যেভাবে মূল্যায়িত হবে মলয় রায়চৌধুরী
স্কুলে লিখতে হতো 'নামকরণের সার্থকতা'। সাধারণত বাংলা কবিতা বা উপন্যাসের শিরোনাম কিভাবে তৎপর্য্যপূর্ণ বা লেখার মূল নির্যাস কতটা, বিষয়টি পরিষ্কার করাই ছিল সেই পরীক্ষার উদ্দেশ্য। এখন শিউরে উঠছি এই ভেবে যে- এই প্রশ্ন যদি আসতো মলয় রায়চৌধুরীর ওপরে, তাহলে এই নামের সার্থকতার সমর্থনে কি-ই বা লেখা যেত!
কারণ পৃথিবীতে বোধয় খুব কম মানুষ-ই আছেন যাদের কর্মের সাথে নামের মর্ম এমনভাবে দুই মেরুতে অবস্থিত। মলয় যাই হন না কেন, তার লেখায় বলায় বা চালচলনে কখনোই দক্ষিণাঞ্চলের পর্বত থেকে ভেসে আসা স্নিগ্ধ বাতাসের কথা কোনোদিনও তিনি মনে করাননি। যুবক বয়সে দাদা সমীর রায়চৌধুরী ও কিছু বন্ধুদের নিয়ে ষাটের দশকে শুরু করা 'হাংরি জেনারেশন'-এর মাধ্যমে তিনি বাংলায় হয়ে উঠেছিলেন অস্বস্তিকর কিন্তু অপরিহার্য চরিত্র।
অপরিহার্য হত না, যদি আমরা শহর কলকাতাকে এতটুকু অনুভব করার ক্ষমতা রাখতাম। আর মলয় ও তার সারথিদের কীর্তিকলাপকে বুঝতে গেলে পঞ্চাশ ও ষাটের কলকাতাকে বোঝা অপরিহার্য। বিয়াল্লিশ এর মন্বন্তর ও ছেচল্লিশের ভয়ঙ্কর দাঙ্গার পরে সাতচল্লিশে যখন বাংলা ভাগ করে দেওয়া হল, তখন সীমান্তের দুইদিকেই তার পরিণাম ছিল মারাত্মক।
১৯৪৬ থেকে ১৯৭১ এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ) থেকে কম করে পঞ্চাশ লক্ষ মানুষকে তাদের জমি-বাড়ি ছেড়ে ভারতে চলে যেতে হলো। কেবল শহর কলকাতার পরিধির মধ্যেই এতো স্থায়ী-অস্থায়ী সব বসতি গড়ে উঠলো যে ঘনত্বের বিচারে তা হয়ে দাঁড়ালো বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর একটি। পরিণামস্বরূপ, শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের কাছে বেকারত্ব এক বিভীষিকার রূপ ধারণ করলো। ষাট-সত্তরের কিছু বাংলা ছায়াছবির [ঋত্বিক ঘটকের 'মেঘে ঢাকা তারা'; সত্যজিৎ রায়ের 'প্রতিদ্বন্দ্বী', 'জন অরণ্য'; মৃণাল সেনের 'ইন্টার্ভিউ' কথা মনে করলেই এই সংকটের চিত্রটি আরও পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। মলয় রায়চৌধুরী ছিলেন সেইরকমই শিক্ষিত কিন্তু প্রান্তিক তরুণদের একজন। তার সতীর্থরা বহুক্ষেত্রে উঠে এসেছিলেন রিফিউজি কলোনি থেকে। তাদের আড্ডা জমত খালাসিটোলা বা গাঞ্জা পার্কে। কখনো কখনো পার্ক স্ট্রিট কবরস্থানেও।
সময়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে মানুষ বিভিন্ন ভাবে তার আশেপাশের সমাজকে বোঝার চেষ্টা করে। ষাটের শেষের দিকে ও সত্তরের শুরুর নকশাল আন্দোলন ছিল সেইরকম-এ এক উৎকণ্ঠার বহিঃপ্রকাশ। তবে মলয়-রা যা করলেন তা অনন্য এবং অভূতপূর্ব। বঙ্গ জীবনে সাহিত্য বহুযুগ ধরেই সমাজ ও রাজনীতির কঠোর মূল্যায়ন করে গেছে। কিন্তু রাজনৈতিক এক টালমাটাল পরিস্থিতিতে সাহিত্যচর্চাই কিভাবে হয়ে উঠতে পারে ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক, সমাজকে দেখিয়ে দিতে পারে তার দ্বিচারিতার প্রবণতা, এবং ভাষা নিয়ে সূক্ষ্ম পরীক্ষানিরীক্ষা ও কিছু বিশেষ শব্দপ্রয়োগের মাধ্যমে কিভাবে সাংস্কৃতিক পরিসরে গড়ে উঠতে পারে বিপুল এক প্রতিরোধ - মলয়-রা সেটি দেখিয়ে দিতে চেয়েছেন চোখে আঙ্গুল দিয়ে।
১৯৬৫ তে 'মৃত্যুমেধী শাস্ত্র' নামক বুলেটিনে মলয় লিখছেন - "প্রেম, দয়া, মায়া, মমতা, স্নেহ, সংযম, সমাজ, সংসার - এগুলি, ওই যুদ্ধের পর, কেমন যেন ন্যাকামি আর ছেনালিতে বদলে গিয়ে গেলো ওই সময়কার কবিতা। মনে হয়, শুদ্ধ পেটেন্টেড পাউডার মাখানো ওই ন্যালবেলে বাংলায় গাওয়া খেমটা-ধাঁচের অমন পদ্যের জন্যেই, যা দেখে অনেকে একদা দু-হাত তুলে আধুনিক বলে চিৎকার করেছিল, শীতকাঠিন্যে প্রবেশ করতে আরম্ভ করছিল বাংলা কবিতা।"
মধ্যযুগের ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের লেখা পঙতি "ইন দা সওয়ার হাংরি টাইম" থেকে 'হাংরি' জেনারেশনের নামকরণ করে বোঝাতে চেয়েছেন বাংলা সাহিত্যের দৈন্যদশার কথা, যা তাঁর মতে সমসাময়িক বাংলার অধিকাংশ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের দুর্বিসহ পরিস্থিতির থেকে ছিল লক্ষযোজন দূরে। অনর্থক অন্ত্যমিলের পরিবর্তে ওই এক-ই বুলেটিনে মলয় তুলে ধরছেন সময়োপযোগী সাহিত্যরচনার এক ভিন্ন উপায়- "কবিতা এখন 'ভেতর' দিক থেকে আগমনের ব্যাপার, অর্গাজমের মতন...টেকনিক নিয়ে জিমনাস্টিক হয়, কবিতা হয় না।"
মলয় রায়চৌধুরী তথা 'হাংরি'দের নিয়ে প্রচলিত কথা- তাদের কবিতা সবসময় যৌনতায় ভরপুর। কবিতাগুলো নিয়ে হয়তো এইভাবেও ভাবা যেতে পারে যে, মলয়রা আক্ষরিক অর্থে শুধুমাত্র যৌনক্রিয়াতেই মত্ত বা কামত্তেকজক রচনাই যে তাদের একমাত্র মূলধন এমনটা ভাবলে হয়তো পুরো ছবিটা ঠিক স্পষ্ট বোঝা যায় না। বরং তারা উত্তেজক কিছু রূপকের আশ্রয়ে প্রাণসঞ্চার ঘটাতে চেয়েছিলেন তাদের কাব্যরচনায়। তাদের চিন্তাশৈলীর ধরণধারণই ছিল ভীষণভাবে 'ইরোটিক' - তা সে যেকোনো বিষয় নিয়েই হোক না কেন। এই এরোটিসিজম এর মধ্যে দিয়েই মলয় তাঁর ব্যক্তিস্বতন্ত্রতা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। বিভিন্ন 'হাংরি' বুলেটিনে ঘুরেফিরে এসেছে ঠিক এই কথাটাই।
কবিতাকে "ব্যক্তিগত চরমপত্র"-র আখ্যা দিয়ে তার মধ্যে চালিয়েছেন "আমার সম্পূর্ণ আমিত্বের বর্বর আবিষ্কার"। এবং এই নিজেকে সমাজের সামনে, নিজের সামনেই তুলে ধরতে তারা বারবার ফিরে গেছেন মনের গহীনে অবস্থিত ব্যক্তি-জাত সব আকাঙ্ক্ষায়। তাই মলয়দার কবিতায় যে অভিলাষ তা কেবল মিলনের নয়, অবৈধতার আশ্রয়ে আত্মদর্শনের এক কঠোর অনুশীলনও বটে।
মলয়ের অবৈধতার এই ধারণা যে শুধু সাহিত্যে সীমাবদ্ধ ছিল তাই নয়, তিনি নিজেকেও মনে করতেন একজন বহিরাগত, গুরুগম্ভীর সংস্কৃতির জগতে আকস্মিকভাবে ঢুকে পড়া এক অভদ্রজীব। নিজেকে 'ছোটোলোক' বলে একাধিক স্মৃতিকথা রচনা এর-ই এক স্পষ্ট লক্ষণ। বিহারের দরিয়াগঞ্জে বড় হয়ে ওঠার যে অভিজ্ঞতা এই লেখাগুলিতে ধরা পড়েছে তার থেকে বিভিন্ন রকমের প্রান্তিকতার আন্দাজ পাওয়া যায়। দারিদ্রের দুর্দশায়, ইমলিতলার মতো এক হতশ্রী এলাকার জীবনযাপনের সঙ্গে তাঁর বিশ্বসাহিত্য ও দর্শন ভালোলাগার সংমিশ্রণে, একজন বাঙালির একটি অবাঙালী পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ায়, কলকাতায় এসে আবার সেই বাঙালির-ই নিজেকে বঙ্গ বহির্ভূত মনে হওয়ার মধ্যে।
তবু এর মধ্যে লুকিয়ে আছে অদ্ভুত এক পরিহাস। পাঠক হিসেবে আমরা আশ্চর্যিত হই এই ভেবে যে সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা এককালে বাংলার অধিপতি ছিল, তাদের-ই বংশধর নিজেকে বলছেন 'ছোটলোক'! প্রশ্ন জাগে - এও কি দলিত বা নিম্নবর্ণ জাতিদের পরিচয়কে একভাবে আত্মসাৎ করা নয়? তবে এর-ই ভেতর থেকে উঠে আসে মলয়ের সাহিত্যচর্চা ও জীবনদর্শনের মূল উদ্দেশ্যটি- তা হল, যে করেই হোক সমাজের অধিকাংশ লোককে প্ররোচিত করে তাদের ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়া। তা সে মধ্যবিত্ত চেতনাকে আক্রমণ করেই হোক বা বাঙালির বহু প্রিয় সাহিত্যচর্চাকে ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়েই হোক। এরমধ্যে এক প্রতিরোধের ধারা আছে, আছে অপটু কিছু কার্যকলাপ।
আছে বহু ক্ষেত্রেই ভয়ানক পিতৃতান্ত্রিক ভাষার আশ্রয় নেওয়া, আবার আছে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে স্পর্ধা দেখানোর সাহস। মলয়কে বোঝা বা তাঁর সহমর্মী হওয়া তাই বড়োই কঠিন। তাকে কোনো নির্দিষ্ট ছকে ফেলে বোঝা যায়না। এবং এটি-ই বয়সের বাধা অতিক্রম করে তার তারুণ্যের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত। যে তিনি প্রাপ্তবয়স্কদের মতো ক্লান্তিকর নন। তিনি সর্বদাই অননুমেয়, তাই সদাই আশঙ্কাজনক। মলয়ের মূল্যায়ন করতে হবে এই অনিশ্চয়তার মধ্যেই। জড় সমাজের চিন্তাহীন দিনযাপনের মধ্যে অপ্রত্যাশিত কোনো অনুভূতি বাঁচিয়ে রাখবে তার সৃষ্টিসত্তাকে। "সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাবো শুভা" বলেছিলেন অনেকদিন আগেই। প্রত্যুত্তরে উপযুক্ত জবাব দেওয়ার মতো ভাষা কি আমরা খুঁজে পেয়েছি আজও?
Comments