পুলিশ বলছে চালকের অসচেতনতা দায়ী, বিশেষজ্ঞদের মতে সমন্বয়ের অভাব
ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে গত সোমবার ভোরে কাভার্ড ভ্যানের ধাক্কায় প্রাণ হারান প্রাইভেট কার আরোহী পান্না বণিক। ৩৫ বছর বয়সী এই যুবক কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থেকে সপরিবারে মুন্সীগঞ্জের মাওয়ায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। ফিরতি পথে তিনি দুর্ঘটনার কবলে পড়েন।
এর আগের দিন, রোববার ভোরেও মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার হাসাড়া ইউনিয়নের ষোলঘর এলাকায় যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, প্রাইভেট কার, পিকআপ ভ্যান ও কাভার্ড ভ্যানসহ ১০টি গাড়ির সংঘর্ষ হয়। দুর্ঘটনায় মো. ফরহাদ হোসেন (৪০) নামে এক গাড়িচালক নিহত হন।
সপ্তাহ শেষ না হতেই আবারও ঘটে দুর্ঘটনা। এবার ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের টোলপ্লাজায় থেমে থাকা প্রাইভেট গাড়ির পেছনে বাসের বেপরোয়া ধাক্কায় কমপক্ষে পাঁচ জন নিহত ও পাঁচজন আহত হন। বাসের ধাক্কায় প্রাইভেট কারটি দুমড়েমুচড়ে যায়। প্রাইভেট কারসহ একটি মোটরসাইকেল ও একটি মাইক্রোবাসকে ধাক্কা দিয়ে তারপর বাসটি থামে।
কেবলমাত্র ফায়ার সার্ভিসের হিসাবেই গত বছরের ২২ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ২৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ৬৩টির বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন পাঁচ নারীসহ ১৬ জন, আহত হয়েছেন ৮০ জন।
শ্রীনগর ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তা দেওয়ান আজাদ হোসেন বলেন, 'আমরা দুর্ঘটনার সময় সড়কে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে যত জন হতাহতের নাম নিতে পেরেছি, শুধু তাদের সংখ্যাই আমাদের কাছে আছে। এর বাইরে এমন অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে, যেখানে আমরা পৌঁছানোর যাওয়ার আগেই হতাহতদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যে কারণে তাদের তথ্য আমাদের কাছে নেই।'
হতাহতের প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে মত দেন আজাদ।
প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙা পর্যন্ত ৫৫ কিলোমিটার মহাসড়ক এক্সপ্রেসওয়েতে উন্নীত করা হয়েছে। নিরাপদে ও দ্রুত গন্তব্যে পৌঁছাতে মহাসড়কটি এক্সপ্রেসওয়েতে রূপান্তরিত করা হয়।
অল্প সময়ে এখন গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব হলেও দুর্ঘটনা বেড়েছে আগের চেয়ে অনেক বেশি। এই প্রসঙ্গে হাইওয়ে পুলিশের গাজীপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার ড. আ ক ম আকতারুজ্জামান বসুনিয়া বলেন, 'আগে যখন মহাসড়ক ভাঙা ছিল, তখন দুর্ঘটনা কম হতো। এখন ভালো সড়কে চালকরা দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছেন। এতে দুর্ঘটনা বাড়ছে।'
'গতি নিয়ন্ত্রণ করতে দিনে স্পিডগান ব্যবহার করছে হাইওয়ে পুলিশ। বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালালে মামলা দেওয়া হচ্ছে,' জানান তিনি।
পুলিশের অসহায়ত্ব তুলে ধরে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, 'দুই-চারজন অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি চালালে মামলা দিয়ে থামানো যায়। এখানে সবাই দ্রুত গতিতে গাড়ি চালাচ্ছে। কয়জনকে মামলা দেবেন?'
তিনি বলেন, 'মানুষের সচেতনতার বিকল্প নেই। আমরা চালকদের সতর্ক করতে কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। গত তিন দিন ধরে পোস্তগোলা এলাকায় মাইকিং করে চালকদের সতর্ক করা হচ্ছে, তারা যেন অতিরিক্ত গতিতে গাড়ি না চালান। আমরা লিফলেটও বিতরণ করছি। টোলপ্লাজার মাইকেও সতর্ক করা হচ্ছে।'
পুলিশে জনবল সংকটের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, 'হাইওয়ে পুলিশসহ সারা বাংলাদেশেই পুলিশের জনবল সংকট রয়েছে। তারপরও আমরা দুটি পেট্রোল টিমের মাধ্যমে এক্সপ্রেসওয়েতে টহল দিয়ে থাকি, এটা যদিও যথেষ্ট নয়। যদি টোলপ্লাজায় ফিক্সড টিম রাখা যেত তাহলে ভালো হতো।'
'মহাসড়কে মার্কিং ঠিক মতো না থাকা বা অন্যান্য সমস্যাগুলো দুর্ঘটনার প্রধান কারণ না, চালকদের অসচেতনতা, দায়িত্বশীল না হওয়া ও যানবাহনের অসুস্থ প্রতিযোগিতাই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ,' মনে করেন তিনি।
বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. আসিফ রায়হান বলেন, 'কোনো দুর্ঘটনা একটি কারণে ঘটে না। সড়ক, যানবাহন ও ব্যবহারকারী—এই তিনটি উপাদানের সমন্বয়ে যদি ব্যাঘাত ঘটে তাহলে দুর্ঘটনা ঘটে। একটি উপাদানে সিস্টেম ত্রুটি থাকলে দুর্ঘটনা ঘটে। কাজেই এককভাবে শুধু চালকদের দায়ী না করে সিস্টেমকে দায়ী করা উচিত।'
টোলপ্লাজায় দুর্ঘটনা সম্পর্কে তিনি বলেন, 'টোলপ্লাজায় এভাবে ম্যানুয়ালি টোল সংগ্রহ না করে অটোমেটিক টোল কালেকশন সিস্টেমের মাধ্যমে টোল আদায় করা সম্ভব। সেটা করা যেতে পারে।'
কুয়াশার কারণে দুর্ঘটনার ব্যাপারে তিনি বলেন, 'ফগ লাইটের ব্যবহার, সড়কে পেভমেন্ট মার্কিং, স্পিড লিমিট প্রয়োজন অনুসারে বাড়ানো-কমানোর মাধ্যমে (স্পিড অ্যাডজাস্টমেন্ট) যান চলাচল নিরাপদ করা যেতে পারে। তা ছাড়া, এক্সপ্রেসওয়ের সব স্থানে একই স্পিড লিমিট হওয়ার কথা না। সেটা স্থান ভেদে সমন্বয় করা উচিত।'
Comments