অপর্যাপ্ত অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা: ঢাকার প্রতি ৪ মার্কেটের ৩টিই ঝুঁকিপূর্ণ

৫৮টি মার্কেটের মধ্যে নয়টি ‘অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ’
গতকাল রাজধানীর গাউসিয়া মার্কেট থেকে ছবিটি তোলা। ছবি: রাশেদ সুমন/ স্টার

ঢাকা শহরের প্রতি চারটি মার্কেটের মধ্যে তিনটিতে যথাযথ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই বলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

ফায়ার সার্ভিস গত বছর ৫৮টি মার্কেট ও শপিং আর্কেড পরিদর্শন করে এর মধ্যে নয়টিকে 'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ' এবং ৩৫টি 'ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে খুঁজে পায়।

বাকি ১৪টিতে অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা সন্তোষজনক ছিল বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

দ্য ডেইলি স্টার প্রতিবেদনটির একটি অনুলিপি পেয়েছে। প্রতিবেদনটি এখনও প্রকাশ করা হয়নি।

ফায়ার সার্ভিস প্রবেশ ও বেরোনোর সিঁড়ির সংখ্যা, সিঁড়িতে কতটা স্থান, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রের সংখ্যা, ফায়ার হাইডেন্ট্র এবং জলাধারের সক্ষমতার মতো মানদণ্ডের ভিত্তিতে 'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ' বা 'ঝুঁকিপূর্ণ' কাঠামোতে শ্রেণিবদ্ধ করে।

ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মঈন উদ্দিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'এটা বিপজ্জনক। তবে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সচেতনতা ও সমন্বিত প্রয়োগ প্রচেষ্টা এই পরিস্থিতির উন্নতি করতে পারে।'

তিনি দাবি করেন, ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাগুলো বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড মেনে চলে না।

গত দুই দিনে চারটি মার্কেট ঘুরে এই সংবাদদাতারা দেখেন, সেখানে পর্যাপ্ত নির্বাপক যন্ত্রের অভাব রয়েছে। কারো কারো অগ্নিনির্বাপণ পথ বাধাগ্রস্ত করে রাখা হয়েছে।

৩১৫টিরও বেশি দোকান সম্বলিত তিন তলা গাউসিয়া মার্কেটে প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য সাতটি সিঁড়ি থাকলেও কোথাও কোথাও কাপড়ের স্তূপের কারণে সেগুলো বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

দেয়ালে হাতে গোনা কয়েকটি অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র পাওয়া গেছে।

ফায়ার হাইড্রেন্ট ও অপর্যাপ্ত পানির মজুদ না থাকায় ২০২০ সালে এবং ২০২৩ সালের এপ্রিলে আবারও মার্কেটটিকে 'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে চিহ্নিত করে ফায়ার সার্ভিস।

গাউছিয়া মার্কেট দোকান মালিক সমিতির নেতা রফিকুল ইসলাম দাবি করেন, এখন তাদের পানির পর্যাপ্ত মজুদ ও প্রশস্ত সিঁড়ি রয়েছে। তিনি মনে করেন, মার্কেটটি শুধুমাত্র এ কারণে 'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ' কারণ এতে পুড়ে যাওয়ার মতো পণ্য আছে।

সিঁড়িতে কাপড়ের স্তূপ সম্পর্কে তিনি দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, ঈদকে সামনে রেখে দোকান মালিকরা অতিরিক্ত কাপড় নিয়ে আসেন বলেই এমনটা হয়। শিগগিরই সেগুলো সরানো হবে এবং আরও অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র আনা হবে।

'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ' রাজধানী সুপার মার্কেটে প্রায় দেড় হাজার দোকান থাকলেও কোনো ফায়ার হাইড্রেন্ট নেই। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ৩০০ দোকানে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক দোকান মালিক বলেন, 'অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম থাকার কথা কেউ আমাদের জানায়নি।'

একজন প্রতিবেদক কথা বলতে চাইছেন জানান পর দোকান মালিক সমিতির নেতা ফজনুন হক বিপ্লব কল কেটে দেন এবং এর পরে আরও কয়েকবার কল করা হলেও তিনি ধরেননি।

সদরঘাটের 'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ' পাঁচ তলা শরীফ মার্কেটে তিনটি সিঁড়ি থাকলেও দেয়ালে কোনো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দেখা যায়নি।

মার্কেটের মালিক সমিতির নেতারা এ বিষয়ে পত্রিকার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি।

অন্য ছয়টি 'অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ' মার্কেট হলো বঙ্গবাজারের বরিশাল প্লাজা মার্কেট, লালবাগের আলাউদ্দিন মার্কেট, চকবাজারের শহীদুল্লাহ মার্কেট ও শাকিল আনোয়ার টাওয়ার, সদরঘাটের মায়া কাটারা এবং সিদ্দিক বাজারের রোজেনিল ভিস্তা।

রোজেনিল ভিস্তা দোকান মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ বলেন, 'আমাদের মার্কেটে কোনো দাহ্য পদার্থ নেই। তাই, আমরা বিশ্বাস করি না আমাদের মার্কেট খুব বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।'

ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু নাঈম মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ ভবনের পারমিট, অনুমোদন ও লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবের দিকে ইঙ্গিত করেন।

তিনি বলেন, 'যখন কোনো ঘটনা ঘটে, তখন একটি প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানকে দায়ী করে।'

তার মতো একই কথা বলেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি আদিল মোহাম্মদ খান। তিনি বলেন, 'আমাদের নগরীর বেশির ভাগ ভবনে কার্যকর অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও অগ্নি নিরাপত্তা পরিকল্পনা নেই।'

তিনি বলেন, প্রায় সব দুর্ঘটনার পর দেখা যায় ফায়ার সার্ভিস ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ জানিয়ে কর্তৃপক্ষকে নোটিশ দিয়েছিল। কিন্তু কোনো ব্যবস্থাই তারা নেয়নি।

যোগাযোগ করা হলে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন) লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, 'এনফোর্সমেন্ট পাওয়ার না থাকায় আমরা চাইলেও অনেক কিছু করতে পারছি না। আমাদের যদি একজন ম্যাজিস্ট্রেট থাকতো তাহলে আমরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে পারতাম এবং ব্যবস্থা নিতে পারতাম।'

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) অগ্নি নিরাপত্তা বিধি লঙ্ঘনকারী ভবনের তালিকা না পাঠানোর জন্য ফায়ার সার্ভিসকে দায়ী করেছে।

রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, 'গত বছর আমরা রাজধানীর ৬৯১টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা তৈরি করেছিলাম। আমরা সম্প্রতি ২০টি ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট পরিদর্শন করেছি এবং তাদের মৌখিক সতর্কবার্তা দিয়েছি। তালিকা চূড়ান্ত করে শিগগিরই আমরা অভিযান শুরু করব।'

সারাদেশের পরিস্থিতি

ফায়ার সার্ভিস ২০২৩ সালে সারাদেশে ৫ হাজার ৩৭৪টি মার্কেট ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে। এর মধ্যে ৩ হাজার ২৫৬টিতে সন্তোষজনক অগ্নি নিরাপত্তা ব্যবস্থা পাওয়া গেছে।

বাকিদের মধ্যে ৪২৪টিকে 'অতি ঝুঁকিপূর্ণ' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস বলছে, সারাদেশে ৩৯ দশমিক ৪১ শতাংশ ভবন 'ঝুঁকিপূর্ণ'। ২০২২ সালে 'ঝুঁকিপূর্ণ' ভবনের হার ছিল ৫৩ দশমিক ৭৮ শতাংশ।

ঝুঁকিপূর্ণ কিছু ভবন মালিকদের বারবার নোটিশ দেওয়া হলেও সমস্যার সমাধান হয়নি।

লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজুল বলেন, যেসব ভবন কর্তৃপক্ষ আমাদের নোটিশে কর্ণপাত করেনি, তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

Comments