাণ্ডার হাজারো বছর ধরে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের মাধ্যমে তৈরি হয়েছে। প্রতি বছর হিমালয়ের মতো দূর থেকে প্রচুর পলি বয়ে আসায় এই ব-দ্বীপের মাটির বিশেষ গঠন তৈরি হয়েছে।

শুষ্ক মৌসুমে চাল উৎপাদনের জন্য বাংলাদেশে বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন তৈরি করা হলেও ১৯৮০-এর দশক পর্যন্ত তা পুরোপুরি চালু করা হয়নি। না জেনেই লাখো কৃষক সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানি তুলে সেচ দিতে শুরু করে।

পাম্প ও কৃষির উন্নতির কারণে দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের খরা-কবলিত কৃষক ব্যাপক সেচ পেয়েছেন। যার ফলে বাংলাদেশে প্রতি বছর পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য উৎপাদন হয়েছে এবং দেশের চাল উৎপাদন ৩ গুণ বাড়িয়ে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সক্ষম করেছে।

বাংলা অববাহিকার ভূতাত্ত্বিক গঠন ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার হওয়ার পর দ্রুত আবার পূর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে অদ্ভুতভাবে সাড়া দিয়েছিল।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাইড্রোজিওলজিস্ট অধ্যাপক কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ বলেন, 'যদি পাম্পিং না থাকত, তাহলে পানির মেশিন কাজ করত না।'

তিনি বলেন, 'কৃষক যখন ভূগর্ভস্থ পানি বেশি উত্তোলন করেন, তখন পানির স্তর নেমে যায় এবং এতে অতিরিক্ত পানির জন্য জায়গা তৈরি হয়।'

ফলন বাড়ানোর পাশাপাশি প্রাকৃতিক পানির ব্যবস্থা বর্ষা মৌসুমে বন্যা কমাতে সহায়তা করছে বলে মনে করা হয়। অধ্যাপক মতিন বলেন, 'যদি ভূগর্ভস্থ পানির খালি জায়গা পূরণ না হয়, তাহলে সব পানি ভূপৃষ্ঠের ওপরে থাকবে। সেক্ষেত্রে আরও বড় বন্যা হবে।'

পুরো বাস্তুতন্ত্র একটি যন্ত্রের মতো কাজ করে। কৃষক পানি পাম্প করে এবং এই অববাহিকার বিশেষ মাটি দ্রুত বৃষ্টি-বন্যার পানি ধরে ফেলে। ভূপৃষ্ঠে পড়া বৃষ্টির পানি বা বন্যার পানি ভূগর্ভে পৌঁছানোর আগে মাটির বিভিন্ন স্তরে পরিস্রাবণ হয়ে বিশুদ্ধ হয়ে যায়। এরপর মিঠা পানি মাটির নিচের বিভিন্ন গভীরতায় সংরক্ষিত হয়, যার বেশিরভাগই ১০০ ফুট নিচে এবং কৃষক সহজেই তা তুলতে পারেন।

শুষ্ক মৌসুমে প্রতি কেজি চাল উৎপাদনে ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার লিটার ভূগর্ভস্থ পানির প্রয়োজন হয়। আর বোরো ধানের জন্য ৩ মাসে যে পরিমাণ ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করা হয়, তা অকল্পনীয়।

২০২১ সালে বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি বছর প্রায় ৩২ কিউবিক কিলোমিটার ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন করেন কৃষক। যা দিয়ে পুরো বাংলাদেশের ওপর ৩তলা উচ্চতার 'ওয়াটার বিল্ডিং' নির্মাণ করা যাবে।

স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, গবেষকরা দেখেছেন যে বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন পানির অতি উত্তোলনের উদ্বেগ দূর করছে।

তবে, পানি উত্তোলন ও তা পুনরায় ভরে যাওয়ার অনুপাত বাংলাদেশের সব অঞ্চলে উৎসাহব্যঞ্জক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। উত্তরাঞ্চলে এটি অনিশ্চিত। অপরদিকে, দেশের পশ্চিমাঞ্চলে সাধারণত পূর্বাঞ্চলের তুলনায় কম বৃষ্টিপাত হয়। কম বৃষ্টিপাতের ফলাফল প্রতিফলিত হয় ভূগর্ভস্থ পানিতে। গবেষণায় দেখা গেছে, ভূগর্ভস্থ পানি ক্রমেই কমছে দেশের পশ্চিমাঞ্চলে, তবে পূর্বাঞ্চলে নয়।

গবেষণাপত্রটির সহগবেষক ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ার জাহিদ বলেন, 'চাল উৎপাদনকারী উত্তরাঞ্চল ছাড়া বেঙ্গল ওয়াটার মেশিন বৃহত্তর ঢাকা অঞ্চল, বড় শহর ও শিল্পাঞ্চলেও ভালোভাবে কাজ করছে না।'

ভূগর্ভস্থ পানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আনোয়ার ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা এই গবেষণায় একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে অবদান রেখেছেন।

তিনি সতর্ক করে বলেন, 'তথ্য-উপাত্ত বলছে, আমাদের অবশ্যই ভূগর্ভস্থ পানি খুব বিচক্ষণতার সঙ্গে ও সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করতে হবে। নির্বিচারে পানি উত্তোলন বিপর্যয় ডেকে আনবে।'

বিশ্বজুড়ে এই গবেষণাটি এত প্রশংসিত হওয়ার কারণ হচ্ছে এর ভিত্তি। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ৩০ বছরেরও বেশি সময় কঠোর পরিশ্রম করে এর তথ্য সংকলন করেছে।

গত ৬০ বছর ধরে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কূপে ১ হাজারেরও বেশি পর্যবেক্ষক ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পর্যবেক্ষণ ও রেকর্ড করছেন। গবেষকরা ৪৬৫টি অগভীর পর্যবেক্ষণ কূপ থেকে লাখো ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাপ ব্যবহার করেছেন (বেশিরভাগই ২৫ থেকে ৭০ মিটার গভীরতায়, যেখান থেকে সেচের জন্য পাম্প করা হয়)।

অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, 'ওই মাত্রার চেয়ে গভীর ভূগর্ভস্থ পানি সেচের জন্য ব্যবহার করা উচিত না। কারণ বৃষ্টির মাধ্যমে ওই স্তরে (২৫০-৩০০ মিটারের বেশি) পানি পুনরায় প্রবেশে শত থেকে হাজারো বছর সময় লাগে।'

মোহাম্মদ শামসুদ্দুহা, অধ্যাপক মতিন ও অধ্যাপক আনোয়ার ছাড়াও এই গবেষণায় অংশ নিয়েছেন ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের রিচার্ড জি টেইলর, মো. ইজাজুল হক ও সারা নওরিন।

Comments

The Daily Star  | English

Leading univs withdrawing from cluster system

Session delays, irregularities, and lack of central planning cited as reasons

11h ago