যুক্তরাষ্ট্রের নতুন উদ্বেগ চীনের ‘সিগাল’
মার্কিন অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠান ও রাজনীতিবিদদের আতংক ও উদ্বেগের কারণ হয়েছে সিগাল নামের একটি ছোটখাটো, সাশ্রয়ী মূল্যের চীনা ইলেকট্রিক গাড়ি।
গতকাল সোমবার এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা এপি।
গত বছর চীনের অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠান বিওয়াইডি এই গাড়ি বাজারে আনে। সিগাল গাড়ির দুইটি মডেল চীনে ১০ ও ১২ হাজার ডলারে বিক্রি হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই গাড়ির ফিচার এবং নির্ভরযোগ্যতা এর চেয়ে তিন গুণেরও বেশি দামে বিক্রি হওয়া মার্কিন গাড়ির চেয়েও বেশি।
যুক্তরাষ্ট্রের দুঃস্বপ্ন চীনের বিওয়াইডি
আমদানি নীতিমালা ও করের কারণে আপাতত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে এই গাড়ি প্রবেশের সম্ভাবনা কম। বিশ্লেষকদের ধারণা, আমদানি করা হলে ১২ হাজার ডলারে বিকোতে পারে সিগাল।
তবে নীতি ও কর দিয়ে চীনের ইভি (ইলেকট্রিক ভেহিকেল) বিপ্লবকে বেশিদিন ঠেকানো যাবে না বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা। একই কায়দায় ৭০'র দশকে মার্কিন গাড়ির বাজার দখল করে নিয়েছিল হোন্ডা ও টয়োটার মতো জাপানি নির্মাতারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এবার চীনের বিওয়াইডি, যার নামের অর্থ বিল্ড ইওর ড্রিমস (আপনার স্বপ্নকে বাস্তবে পরিণত করুন) মার্কিন অটোমোবাইল খাতের জন্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়াতে পারে।
ফিলাডেলফিয়া ভিত্তিক অটোফোরকাস্ট সলিউশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট স্যাম ফিওরানি বলেন, 'প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে ওদের (চীনা নির্মাতা) দিকে যদি কোনো প্রতিষ্ঠান মনোযোগ না দেয়, তাহলে তারা যখন বাজারে আসবে, তখন সেসব প্রতিষ্ঠান নির্মূল হয়ে যাবে।'
'বিওয়াইডি মার্কিন বাজারে প্রবেশ করবে কী না, সেটা প্রশ্ন নয়। কবে করবে, সেটাই এখন প্রশ্ন', যোগ করেন তিনি।
১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের সম্ভাবনা
মার্কিন রাজনীতিবিদ ও গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলো ইতোমধ্যে চীনা ইভিকে গুরুতর হুমকি হিসেবে দেখছে। বাইডেন প্রশাসন মঙ্গলবার চীন থেকে আমদানি করা ইভির ওপর ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করবে বলে প্রত্যাশা করছে সংশ্লিষ্টরা। যুক্তি হিসেবে বলে হচ্ছে, চীনা প্রতিষ্ঠানগুলো মার্কিনীদের চাকরি ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করে।
এপিকে সূত্ররা জানিয়েছে, ইভি ছাড়াও চীনের গ্রিন এনার্জি সংক্রান্ত পণ্য আমদানিতেও শুল্ক বসানো হবে।
মার্কিন গাড়ি নির্মাতাদের একটি জোট জানিয়েছে, সরকার চীনের ইভিকে ভর্তুকি দিলে 'মার্কিন অটোমোবাইল খাত অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যাবে'।
এ বছরের শুরুতে টেসলার প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক এই খাতের বিশ্লেষকদের বলেন, চীনার ইভি এতোটাই উন্নত যে বাণিজ্যিক প্রতিবন্ধকতা না থাকলে তারা 'বিশ্বের অন্য সব অটোমোবাইল প্রতিষ্ঠানকে দুমড়ে মুচড়ে দেবে।'
সিগালের সঙ্গে মার্কিন গাড়ির তুলনা
ডেট্রয়টের পশ্চিমে কেয়ারসফট গ্লোবাল নামের প্রতিষ্ঠান গবেষণা উদ্যোগের অংশ হিসেবে একটি গাড় সবুজ রঙের বিওয়াইডি সিগাল গাড়ি ভেঙে আবারও জোড়া দিয়েছে।
জেনারেল মোটর্সের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী ও কেয়ারসফটের প্রেসিডেন্ট টেরি ওয়েচৌস্কি বলেন, 'এই গাড়িটি যুক্তরাষ্ট্রের পরিবহন শিল্পকে ঘুম থেকে জেগে ওঠার আহ্বান জানাচ্ছে। স্বল্প খরচের ইভি নির্মাণের দিক দিয়ে চীনের চেয়ে বহু বছর পিছিয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র।'
৪৫ বছর ধরে পরিবহন খাতে কাজ করছেন টেরি। সিগাল গাড়িটি নিরীক্ষার পর জানান, 'চীনের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে আমাদেরকে কাজের ধারায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হবে।'
সিগালের ওজন মাত্র এক হাজার ২৪০ কেজি, যা সমমানের শেভ্রোলে বোল্ট গাড়ির চেয়ে ৪০৮ কেজি কম ওজনের।
তিনি মন্তব্য করেন, 'সিগালের ডিজাইনে তেমন কোনো চাকচিক্য না থাকলে এটি মানসম্পন্ন। দরজাগুলো খুব সহজে খোলে ও বন্ধ হয়। ছাই বর্ণের কৃত্রিম চামড়ার সিটগুলো রুচিশীল। এ ধরনের সিট সাধারণত আরও বিলাসবহুল গাড়িতে দেখা যায়। এই গাড়িতে ছয়টি এয়ার ব্যাগ, পেছনের চাকার ডিস্ক ব্রেক ও ইলেক্ট্রনিক স্ট্যাবিলিটি কন্ট্রোল ফিচার রয়েছে।
গাড়িটি প্রায় নিঃশব্দে চলে এবং মোড় ঘোড়া বা উঁচুনিচু রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়েও এটি বেশ স্থিতিশীল ও সাবলীল ভাবে চলেছে, যা সাধারণত আরও দামী গাড়ির ফিচার।
সিগালের সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ১৩০ কিলোমিটার, যা একে মহাসড়কে চলার উপযোগিতা দিয়েছে।
বিশ্ববাজারে বিওয়াইডির অবস্থান
লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে ডলফিন মিনি নামে এই গাড়িটি বিক্রি করে বিওয়াইডি। সেখানে দাম ধরা হয়েছে প্রায় ২১ হাজার ডলার।
ইউরোপের আরও বড় মডেলের গাড়ি বিক্রি করে বিওয়াইডি, যেমন ৫০ হাজার ডলারের সিল।
ক্যালিফোর্নিয়ায় ইতোমধ্যে ইলেকট্রিক বাস নির্মাণ করছে বিওয়াইডি। প্রতিষ্ঠানের দুই কর্মকর্তা এ বছরের শুরুতে জানিয়েছেন, তারা মেক্সিকোতে একটি কারখানা খোলার চিন্তা করছেন। তবে সেটি মেক্সিকোর বাজারের জন্য।
২৭ দশমিক ৫ শতাংশ আমদানি করের কারণেই মূলত যুক্তরাষ্ট্রের বাজার থেকে দূরে আছে বিওয়াইডি। সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৫ শতাংশ কর আরোপ করেন। জো বাইডেন এই নীতি বদলাননি।
ট্রাম্প দাবি করেছেন, বাইডেন চীন থেকে ইভি আমদানির সুযোগ করে দেবেন এবং এতে মার্কিন কারখানায় চাকরি হারাবেন অসংখ্য কর্মী।
কংগ্রেসের কিছু সদস্য চীন থেকে গাড়ি আমদানি নিষিদ্ধ বা বড় আকারে কর আরোপের জন্য বাইডেনকে অনুরোধ জানিয়েছেন। তবে এখনো এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসেনি।
Comments