মীরসরাইয়ে ড্রেজারডুবি

উপার্জনক্ষমদের হারিয়ে মৃত ৮ শ্রমিকের পরিবার দিশেহারা

বাসার-হাওলাদার
মীরসরাইয়ে ড্রেজারডুবিতে মৃত বাসার হাওলাদারের মা (সর্বডানে), স্ত্রী ও ছেলে। ছবি: স্টার

ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের কবলে পড়ে চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে ড্রেজার ডুবির ঘটনায় পটুয়াখালীর মৃত ৮ পরিবারে নেমে এসেছে অমানিশার অন্ধকার। একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিদের হারিয়ে পরিবারগুলো এখন দিশেহারা।

'নুন আনতে পান্তা ফুরানো'র সংসার কেমনে চলবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই।

পটুয়াখালী সদর উপজেলার জৈনকাঠী গ্রামের শাহীন মোল্লা, ইমাম মোল্লা, মাহমুদ মোল্লা, তারেক মোল্লা, আল আমিন, বাসার হাওলাদার, জাহিদ ফকির ও আলম সরদার—এই ৮ শ্রমিক বালুর ড্রেজার উল্টে মারা যান।

স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় তাদের মরদেহ উদ্ধার করে পটুয়াখালীতে দাফন করা হয়।

তাদের একজন আল আমিন (২০)। মা হাসিনা বেগমের একমাত্র সন্তান, একমাত্র অবলম্বন। মায়ের মুখে দু'মুঠো ভাত তুলে দিতে উচ্চমাধ্যমিক পাশ আলামিন ওই ড্রেজারে শ্রমিকের কাজ করতো। মৃত ছেলের কথা বলতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন হাসিনা।

শাহিন-ও-ইমাম-মোল্লার-মা
মৃত শাহিন মোল্লা ও ইমাম মোল্লার মা হাসিনা বেগম। ছবি: স্টার

কাঁদতে কাঁদতে বলেন, 'এখন আমি কাকে নিয়ে বাঁচবো? কিভাবে দিন কাটবে?'

বাবার সংসারে টানাপোড়েন থাকায় ছোটবেলায় ঢাকায় গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন হাসিনা। সেখানে রিকশাচালক সিকান্দার হাওলাদারের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। তিনি যখন ৭ মাসের অন্তঃসত্ত্বা তখন স্বামীকে নিয়ে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন। পরে হাসিনাকে এখানে রেখে নিরুদ্দেশ হয়ে যান সিকান্দার।

হাসিনার কোল জুড়ে আসে আলামিন। বাবার বাড়িতে দিন কাটে তার। ছেলেকে মানুষ করতে কখনো মাটিকাটা, কখনো অন্যের বাড়িতে কাজ করাসহ হাড়ভাঙা পরিশ্রমে ক্লান্ত তিনি। মায়ের মুখে খাবার তুলে দিতেই বছরখানেক আগে প্রতিবেশী শ্রমিকদের সঙ্গে আলামিনও মীরসরাইয়ে বালুর ট্রেজারে কাজে যান।

একই ঘটনায় মৃত ২ সহোদর শাহিন মোল্লা ও ইমাম মোল্লার পরিবারেও চলছে শোকের মাতম। ২ সন্তানকে হারিয়ে তাদের মা হাসিনা বেগম পাগল-প্রায়। শাহীন মোল্লা স্ত্রী খাদিজা, ৩ সন্তান রেখে গেছেন। ইমাম মোল্লা বিয়ে করেছেন ৪ মাস আগে।

শাহিন আর ইমামের উপার্জনেই চলত ৭ সদস্যের সংসার। শাহীনের স্ত্রী খাদিজা বেগম অন্তঃসত্ত্বা।

তাদের মায়ের আক্ষেপ, 'আল্লাহ আমাকে নিয়ে ২ সন্তানকে রেখে গেলে এত কষ্ট পেতাম না। নাতিগুলো এতিম হলো। কে তাদের মুখে খাবার তুলে দেবে?'

তাদের বাবা আনিস মোল্লাও নির্বাক।

হাসিনা বেগম
মৃত আল আমিনের (২০) মা হাসিনা বেগম। ছবি: স্টার

নিহত অপর শ্রমিক আলম সরদার রেখে গেছেন বৃদ্ধ মা-বাবা, স্ত্রী ও ২ মেয়ে। বাবা নুরুল হক হাওলাদার আহাজারি করে বলছেন, 'কিভাবে সংসার চলবে? বয়স হয়েছে, কাজ করতে পারি না। আল্লাহ আমার ছেলেকে রেখে আমাকে কেন নিলো না?'

মৃত বাসার হাওলাদারের বাড়িতে দেখা গেছে করুণ দৃশ্য। ৩ মেয়ে, ১ ছেলে, স্ত্রী ও বাবা-মাকে রেখে গেছেন তিনি। ২ বছরের ছেলে সাব্বির জন্ম থেকেই হৃদরোগে আক্রান্ত। তার জন্য প্রতি ৬ মাসে ১০ হাজার টাকার ওষুধ কিনতে হয়। মেয়ে মিম অষ্টম শ্রেণি ও ফারজানা ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। এখন ওদের লেখাপড়া বন্ধ করা ছাড়া উপায় নেই। মা ফুলবানুর আহাজারি—'আল্লাহ কেন আমাকে এখনো বাঁচিয়ে রাখলো?'

মৃত জাহিদ ফকির সাড়ে ৩ বছরের ছেলে জিহাদ, স্ত্রী জাকিয়া ও মা রাহিমাকে রেখে গেছেন। রাহিমার আহাজারি—'এখন কিভাবে বাঁচব? আয়ের পথ বন্ধ।'

মৃত তারেকের বাবা আব্দুর রহমান মোল্লা বুক চাপড়ে আহাজারি করে বলছেন, 'আমার বাবা আমাদের মুখে ভাত তুলে দিতে ড্রেজারে কাজে গেছে। তার এই যাওয়াই যে জনমের যাওয়া হবে জানলে যেতে দিতাম না।'

মৃত মাহমুদ মোল্লাও তার ৫ সদস্যে সংসার চালানোর জন্য গিয়েছিলেন ওই ড্রেজারে কাজ করতে। মা মনোয়ারার কান্না যেন থামছেই না। 'আমার বাবা সর্বশেষ ২ মাস আগে যেদিন গিয়েছে আমাকে চুমু দিয়ে বলেছে—মা আমার জন্য চিন্তা করো না।'

এসব মৃত শ্রমিকদের পরিবারে চলছে চরম অনটন। পটুয়াখালী জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে অর্থ সাহায্য দেওয়া হয়েছে। আর কোনো সাহায্য জোটেনি। তারা সরকারের সহযোগিতা আশায় আছেন।

স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান এডভোকেট সৈয়দ মোহাম্মাদ মহসিন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শ্রমিক পরিবারগুলোর আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। প্রত্যেকের সংসারে ওরাই ছিলেন একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তাদেরকে সাধ্যমত সহযোগিতা দেওয়া হবে।'

পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন ডেইলি স্টারকে জানান, সরকারের পক্ষ থেকে সামান্য পরিমাণ সহযোগিতা করা হয়েছে।

এসব পরিবারকে সাহায্য করতে সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Bangladesh, Pakistan, China launch trilateral cooperation mechanism

A working group will be formed to follow up on and implement the understandings reached during the meeting

1h ago