কামরুদ্দীন আহমদরা কেন থাকেন অবহেলিত
বৈষম্যহীন সমাজ গঠনে আজ প্রত্যয়ী দেশের তরুণ সমাজ। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের ভেদ ঘোচাতে বদ্ধপরিকর তারা। শোষণ, নির্যাতন, দুনীতির বিরুদ্ধে তারা জনমত গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। দেশের মানুষকে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। স্বপ্নসারথিদের অধিকাংশই মধ্যবিত্ত পরিবারের বাসিন্দা। বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের জীবন-আল্লেখ্যে অবশ্য চর্চার নাম কামরুদ্দীন আহমদ। তিনি মধ্যবিত্ত শ্রেণি বিকাশের সংগ্রামের সারথি ছিলেন। সারাজীবন লিখেছেন মধ্যবিত্তের শ্রেণিসংগ্রাম ও নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাতের ইতিহাস। বর্তমান প্রজন্ম এই লেখককে অধ্যয়ন না করলে একটি অধ্যায় তাদের কাছে অজানা থাকবে।
কামরুদ্দীন আহমেদের লেখনীতে সর্বদা সুষম সমাজ প্রতিষ্ঠার নির্দেশনা আছে। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর লেখার গুরুত্ব সমধিক। কালোত্তীর্ণ এসব লেখা প্রজন্মকে নীতিশিক্ষার দীক্ষায় অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু দুঃখের বিষয় তিনি নিজেই বৈষম্যের শিকার। এত বড় লেখক হয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি পূর্ববর্তী সরকারকে কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠানকে। জনকল্যাণে নিবেদিত মানুষটির অধরাই থেকে গেছে রাষ্ট্রীয় সম্মান। তাঁকে নিয়ে নেই আলাপ আলোচনাও।
অবাক বিস্ময়ে আমরা দেখি, স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক বা জাতীয় সর্বোচ্চ কোনো পদক তাঁর ঝুলিতে নেই। আত্মপ্রচারবিমুখতাই কি এর অন্যতম কারণ? অথবা কোনো কিছু? কারণ যা-ই হোক না কোনো এর দায় আমরা এড়াতে পারি না। বর্তমান তরুণ সমাজের হাতে দেশগঠনের যে প্রত্যয় ব্যক্ত হয়েছে,তাতে কামরুদ্দীন আহমেদেও মতন গুণি মানুষকে সম্মান করার সময় এসেছে। পূর্বতন সরকারের ন্যায় দলীয় অন্ধতা কিংবা চাটুকারিতার আবহে বন্দী না থেকে বাঙালির মধ্যবিত্ত শ্রেণির বৈষম্যহীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা 'কামরুদ্দীন আহমেদ' পাঠ ও মূল্যায়নে সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া প্রয়োজন।
হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি প্রবাহিত হয়েছে শতধারায়। অনুসন্ধানী ঐতিহাসিক ও ইতিহাসবেত্তাগণ দেখিয়েছেন-বিত্তের মাধ্যমে নয়, চিত্তের মাধ্যমেই গড়ে ওঠেছিল এখানকার সমাজ। কিন্তু বর্তমানে এর উল্টোপ্রেক্ষিত লক্ষণীয়। অর্থ ক্রীড়নক হিসেবে উপস্থিত হয়েছে সমাজশ্রেণিবিন্যাসে। অর্থাৎ বিত্তই এখন চিত্তকে প্রভাবিত করে চলেছে। তার দুর্বার গতি সমাজ-শ্রেণির ওপর প্রতিফলিত। অর্থ-বিত্তের ভেদে সমাজে উচ্চ, মধ্য ও নিম্নবিত্ত তাই অপ্রতিরোধ্য শ্রেণি। সামাজিক স্তর বিন্যাসের উদ্ভব ও কারণ নিয়ে গবেষণা সুলভ নয়- বিশেষ করে বস্তুনিষ্ঠভাবে। কামরুদ্দীন আহমদ ব্যতক্রমী উচ্চারণ। জীবনব্যাপী তিনি বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের উদ্ভব ও বিকাশের কারণ অনুসন্ধান করেছেন। তার লেখায় আবেগ আছে দেশের প্রতি, শ্রেণিসংগ্রামে নিষ্পেষিত মানুষের প্রতি। কিন্তু তাতে পক্ষপাতিত্ত্ব নেই। ব্যক্তি চিন্তাকে চাপিয়ে দেননি মধ্যবিত্তের সিদ্ধান্তের বেলায়। বরং বস্তুনিষ্ঠভাবে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশের পর্বগুলির কারণ অনুসন্ধানে ব্যাপৃত হয়েছেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু। পাঠক বা ছাত্রের জন্য কামরুদ্দীন আহমদের 'পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি একটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ। বিশ শতকের শুরু থেকে ষাট দশক পর্যন্ত এতদঞ্চলের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের এমন বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ আর লিখিত হয়নি বললেই চলে। যে কালের কথা লেখক এখানে উপস্থাপন করেছেন বহুলাংশে তিনি তাঁর প্রত্যক্ষদর্শী, অনেক ঘটনার সাক্ষী, এমনকি শরিকও।
কামরুদ্দীন আহমদের জন্ম বঙ্গভঙ্গের পরের বছরে-১৯১২ খ্রিস্টাব্দে, মুন্সিগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানায়। আইনজীবী, রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, লেখক-বহুগুণে গুণান্বিত কামরুদ্দীন সময়ের প্রয়োজনীয় মানুষ হিসেবে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন কর্মতৎপরতায়। ঐতিহাসিক বলয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন; দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, লাহোর প্রস্তাব, দেশভাগ, ভাষা-আন্দোলন, স্বাধীনতা অন্দোলন- প্রভৃতি প্রেক্ষাপটে তিনি সংশ্লিষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে শিক্ষালাভে ভাটা পড়েনি। ১৯২৯ সালে তিনি বরিশাল জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্টিক এবং বিএম কলেজ থেকে আই.এ পাস করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে বি.এ অনার্স এবং এম.এ পাশ করেন যথাক্রমে ১৯৩৪ ও ১৯৩৫ সালে এবং আইনশাস্ত্রে ১৯৪৪ সালে ডিগ্রি লাভ করেন। ঢাকার আরমানিটোলা স্কুলের শিক্ষক হিসেবে তার কর্মজীবনের সূচনা হলেও পরবতীকালে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ এবং কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন শেষে আইন ব্যবসায় আত্মনিযোগ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে সরাসরি তাঁর দেশপ্রেমের পরিচয় বহন করে। পাকিস্তানি সরকারের রোষানলে পড়েন তিনি। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কতৃক গ্রেফতার হন- মুক্তিপান স্বাধীনতার পর। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী কামরুদ্দীন ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক এবং বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতির পদ অলংকৃত করেন।
প্রতিভাধর কামরুদ্দীন বহুগুণে আখ্যায়িত হলেও লেখক হিসেবে তার স্বাতন্ত্র্য অনন্য। পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি (১৯৭৬), বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ, স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর (১৯৮২). বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী, এ সোশাল হিস্টোরি অফ বেঙ্গল (বাংলার একটি সামাজিক ইতিহাস) (১৯৭৫), এ সোশ-পলিটিক্যাল হিস্টোরি অফ বেঙ্গল অ্যান্ড দ্য বার্থ অফ বাংলাদেশ (বাংলার একটি সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস ও বাংলাদেশের জন্ম) প্রভৃতি গ্রন্থ তাকে লেখক সত্তা হিসেবে বাঁচিয়ে রেখেছে। এসব গ্রন্থে বহুমুখি কণ্ঠস্বর উচ্চারিত হলেও মোহনা এক-তা হলো জনমানুষের মুক্তি। বাঙালি মধ্যবিত্তকে তিনি কেবল সমাজগঠনের উপাদান হিসেবে বিবেচনা করেনি। সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংগ্রামে তাদের গুরুত্বপূর্ণ অবদানের চিত্র তুলে ধরেছেন। এ ধারায় তিনি সফল। তাই তাকে 'মধ্যবিত্তের বস্তুনিষ্ঠ লেখক' বলে প্রতিপন্ন করলে অত্যুক্তি হবে না।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সামাজিক ইতিহাসের অনুসন্ধিৎসু। পাঠক বা ছাত্রের জন্য কামরুদ্দীন আহমদের 'পূর্ব বাংলার সমাজ ও রাজনীতি একটি অবশ্যপাঠ্য গ্রন্থ। বিশ শতকের শুরু থেকে ষাট দশক পর্যন্ত এতদঞ্চলের সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাসের এমন বস্তুনিষ্ঠ বিবরণ আর লিখিত হয়নি বললেই চলে। যে কালের কথা লেখক এখানে উপস্থাপন করেছেন বহুলাংশে তিনি তাঁর প্রত্যক্ষদর্শী, অনেক ঘটনার সাক্ষী, এমনকি শরিকও। বর্ণনার পাশাপাশি নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি ঘটনার মূল্যায়ন বা বিচার-বিশ্লেষণও করেছেন। তবে লেখকের মতামত বা সিদ্ধান্ত কোথাও রচনার বস্তুনিষ্ঠতাকে ক্ষুন্ন করেনি। লেখকের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও সমগ্রতাবোধ গ্রন্থটিকে ইতিহাসের কালের সাক্ষী হিসেবে স্থান দিয়েছে। লেখকের মন্তব্য এখানে প্রণিধানযোগ্য "আমি চর্চিত-চর্বণ করিনি। আমি নভোচারীর মত চাঁদের উল্টো দিকের রূপ উপস্থিত করতে চেষ্টা করেছি।
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চাঁদ সম্বন্ধে যা লেখা হয়েছে তার সাথে নভোচারীদের দেখা চাঁদেও চেহারার কোন মিল নেই বলেই নভোচারীদের দেখা চাঁদ মিথ্যে আর যারা চাঁদ সম্বন্ধে কল্পনার ফানুস এঁকেছেন তাদের কথা সত্য-একথা বলা যায় না।" 'ভাষাভিত্তিক বাংলাদেশের জন্য আন্দোলন শুরু হয় ১৯৫২ সালে, বঙ্গভাগ আন্দোলনের প্রাক্কালে। তখন সুবায়ে বাংলা গঠিত ছিল বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার অঞ্চলসমূহ নিয়ে। বাদশাহ আকবরের সুবায়ে বাংলার আর ১৯১১ সালের ভাষাভিত্তিক বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের কোন আদর্শগত মিল ছিল না। মোগল বাদশাহ এবং ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা ছিল সা¤্রাজন্য শাসনের সুবিধা অনুযায়ী বাংলা। কিন্তু ১৯১১ সনের ভাষাভিত্তিক বাংলা গঠনের আন্দোলনকেই নতুন বাংলার ইতিহাসের প্রারম্ভিক পর্ব বলে মনে করেছেন কামরুদ্দীন। তাঁর এ সিদ্ধান্তের পেছনে যৌক্তিক তথ্য-উপাত্তও সুলভ।
বাংলার সংস্কৃতি বিকাশে মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী মিশে আছে ওতপ্রোতভাবে। এ শ্রেণির আত্মত্যাগ ও সাহসী চেতনার মধ্য দিয়েই বাংলার প্রতিটি আন্দোলন সফল হয়েছে। 'বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী' গ্রন্থে কামরুদ্দীন আহমদ তুলে ধরেছেন মধ্যবিত্তের এক প্রামাণ্য দলিল। বইটিতে ১৯৫৩ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এক দশকের স্মৃতিচারণা করেছেন তিনি। এ দেশের তথা বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে এই সময়টি নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই কালপর্বেই পূর্ব বাংলয় সাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর ক্ষমতা দখলের ব্যাপারটিও এ সময়ই ঘটে। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন প্রস্তুতি ও প্রচারণায় কামরুদ্দীন আহমদের গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। যুক্তফন্ট মন্ত্রিসভা গঠন ও সরকারের পরবর্তী ভাঙাগড়া, পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজনীতি ও সেখানে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, চক্রান্ত ইত্যাদির তিনি ছিলেন একজন প্রত্যক্ষদর্শী।
তার অভিজ্ঞতালব্ধ ধারণা গ্রন্থটিতে প্রকাশ পেয়েছে। কলকাতায় ও রেঙ্গুনে কুটনৈতিক দায়িত্ব পালনের সূত্রে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং সমকালীন আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা ঘটনাপ্রবাহেরও তিনি ছিলেন একজন সাক্ষী। সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার আমলে পাকিস্তাানের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘ অধিবেশনে তিনি যোগ দিয়েছিলেন। কর্মসূত্রে দেশ-বিদেশের অনেক বিশিষ্ট ও বিখ্যাত মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলেন তিনি। এসব অভিজ্ঞতার কথা অত্যন্ত সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় এবং চিত্তাকর্ষক ভঙ্গিতে লেখক এ বইয়ে তুলে ধরেছেন।
'বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ' গ্রন্থটিতে বাংলার ইতিহাসের ধারা ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে লেখকের নিজস্ব চিন্তার প্রতিফলন রয়েছে। লেখকের বয়ান প্রকান্তরে জনমানুষের মুক্তির বয়ানে পরিণত হয়েছে- এ জনগণ অবশ্যই মধ্যবিত্ত ঘরানার। তাদের বিকাশ নিয়ে লেখা। স্থান পেয়েছে বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশের ইতিহাস। পাকিস্তান আন্দোলন, রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্থানের প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তানি শাসকদেও শোষণ ও বঞ্চণ ও বঞ্চনা, ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট গঠন-লেখক এসব ঘটনার কেবল পর্যবেক্ষকই ছিলেন না, ছিলেন অন্যতম নিরামক।
স্থান, কাল এবং পাত্র তথা ব্যক্তি, পেশা এবং মানসিক চেতনার ভিন্নতা থেকে তৈরি হয় দৃষ্টিভঙ্গির বিভিন্নতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পট বিশ্লেষণে প্রয়োজন সামগ্রিক পর্যালোচনা। এ 'স্বাধীন বাংলার অভ্যুদয় এবং অতঃপর' গ্রন্থে তার বিন্যাস উপস্থিত। ১৯৬৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলার রাজনীতিতে বিদ্যমান প্রত্যয়সমূহ এখানে উল্লেখিত ও বিশ্লেষিত হয়েছে। স্বাধীনচেতা বাঙালিরা জীবন-মন সংহরণ করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে বটে কিন্তু তাতে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জিত হয়নি। ইতিহাসবেত্তারা বলে থাকেন যে তৃতীয় বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রই সত্যিকার স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায় তা অর্জন করতে পারে না। দু'চারটি দেশ ছাড়া বাকি সকল দেশের স্বাধীনতাই কাল্পনিক (গুঃয ড়ভ রহফবঢ়বহফবহপব)। কামরুদ্দীন আহমদ এ গ্রন্থে' এ সত্যটিই ধারণ করেছেন। কঠিন সত্য ও বাস্তবতাকে ঠাঁই দিয়েছেন কলমের ডগায়। নিজস্ব চেতনার স্ফুরণ তাঁর লেখায় উদ্ভাসিত। 'কৈফিয়ৎ' দিতে গিয়ে বলেছেন...'আমি পণ্ডিত ব্যক্তির চেয়ে জ্ঞানী লোককে বেশি শ্রদ্ধার চোখে দেখি। আমি বৃদ্ধ প্রৌঢ় লোতের সঙ্গের চেয়ে যুব সম্প্রদায়ের সঙ্গ বেশি পছন্দ করি। কারণ যারা পণ্ডিত তারা পাণ্ডিত্য দেখাবার জন্য অতীতের পণ্ডিতদের কথাগুলি আওড়িয়ে যায়, তার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থেকে নতুন কথা বড় শুনি না।
অন্যদিকে যারা বৃদ্ধ বা প্রৌঢ় তারা তাদের বিগত জীবনের ইতিহাস পর্যলোচনা করতেই ভালবাসেন- এদের দৃষ্টি অতীতের দিকে। আমি শুনতে চাই আগামী দিনের কথা-ভবিষ্যতের রূপরেখা। যারা বিগত দিনের মধ্যে বেঁচে থাকতে চায় তাদের আমি মৃত বলে মনে করি। মানুষের সুবেশ ও সুন্দর দৈহিক অবয়ব আমাকে আকৃষ্ট করে না ততটা যতটা করে মানুষের অন্তরের ঐশ্বর্য আর সংস্কৃতিবান মন। বর্তমান গ্রন্থ 'স্বাধীন বাংলা অভ্যুদয় ও অতঃপর' গ্রন্থে স্বাধীনতা পরবর্তী আমার দেখা কাহিনিগুলোর বর্ণনা দিতে চেষ্টা করেছি সাধ্যমত"।
পাঠক ও গবেষকের কাছে কামরুদ্দীনের গ্রহণযোগ্যতা তুঙ্গে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সাধারণ পাঠকের কাছে কামরুদ্দীন নামটি ক্রমশ ম্রিয়মান। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের সংস্কৃতির চর্চার গতিপথও ভিন্নপথে চালিত হতে পারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ আবশ্যক। প্রাথমিকভাবে এমন উদ্যাগ পরিবার থেকেও শুরু হতে পারে। অবশ্যই জাতীয় পর্যায়ে কামরুদ্দীন অনুশীলন ও চর্চার পথ সুগম করা সময়ের দাবি।
কামরুদ্দীন আহমদ বেদনাবিদূর হয়ে লিখেছেন গ্রন্থটি। মুক্তিযুদ্ধে পাক সেনার গুলিতে চৌদ্দগ্রাম বেতিয়ারায় শহীদ হন কনিষ্ট পুত্র আজাদ। দুর্দশায় বন্দীজীবন কাটিয়েছেন জেলে। এমন প্রেক্ষাপটে লেখা সত্যিই সাহস ও ধৈয্যের ব্যাপার। কামরুদ্দীন সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। দেশ ও মাতৃকার প্রবল অনুরক্তের ফলেই তা সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশের ইতিহাস অন্বেষণে কামরুদ্দীন পাঠ অত্যন্ত জরুরি। বাংলা সংস্কৃতির রূপান্তরের ধারা আলোকপাতে তাঁর গ্রন্থ পথপদর্শক হিসেবে কাজ করে। অতীতের ইতিহাস আস্বাদনে তার ভূমিকা বিস্তর। ইতিহাসের আলোকে বর্তমান অবস্থা বর্ণনায়ও সবিশেষ গুরুত্ব আছে এসব গ্রন্থের। জাতীয় চেতনা উন্মেষে তাঁর লেখা জ্ঞানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। বর্তমান শ্রেণি-সংগ্রাম-আচ্ছাদিত সমাজে মধ্যবিত্তের দ্বিধান্বিত অবস্থানে বাঙালি সংস্কৃতির বস্তুনিষ্ঠ অধ্যয়নে কামরুদ্দীন পাঠ আরও অত্যাবশ্যক হয়ে ওঠছে। আমাদের সংস্কৃতির ধারক ও বাহক-তরুণ সমাজের মধ্যে তাঁর রচনা ছড়িয়ে দেয়া প্রয়োজন। তাহলে তারা বিভ্রান্ত অতীত ইতিহাস থেকে বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভে সমর্থ হবে।
বাঙালি সংস্কৃতির বড় প্রত্যয় হলো-'মধ্যবিত্ত'। বাংলাদেশের সংস্কৃতির নির্মাণ ও বিস্তারে এই মধ্যবিত্তের রয়েছে অপরিসীম অবদান। কিন্তু এ-সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ ও মূল্যায়নধর্মী বইয়ের অভাব রয়েছে। কামরুদ্দীন আহমদ এ ধারার নিষ্ঠাবান গবেষক। তিনি বাঙালি মধ্যবিত্তের বিকাশের দিক অনুপুঙ্খ আলোচনার সফল সারথি। মধ্যবিত্তের আলোচনায় অনিবার্যভাবেই কামরুদ্দীনের উপস্থিতি সরব হয়ে দেখা দেয় বারবার। পাঠক ও গবেষকের কাছে কামরুদ্দীনের গ্রহণযোগ্যতা তুঙ্গে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সাধারণ পাঠকের কাছে কামরুদ্দীন নামটি ক্রমশ ম্রিয়মান। এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের সংস্কৃতির চর্চার গতিপথও ভিন্নপথে চালিত হতে পারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ আবশ্যক। প্রাথমিকভাবে এমন উদ্যাগ পরিবার থেকেও শুরু হতে পারে। অবশ্যই জাতীয় পর্যায়ে কামরুদ্দীন অনুশীলন ও চর্চার পথ সুগম করা সময়ের দাবি।
Comments