পর্যালোচনা

গণমানুষের ইতিহাস ও প্রত্নচর্চার নতুন বয়ান

মাসউদ ইমরানের লেখা 'Safeguarding-Governmentality of the Cultural Heritage-Democratising, Conserving, and Representing the Past(S) of Global South' শীর্ষক বইটি পড়লে ইতিহাস নিয়ে হতাশাগুলো কিছুটা হলেও কাটিয়ে ওঠা যায়। এই গবেষকের সাফল্য তিনি দীর্ঘ গবেষণা এবং মাঠকর্মের মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য, অনুসৃত তত্ত্ব এবং প্রয়োজনীয় উপাত্তের আলোকে এই বিষয়টিকেই 'Safeguarding-Governmentality' শীর্ষক তত্ত্বায়ন করেছেন এই গ্রন্থটি লিখতে গিয়ে।

সাধারন বেশিরভাগ গবেষণায় 'প্রশ্ন ও সমস্যা' সামনে রেখে যেভাবে কাজ শুরু করে এখানেও দেখেছি 'প্রবলেমাটাইজেশন' নামের অধ্যায়টি দিয়েই শুরু হয়েছে আলোচনা। গবেষক হিসেবে মাসউদ ইমরান যদি চলতে পছন্দ করেন উল্টোপথে, বইটিও লেখা হয়েছে প্রচলিত ধ্যান ধারণার উল্টো রথে। ইতিহাসে যারা উপেক্ষিত, অতীতের বর্ণণাতে যারা অস্পৃশ্য, বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক বয়ানে যারা থাকেন ধরাছোঁয়ার বাইরে তাদের নিয়ে লেখা তত্ত্বকথার প্রাথমিক প্রয়াস।  

বর্ণভেদ নিয়ে ইতিহাসের অন্তরালে যত কথা লুকিয়ে থাক, শ্রেণি সংঘাত নিয়ে রাজনৈতিক তত্ত্বায়নের কলেবরে যতগুলো লাইন লেখা হোক সেখানে ধ্রুবসত্য তো একটাই 'গণমানুষকে উপেক্ষা'। প্রচলিত অতীতের বোধ ও বৌধায়ন যেখানে সাধারণ মানুষকে পশুর পাশাপাশি 'দোপেয়ে আরেক আজব জীব হিসেবে' যোজন যোজন দূরে ঠেলে দিচ্ছে আলোচ্য বইটির লেখক ইতিহাসের সেই কাজটার বাইরে নতুন কিছু শুরু করার ইঙ্গিত দিয়েছেন এখানে।

যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়াতে স্বাস্থ্যখাতে শিশু ও বৃদ্ধদের সুরক্ষার নিমিত্তে বহুল প্রচলিত শব্দ 'Safeguarding' বলতে বোঝায় ক্ষতি, অপব্যবহার ও অবহেলা থেকে দূরে রাখা। ঠিক এই বিষয়গুলোকে যখন ঐতিহ্যিক সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় সেখানে অনেকগুলো বিষয় যুক্ত হওয়ার কথা। কিন্ত সেগুলো মাথায় না রাখার বিপরীতে সৃষ্টি হচ্ছে বিবিধ জটিলতা। আর ঠিক তখনই প্রশ্ন উঠছে গভর্মেন্টালিটি কি? একে কী সরাসরি বঙ্গানুবাদ করা যায় সরকারিতা হিসেবে?

তবে সহজ বাংলায় বলতে গেলে এটিও ক্ষমতা অধ্যয়নের একটি পদ্ধতিগত ধারণা যা আইন প্রণয়নের সার্বভৌম ক্ষমতার পরিবর্তে ইতিবাচক উপায়ে জনগণের আচরণ পরিচালনার উপর জোর দেয়। ক্ষমতার একটি শৃঙ্খলামূলক রূপের বিপরীতে, সরকারিতা সাধারণত অংশীজনের অনেকটাই ঐচ্ছিক অংশগ্রহণের সাথে জড়িত। প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্যের সংরক্ষণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরণের বয়ান তৈরিতে একে আলাদা দেখার সুযোগ কম।

১৯৭৭-৭৮ সালের দিকে মিশেল ফুকোর কিছু লেকচারে দেখেছি ক্ষমতা কাঠামোর নতুন এক তত্ত্বায়ন। তিনি 'problem of government' সামনে রেখে প্রস্তাব করেছিলেন নতুন তাত্ত্বিক অবকাঠামো যেখানে 'Governmentality' পদবাচ্যটি প্রচল হয় নানা প্রেক্ষাপট থেকে। অন্যদিকে উইলহেম লন্ডনো যেভাবে আওয়াজ তুলেছেণ আয়ান হডারের রিফ্লেক্সিভ আর্কিওলজির তত্ত্বায়ন নিয়ে  তা এই বইতে আরেকটু স্পষ্ট করে খতিয়ে দেখা হয়েছে। তাই লন্ডনোর প্রখ্যাত 'Cultural Heritage Management and Indigenous People in the North of Colombia: Back to the Ancestors' Landscape' শীর্ষক গ্রন্থটির প্রভাব বলয়ের বাইরে যেতে পারেননি লেখক। অবশ্য যাবেনই কীভাবে?

আমরা জানি যে রিফ্লেক্সিভ আর্কিওলজির ব্যাপারে কথা বলতে গেলে সবাই স্বীকার করবেন যে এটি প্রত্নতত্ত্বের একটি তুলনামূলকভাবে সাম্প্রতিক তাত্ত্বিক বিতর্ক। তাত্ত্বিক অবস্থান হিসেবে এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক জ্ঞানগুলো তার গবেষকের অভিজ্ঞতা এবং প্রেক্ষাপট উভয় প্রেক্ষাপট থেকে নির্ধারিত হয়। এটি এমন বর্ণনাকে সমর্থন করে যেখানে প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্যগুলি গল্পের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হয়। এখানে সংলাপ, একটি ধ্রুবক প্রশ্ন এবং ব্যাখ্যার জন্য বিভিন্ন সম্ভাবনার চারপাশে চক্কর কাটতে দেখা যায়। আলোচ্য গ্রন্থে লাল মিয়া ও ভুলু মিয়ার গল্পের যে অবতারণা সেটা হয়তো বিষয়টিকে সামনে রেখেই করা।

রিফ্লেক্সিভিটি তাত্ত্বিক দিক থেকে এমন একটি বিশ্লেষণ আপাত সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে। আর এখানে অনুমান করা হয় যে লেখক গল্পে তার নিজের জায়গা তৈরি করার মতো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ব্যাখ্যাকেও  একান্ত নিজের করে নিতে পারেন। এখানে সম্ভাব্যতার শর্তগুলিও সুস্পষ্টভাবে বৈজ্ঞানিক। আর সে হিসেবে গবেষণার জন্য নির্বাচিত প্রত্নবস্তু একদিক থেকে বৈজ্ঞানিক বস্তু। তাই তার বর্ণনা করার ফর্মগুলি নির্ধারণ করে নেওয়া হয় আগে থেকেই। এই অর্থে, রিফ্লেক্সিভিটি প্রত্নতাত্ত্বিক বিবৃতিকে আগে থেকেই আকার দেয়। তা এমন এক সম্ভাবনার ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে কাজ করে যা ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক পূর্বানুমান নিয়ে দাড়িয়ে আছে।

লেখক তার বর্ণনার ক্ষেত্রে হঠাৎ জেমিসনের পোষ্ট মর্ডানিজমকে হাজির করেছেন যেখান আমার হিসেবে জুলিয়ান থমাসের প্রখ্যাত ' Archaeology's Place in Modernity' অনেকটাই গরহাজির রয়ে গিয়েছে। তবে হ্যাঁ হডারের বর্ণিত অতীতের একটির বদলে সেই বহুস্বর, ক্যারল ম্যাকডেভিডের বর্ণনায় আসা ' Multivocality and Archaeology' কিংবা আশীষ নন্দীর 'History's Forgotten Doubles" কে একই সুতোয় গেঁথেছেন। অনেকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবে লেখক ফরাসি তাত্ত্বিক ব্রুনো লাতুরের সায়েন্টিজমের উল্লেখ করলেও তার কার্যকারণগত সম্পর্ক আমি বুঝতে পারিনি। ঠিক যেমন ফার্দিনান্দ দ্য সসুরকে টেনে আনা হয়েছে স্টুয়ার্ট হলের এর প্রখ্যাত 'Representation: Cultural Representations and Signifying Practices' এর মধ্য দিয়ে।

তবে লেখকের বড় সক্ষমতা তিনি ঔপনিবেশিকতা, উত্তর-ঔপনিবেশিকতা, আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা আর নিম্নবর্গের অবস্থানের বিষয়গুলোকে খুব দুর্দান্তরূপে খুঁজে দেখেছেন তাত্ত্বিক ও মাঠকর্মের মেলবন্ধনে। তাই তালাল আসাদের বর্ণনার পথ ধরে মডার্নিজম তাঁর কাছে নিছক একটি প্রকল্প। আর সে প্রকল্পের সরলীকরণ আমাদের বাধ্য করে প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসের একমুখী সরলরৈখিকভাবে পাঠ নিতে। অন্যদিকে একটি নেতিবাচক পূর্বানুমান তথা হেজিমনি তাঁদের রেখে যাওয়া সরলরেখাকে আরও প্রলম্বিত করে পূর্বনির্ধারিত একটি সাংস্কৃতিক ভবিষ্যত নির্মাণ করে।

সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের প্রচলিত পাঁচটি 'সি' যে চিরচেনা পরিমণ্ডল তৈরি করেছে লেখক তার ভেতরে থেকেই এর ঔপনিবেশিক হ্যাংওভারকে খুঁজেছেন। এখানকার সত্তাতাত্ত্বিক ও জ্ঞানতাত্ত্বিক ফাঁকফোকরগুলো খুঁজে খুঁজে সেখানে গুঁজে দিয়েছেন কিছু তাত্ত্বিক আলাপ। অন্তত 'গ্লোবাল নর্থের আঙুল তোলা দেখে টুপটাপ লিখে ফেলা ইতিহাসগুলো তাকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেয় না। তারা যায় সবাই শুধু তাদের কথা শুনে চলুক। আর ইতিহাস হোক সঞ্জীব চৌধুরী চিরচেনা গানের মতো। বেলা শেষে ইতিহাস লেখকের দীর্ঘশ্বাস ভাষা খুঁজুক এভাবে 'আমি হেঁটে গেছি (ইতিহাসের) বিরান পথে, আমি তোমাকেই বলে দেবো সেই ভুলে ভরা গল্প, কড়া নেড়ে গেছি ভুল দরজায়'।

প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য শুনলেই অনেক এলাকার মানুষ আতঙ্কিত বোধ করেন। তাদের এই আতঙ্ক কমিয়ে আনার নানা বিষয় নিয়েও কথা বলেছেন লেখক। এখানে তিনি নিম্নবর্গের ইতিহাসের ধারণা মাথায় রেখে কাজ করতে উৎসাহ দিয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকদের।

তাই মিথ ও মানুষকে কাছে টেনে, মাটি ও মানুষের সোঁদাগন্ধ ছড়িয়ে অবাক করা কিছু গল্প নিয়ে সাংস্কৃতিক সম্পদ (?) সংরক্ষণের সঙ্গে জড়িত পাঁচটি 'সি C' - ক্রেডিবিলিটি, কনভারসেশন, ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, কমিউনিকেশন এন্ড কমিউনিটিস নিজে কাজ করার উপরে জোর দিয়েছেন লেখক। বিশেষত কম্যুনিটি নিয়ে লেখকের যে সতর্ক অবস্থান সেটা এই গবেষণাকে পূর্ণতা দিয়েছে। তিনি ইতিহাসের পাতা থেকে থেকে মিথ কিংবা প্রচলিত গল্পকে 'কুসংস্কার' বলে ফুঁ মেরে উড়িয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী নন। বরং তিনি ইনক্লুসিভ হিউম্যান হিস্ট্রি লেখার প্রয়াসে অগ্রগামী। তিনি কোনোভাবেই মানুষকে বাদ দিয়ে প্রচলিত মৃত বস্তু নির্ভর ইতিহাসের তথা প্রত্নতত্ত্বের বর্ণনাকে অস্বীকার করেছেন। তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকার প্রতিটি মানুষকেও ইতিহাসের পাতায় জায়গা দিতে চেয়েছেন। 

তারপর গণমাধ্যম কাজে লাগিয়ে বিস্তারলাভকারী 'প্রত্নতাত্ত্বিক প্রকল্প' কীভাবে সীমাহীন মিথ্যাচার ও ভুল বয়ান তৈরির মধ্য দিয়ে অতীতকে বিতর্কিত করে তার উদাহরণ হিসেবে এসেছে 'উয়ারী-বটেশ্বর'। পছন্দসই হাজার বছরের প্রাচীনত্যের বয়ান কীভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণাকেই ভেস্তে দিতে পারে সেগুলোও লিখেছেন লেখক। তাই বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার মতো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার উদাহরণ টেনে প্রকল্পবাদী প্রত্নচর্চাকেও নাঙ্গা করেছেন তিনি। মজার বিষয় মহাস্থনগড়ের বৌদ্ধ ঐতিহ্য কীভাবে মুসলিম সংস্কৃতিতে আত্মীকরণ হয়েছে তার কিছু বর্ণনাও আছে এখানে। বাদ যায়নি বাগেরহাট তথা খলিফাতাবাদের বর্ণনা।

প্রত্নতাত্ত্বিক ঐতিহ্য শুনলেই অনেক এলাকার মানুষ আতঙ্কিত বোধ করেন। তাদের এই আতঙ্ক কমিয়ে আনার নানা বিষয় নিয়েও কথা বলেছেন লেখক। এখানে তিনি নিম্নবর্গের ইতিহাসের ধারণা মাথায় রেখে কাজ করতে উৎসাহ দিয়েছেন প্রত্নতাত্ত্বিকদের।

গবেষক এখানে ইতিহাসকে খুঁজেছেন গণমানুষের কাতারে দাঁড়িয়ে। পাশাপাশি তাত্ত্বিক দিক থেকে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে জনগণের একটি সুন্দর সম্পর্ক নির্মাণের চেষ্টাও করেছেন। চেষ্টা করেছেন মানুষ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রাপ্তিকে তাদের কৃষি জমি ধ্বংসের উপলক্ষ মনে না করুক। প্রত্নতত্ত্বের গবেষকদের পাশাপাশি ঐতিহ্য অনুরাগী যে কাউকে আগ্রহী করবে ইউপিএল থেকে প্রকাশিত বইটি।  

Comments

The Daily Star  | English

Not for kidney patient, they tried to rob bank for iPhones

Police say three robbers fabricated a story claiming that the robbery was to save a kidney patient

38m ago