সত্যজিৎ যখন মানিক ছিলো

ছবি: সংগৃহীত

একজন বড় মাপের মানুষ কিভাবে বেড়ে উঠলেন, সে গল্প থেকে শেখার আছে অনেক কিছু। প্রসঙ্গে আজকের মধ্যমণি 'মহারাজা' সত্যজিৎ রায় দুটোই পেয়েছিলেন সমানভাবে, একে তো বাবা সুকুমার রায়, দাদা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী; অন্যদিকে বেড়ে উঠেছেন কলকাতার সব রথীমহারথীদের নাকের ডগায়, পরিবারে দারুণ সব মানুষের মায়া-মমতার চাদরে।

১০০নং গড়পাড় রোডের মানিকের সত্যজিৎ হয়ে ওঠার সবচেয়ে সুন্দর বর্ণনাটা আছে ১৯৮২ সালে রচিত 'যখন ছোট ছিলাম' বইটিতে। আত্মজীবনীটি প্রথম প্রকাশ হয়েছিল তারই বাড়ি থেকে প্রকাশিত বিখ্যাত 'সন্দেশ' পত্রিকার দুটো সংখ্যায়। পরে যখন বই হিসেবে প্রকাশ হয় সঙ্গে যুক্ত হলো সত্যজিতের নিজের আঁকা অমূল্য সব স্কেচ, পারিবারিক ছবি, নামকরণ অনুষ্ঠানের কাগজ, রায় পরিবারের বংশলতিকা আর কিছু ব্যক্তিগত চিঠি! এমনকি এই বইটি করবার জন্য সত্যজিৎ গড়পাড়ের বাড়ি আর বালিগঞ্জের স্কুলের মত পুরোনো জায়গাগুলোতে নতুন করে গিয়েছিলেন। বোঝাই যাচ্ছে সত্যজিৎ ছোট্ট বইটি করতে কতটা উৎফুল্ল ছিলেন, জন্মদিন উপলক্ষে এই বইয়ের খোঁজ দেয়ার লোভটা সামলাতে পারলাম না।

বইয়ের শুরুটা হয় সত্যজিতের গড়পাড়ের বাড়িতে শৈশবের স্মৃতি দিয়ে। সেখানে গত শতাব্দীর শুরুর দিকে বৃটিশ-কলকাতার ঝরঝরে বর্ণনা পাওয়া যায়। কোলকাতায় প্রথম আকাশ কাঁপানো প্লেন দেখতে পাওয়া, প্লেন থেকে ছুড়ে মারা বিজ্ঞাপনের কাগজ খুঁজে পাওয়া, ফোর্ড, শেভ হাম্বার সহ আরো নানা বিদেশী ব্র‍্যান্ডের হুডখোলা গাড়ির শব্দ, Swan ও waterman ফাউন্টেন পেনের কালির ঘ্রাণ কিংবা বাড়িতে তৈরি ভ্যানিলা আইসক্রিমের স্বাদ; বইয়ের শুরুতেই সত্যজিৎ আপনাকে পুরোদস্তুর নিয়ে যাবে একশো বছর আগের কলকাতায়।

রায় পরিবারের নিজেদের বাড়িতেই ছিলো প্রেস 'ইউ রায় অ্যান্ড সন্স'। সেখান থেকেই বেরুত 'সন্দেশ', তাছাড়া সত্যজিতের দাদুর ছোটোদের জন্য তৈরি করা 'ইলিয়াড', 'ওডিসিউস', 'পুরাণের গল্প', আর 'বেতাল পঞ্চবিংশতি' এর মত অসংখ্য বই এখান থেকেই ছেপেছে। এখানে আরো একটা কাজ হতো, তা হলো ছবি এনলার্জ করা। কেউ মারা গেলে গ্রুপ ছবি থেকে কোনো এক কোণায় থাকা ঘোলা ছবি এখান থেকে বাঁধিয়ে ফিনিশ করা হতো। ঘরে ছিলো বিরাট প্রসেস ক্যামেরা, সেখানে ক্যামেরার নিচের দিকে মুখ করে লেন্সের তলায় গিয়ে দেখা চলতো নিজের মুখের উল্টো ছবি। এরকম মজার অনেক স্মৃতি আছে 'ইউ রায় অ্যান্ড সন্স' নিয়ে। এতে বোঝা যায়, সত্যজিৎ শৈশব থেকেই ক্যামেরা, ফিল্ম কিংবা প্রকাশনার ছিলেন খুব কাছাকাছি।

ছোটোবেলার যতরকম খেলা ছিলো তার সবকিছুর বর্ণনা রয়েছে। চাবি, পেরেক আর বারুদ দিয়ে কিভাবে পটকা বোমা বানাতে হয় তা বই পড়লে আর স্কেচ দেখলে যে কেউ বোধহয় বাড়িতেই বানিয়ে ফেলতে পারবেন। কিংবা দইয়ের ভাঁড় আর মোমবাতি দিয়ে বানিয়ে নিতে পারবেন লন্ঠন! ঘরে বসে খেলার জন্য আছে ক্যারম আর ব্যাগাটেল। আছে আশ্চর্যযন্ত্র 'স্টেরিওস্কোপ' আর 'ম্যাজিক ল্যানটার্ন'। পাঠক পড়তে পড়তে নিজেকে খুঁজে পেতে পারেন। 

এই ম্যাজিক ল্যানটার্ন দিয়ে ঘুরন্ত ফিল্মের চলন্ত ছবি দেখা যায়। রায় সাহেবের ধারণা এই আশ্চর্যযন্ত্রের কল্যাণেই হয়তো তার মাথায় ফিল্মের নেশা চড়েছিলো। আমার সবচেয়ে ভালো লেগেছে সত্যজিৎ রায়ের ছেলেবেলায় অলস সময় পার করার বর্ণনায়। দিনের একটা বিশেষ সময় তাঁর ঘরের দেয়ালে আলোছায়ার খেলায় রাস্তার উল্টোছবি দেখা যেত, অলস দুপুরে তিনি এই 'বায়োস্কোপ' দেখতেন। মাঝেমধ্যে দেখতেন মেঝেতে করা চিনেমাটির কাজের প্যাটার্ন। এই দুটো কাজে ছেলেবেলায় কত সময় পার করেছি তার কোনো ইয়ত্তা নেই!

উৎসবের দিনগুলোর বর্ণনায় দেখা মেলে তখনকার পরিবারগুলোর মিষ্টি-মধুর বন্ধন। ছোটোদের সাথে সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক ছিলো বাড়ির মাসি, পিসি, কাকা, কাকী, মামা আর দিদিদের। কলকাতায় সেই তখন থেকেই আয়োজন করে হত ক্রিসমাস। ক্রিসমাসে নিয়ে সত্যজিতের যে কী মজার স্মৃতি! বছর ছয়েক বড় বন্ধু কল্যাণদা, নিজেই সেজে আসতেন ফাদার ক্রিসমাস হয়ে। তুলোর দাঁড়িগোঁফ আর পিঠে থলি নিয়ে ঘুমিয়ে থাকা অনুজদের মুজোয় পুরে দিয়ে যেতেন ক্রিসমাস গিফট! মায়ের কাছে পাওনা উপহার কেনার জন্য চৌরঙ্গীতে দোতালা 'টয়ল্যান্ড' তো আছেই। সেখান থেকে কেনা যায় ক্রিসমাসের বাহারি ক্র‍্যাকারস!

একটানে পড়ার মত লেখা আর সুন্দর ছবি-স্কেচে ভরপুর এই বইটি যেকোনো সত্যজিৎ ভক্তের মনকে অন্যরকম তৃপ্তি দেবে। বুঝতে দিবে সত্যজিতের চিন্তা-ভাবনা, কিংবা অনেক ফিল্ম-গল্পের পটভূমি। আমি তাই নির্ভয়ে এই বইটি যেকোনো সত্যজিৎ ভক্তকে পড়ার জন্য বলতে পারি। 

উৎসবে আরো বসতো 'কার্নিভাল', মেলার চেয়ে বড় এই আয়োজনে আসতো পাঁচতলা বাড়ির সমান উঁচু নাগরদোলা 'জায়ান্ট হুইল'। পুরো কার্নিভাল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো জুয়ার স্টল। ধারণা করা হয়, সরকারিভাবে জুয়া বেআইনী ঘোষণার পরেই এই কার্নিভালযুগের যবনিকা টানা হয়। বিশেষ দিবস কিংবা উপলক্ষ্যে আরেকটি জনপ্রিয় রেওয়াজ ছিলো 'সাহেব দোকানে' গিয়ে পরিবারের সবাই মিলে গ্রুপ ছবি তোলা। বিশাল বড় ক্যামেরায় লেন্সের ক্যাপ খুলে আবার লাগানোর মাঝে তোলা হয়ে যাবে ছবি, আর সে কয় সেকেন্ড কারো একদমই নড়াচড়া করা চলবেনা।

ছুটি কাটানোর সবচেয়ে সুন্দর স্মৃতিগুলোর বোধহয় বেশিটুকুই লখনৌতে। মেজোমামা-মামী, মামাতো ভাই, ছোটকাকা সহ আরো আত্মীস্বজন নিয়ে সেই বেড়ানোর স্মৃতিতে একটা অদ্ভুত খেলার নাম পাওয়া যায়, আমার ধারণা এই খেলাটিরই একটি সংশোধিত ভার্সন এখন বিভিন্ন টেলিভিশন রিয়্যালিটি শো তে দেখানো হয়। খেলাটির নাম হলো 'Charade'।

রায়ের বর্ণনায় এটা দুইরকম হতে পারে। 'Dumb Charade' আর 'Talking Charade'। খেলায় থাকবে একদল অভিনেতা আর একদল দর্শক। যারা অভিনয় করবে তারা এমন একটা শব্দ বেছে নিবে যা দুই বা ততোধিক কথার (ব্যাকরণের ভাষায় যাকে বলে 'অক্ষর') সমষ্টি। যেমনঃ করতাল (কর+তাল) বা সংযমশীল (সং + যম + শিল)। অভিনেতাকে 'Talking Charade' এ সংলাপের মাঝে আর 'Dumb Charade' এ শুধু অভিনয় দিয়ে বিভিন্ন দৃশ্যের মাধ্যমে সং, যম ও শিল কথাগুলো দর্শককে বুঝিয়ে দিতে হবে। এরকম অদ্ভুত আরো বেশ কিছু পারিবারিক স্মৃতি পুরো বইটি জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।

সত্যজিতকে স্কুলে সবাই মানিক বলেই ডাকতো। তার স্কুলের কোনো ইউনিফর্ম ছিল না। কেউ হাফপ্যান্ট পরতো, কেউ ধুতি, মুসলমান ছেলেরা পায়জামাও পরতো, সঙ্গে চলতো শার্ট। এখনকার স্কুলে 'পিটি' যেটা, তখন তার নাম ছিলো 'ড্রিল'। সপ্তাহে অন্তত দুই-তিনদিন একঘন্টা করে স্কুলের মাঠে ড্রিল হতো। দৌঁড়, কুজকাওয়াজ আর হাইজাম্প ছিলো ড্রিলের প্রধান কাজ।

ছেলেবেলায় ডেঙ্গুতে কমজোর হওয়ায় মানিকের ডানপাটি কমজোর ছিলো। তা নিয়ে আর লম্পঝম্পতে কোনোদিনই ভালো করা হলোনা। বালিগঞ্জের এই স্কুলে অনেক বিখ্যাত ঘরের ছেলেরাও সত্যজিতের সাথে পড়েছেন, ঠাকুর বাড়ির ছেলে সঞ্জয় আর লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্নের পৌত্র অনিলের কথা বইয়ে বিশেষভাবে উল্লেখ্য করা আছে। স্কুলজীবনের প্রতি সত্যজিতের একটা অন্যরকম টান ছিলো।

স্কুল ছাড়ার দশ বছর পর একবার যখন এক অনুষ্ঠানে স্কুলে গিয়ে তিনি দেখলেন দরজায় মাথা ঠেকে যাচ্ছে, বেঞ্চে পা ঠেকে যাচ্ছে তখন বুঝতে পারলেন তিনি বড্ড বড় হয়ে গেছেন। সেই থেকে আর কোনোদিন স্কুলে ফিরে যাননি। তাঁর মতে, "যেসব জায়গার সঙ্গে ছেলেবেলার স্মৃতি জড়িয়ে থাকে, সেসব জায়গায় নতুন করে গেলে পুরোনো মজাগুলো আর ফিরে পাওয়া যায় না। আসল মজা হলো স্মৃতির ভান্ডার থেকে সেগুলোকে ফিরে পেতে।"

একটানে পড়ার মত লেখা আর সুন্দর ছবি-স্কেচে ভরপুর এই বইটি যেকোনো সত্যজিৎ ভক্তের মনকে অন্যরকম তৃপ্তি দেবে। বুঝতে দিবে সত্যজিতের চিন্তা-ভাবনা, কিংবা অনেক ফিল্ম-গল্পের পটভূমি। আমি তাই নির্ভয়ে এই বইটি যেকোনো সত্যজিৎ ভক্তকে পড়ার জন্য বলতে পারি। 

শেষ একটি গল্প বলি। ছেলেবেলায় একবার শান্তি নিকেতনে সত্যজিৎ রায় মায়ের সঙ্গে গেলেন রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে সত্যজিতের অটোগ্রাফের খাতার প্রথম পাতায় একটা কবিতা লিখিয়ে নেয়ার আশায়। খাতাটা দিতে রবীন্দ্রনাথ বললেন, "এটা থাক আমার কাছে; কাল সকালে এসে নিয়ে যেও।" পরেরদিন খাতা ফিরিয়ে দিয়ে রবীন্দ্রনাথ সত্যজিতের মাকে বললেন, "এটার মানে ও আরেকটু বড় হলে বুঝবে"।

সৌভাগ্য সবার সহায় হয় না, সত্যজিতের ক্ষেত্রে তা ভালোভাবেই হয়ছিল। অসংখ্য বৃহৎ বৃক্ষের ছায়ায় বেড়ে উঠেছিলেন বাংলার কালজয়ী এই বটবৃক্ষ, কালজয়ী প্রবাদপুরুষ। তাইতো রায়সাহেবের ড্রয়িং মাস্টার আশুবাবু সেই স্কুলেই বলেদিয়েছিলেন, "সত্যজিৎ নামেও সত্যজিৎ কাজেও সত্যজিৎ।"

Comments

The Daily Star  | English

Family reunited after 18 years

Stranded in Malaysia, man finally comes back home

1h ago