স্বভাবকবি রাধাপদরা কেন বারবার ক্ষতবিক্ষত হন
রাধাপদর পিঠের দিকে তাকানো যায় না। ভয় লাগে। আঁতকে উঠি, শিহরিত হই। লজ্জায় কুঁকড়ে যাই। চোখ বন্ধ করে ভয় লুকোয়। একজন মানুষ, আরেকজন মানুষকে এভাবে মারতে পারে? মানুষের ভেতর এতো জিঘাংসা? এতো বর্বরতা, হিংস্রতা নিয়ে কেউ কি নিজেকে মানুষ দাবি করতে পারে?
রাধাপদ একজন স্বভাব কবি। ওর পূর্বসূরি কবিই মানুষকে নিয়ে সব থেকে দামি কথাটি বলেছিলেন। রাধাপদ যাদের উত্তরাধিকার সেই কবি চণ্ডিদাস শত বছর আগে বলেছিলেন, 'শুনহ মানুষ ভাই/ সবার ওপরে মানুষ সত্য/ তাহার উপরে নাই।' আহা মানুষের জন্য এর চেয়ে মর্যাদার, গর্ব ও গৌরবের আর কিছু কি হতে পারে, নিশ্চয় না। অথচ মানুষকে যিনি দিলেন এত সম্মান সেই চণ্ডিদাসের উত্তরাধিকার চারণকবি রাধাপদ আজ মানুষের কাছেই নির্যাতিত।
'সরকারী চাকরি করে বেতন ৫ হাজার
৫০ হাজার টাকা মাসে খরচ দেখি তার।
বাকী টাকা কেমনে আসে সেকথা আর বলিনা
কেয়ামতের নমুনা জানি, কিন্তু মানিনা।'
তারাপদের এই কবিতা ফেসবুকে ভাসছে। কবিতাই তার জীবন ও জীবিকা। তিনি এখন ক্ষতবিক্ষত শরীরে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন। দ্য ডেইলি স্টারকে রাধাপদ বলেছেন, আঘাত যতটা তিনি শরীরে পেয়েছেন, তার চেয়ে বেশি লেগেছে মনে। এটাই স্বাভাবিক ও সংগত। কারণ, রাধাপদরা মনের কারবারী। দেহ বা শরীর তাদের কাছে তুচ্ছ। মনকে কিভাবে সুন্দর ও অর্থবহ করা যায়, তারই বয়ান দিয়ে যান কবিতায়। মুখে মুখে বাঁধা হয় সেই কবিতা।
রাধাপদ তেমনই একজন কবি। কবিতার মধ্যে দিয়ে সুন্দর পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন প্রতিষ্ঠিত করায় তাদেরে একজীবনের সাধনা। বাঙালি সংস্কৃতিকে ধারণ করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বুনেন। কুড়িগ্রামের পথে পথে কবিতার সুবাস ছড়িয়ে দেন।
রাধাপদরা কোন সাতে-পাঁচে নাই। থাকে না কখনোই। ওরা থাকে কেবলই কবিতার জমিনে, কবিতা নির্মাণ আর বয়ানের ধ্যানে। ওদের স্বভাবে নেই অন্যের অন্ন গ্রাস করা। অপরের ভূমি দখল ওদের বৃত্তি না। কারও পাকা ধানে মই দেয়া ওদের ধাতে নেই। তারপরও ওদেরকে রক্তাক্ত হতে হয়। শরীর হয়ে ওঠে রক্তবর্ণ। ওর রক্তাক্ত পিঠের দিকে তাকালে মনে হয়, মানুষ নয়, হিংস্র, মাংসাশী, ভয়ঙ্কর কোন জন্তু-জানোয়ার এই কাজ করেছে। যে বিভৎসতা দেখে আমাদের মনে পড়ে রায়হানের কথা, মুক্তিযুদ্ধের কথা, ১৯৭১-এ সংঘটিত স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু সংগ্রহশালায় যারা গেছেন, তারা নিশ্চয় ওই ছবিটা দেখে আঁতকে উঠেছেন। যেভাবে এখন আমরা আঁতকে উঠছি রাধাপদ-র পিঠের রক্তবর্ণ ছবির দিকে চোখ বুলাতে গিয়ে। ছবির ক্যাপশনটা ছিল এরকম- পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের চিত্র। কুষ্টিয়ার ফিলিপনগরের রায়হানের পিঠ ব্লেড দিয়ে চিরে লবণ লাগিয়ে দেয়া হয়। সেদিনও আমরা বলেছি মানুষ এতটা নৃশংস হতে পারে? আজও রাধাপদ-র রক্তবর্ণের পিঠ দেখে একই কথার পুনরাবৃত্তি করছি। ১৯৭১ থেকে ২০২৩।
আমরা স্বাধীন হয়েছি। স্বাধীনতার বয়স অর্ধশতক ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু নৃশংসতার কোন পরিবর্তন হয়নি। রায়হানকে অত্যাচার করা হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা বলে, অপরাধ ছিল মুক্ত দেশ চাওয়া। রাধাপদ-র অপরাধ মুক্ত সংস্কৃতির চর্চা করা। কবিতায় মানুষের মুক্তির কথা বলা। রায়হান থেকে রাধাপদ সময়ের ব্যবধান কম নয় মোটেই। কিন্তু আদৌ কোন পরিবর্তন হল কী? আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম? আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা কি এই বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখ আত্মোৎর্গ করেছিলেন? আমাদের শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস আছে, আমরা পালন করি। কিন্তু উনাদের স্বপ্ন পুরণে আদতে কী করা হচ্ছে তা নিয়ে কোন জবাবদিহি নেই। একারণে ১৯৭১-এ যেসব বুদ্ধিজীবীদের হদিস পেয়েছে পাকিস্তানী হানাদার ও তাদের দোসরা প্রত্যেককেই নির্মমভাবে হত্যা করেছেন। আর এখন ২০২৩-এ এসে রায়হানদের পিঠ রক্তাক্ত করা হচ্ছে। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগে আর পাঁচ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম হারিয়ে যে বাংলাদেশ আমরা পেলাম, সেই দেশে শহীদের স্বপ্নের কথা বলছে তো? যদি বলে, কতটুকু বলছে, কীভাবে বলছে আর কোথায় তার বাস্তবায়ন? তা হলে লোক বুদ্ধিজীবী রাধাপদ কেন প্রহৃত হয়, তার পিঠ কেন এমন?
রাধাপদ কারও পাকাধানে মই দেয় না। তার ধ্যান-জ্ঞান কবিতা লেখা, মুখে মুখে রচনা ও তার প্রচার। বিনিময়ে যা পায় তাই দিয়েই জীবন চলে যায়-জীবনের নিয়মে। এরকম রাধাপদ-রাই আমাদের সংস্কৃতির ধারক-বাহক। তারা বাঙালি সংস্কৃতির অনুষঙ্গকে বাঁচিয়ে রাখে-প্রবাহমানতা ধরে রাখে। এ কারণে একজন রাধাপদ-র আঘাত মূলত বাঙালি সংস্কৃতির ওপরই আঘাত-অবমাননা।
এমনিতেই বাঙালি সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্বমূলক যেসব অনুষ্ঠান তার প্রায় পুরোটাই এখন লুপ্ত হতে বসেছে। আমরা বাঙালিত্বের নামে একটা স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করলাম বটে। কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা ও বিকাশ রুদ্ধ করে দিলাম রাষ্ট্রের প্রযত্নে। বাংলাদেশ প্রকৃতার্থে একটি সমাজ নির্ভরদেশ। সমাজই তার ভরকেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধে যার প্রমাণ। সেই বিচারে আমাদের-বাঙালির রাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা নতুন এবং একেবারেই সাম্প্রতিক। সেই নবীন রাষ্ট্র তার সমাজকে হাজার বছরের প্রবহমানতায় যথাযথ সুরক্ষায় রাখতে অপরাগতার পরিচয় দিয়েছে। কেবল অপারগই হয়নি, নানা নিয়মের বেড়াজালে খর্ব করা হয়েছে বাঙালিত্বের সাংস্কৃতিক শক্তিকে। ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন-গ্রাম-পাড়ায় চর্চিত সংস্কৃতির হাজার বছরের ধারা-উপধারাকে। ক্লাব কালচারকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় ক্লাবগুলোর দখল নিয়েছে দুর্বৃত্ত আর দখলবাজরা। এইভাবে সংস্কৃতি চর্চাকে জবরদস্তি দিয়ে রুদ্ধ করেছে।
লোকগল্পের কুমিরের বাচ্চা দেখানোর মতো করে কিছু রাষ্ট্রীয় উপলক্ষের সাংস্কৃতিক আয়োজন জিইয়ে রাখা হয়েছে। যার নিয়ন্ত্রণ গেছে পুরোপুরি প্রশাসনের পদপদবিধারীদের দখল ও স্বেচ্ছাচারিতায়। ফলে, সংস্কৃতির যারা প্রকৃত ধারক, ধ্যানে-জ্ঞানে যারা এর সেবী ও চর্চাকারী তারা হয়ে পড়েছেন উপেক্ষিত, অবাঞ্চিত, অবহেলিত, ক্ষেত্র বিশেষে অপমানিতও। এ সবের পরও রাধাপদ-রা নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত করে ব্যক্তি উদ্যোগে যতটুকু সম্ভব বাঙালি সংস্কৃতির চর্চাকে মনে-প্রাণে ধরে রেখেছেন, কুড়িগ্রামে-কুষ্টিয়ায়-রাজবাড়িতে-নেত্রকোনায়, সারাদেশে। কিন্তু সেটাও সহ্য হয় না। একারণে অবান্তর-ঠুনকো কারণ দেখিয়ে মাঝে মাঝেই তাদের অত্যাচার করা হয়। বাউলের ওপর নির্যাতন, লোকশিল্পীর প্রতি অত্যাচার, সংস্কৃতি কর্মীকে প্রহার এখানে মাঝেমাঝেই হয়। কিন্তু প্রশাসন এ ব্যাপারে ত্বরিৎ কোন অ্যাকশন নেয় না। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির নজির নেই। এ কারণে কিছুদিন পরপরই সংস্কৃতিকর্মীরা অত্যাচারিত হওয়া যেন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাধাপদ-র ওপর অত্যাচারের ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর প্রশাসন নিজে থেকে কোন তৎপর ভূমিকা প্রদর্শন করেননি। এমনকি মামলার পরও আসামিদের গ্রেপ্তারের আওতায় আনেননি।
সংস্কৃতিকর্মীরা-কবি-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীরা যুদ্ধ করেন না। কিন্তু যুদ্ধকে এগিয়ে নেন মূলত উনারাই। 'একটি ফুলকে বাঁচাব বলে মোরা যুদ্ধ করি' এরকম বাণীর যোগান দিয়ে মাঠের সকল যোদ্ধাকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেন। যুদ্ধের বিজয়কে নিশ্চিত করে তোলেন। যেমনটা করেছিলেন উপরের বাণীর রচয়িতা গোবিন্দ হালদার। সংস্কৃতিকর্মীরা সমাজের জন্য উৎপাদনশীল কোন কিছু করেন সেসব কাজে যুক্তও থাকেন না। কিন্তু দেশ নামক একটা ভূখণ্ডের, রাষ্ট্র নামক একটা সংগঠণের মনের খোরাক যোগান উনারাই। ফলে উনারা দেশ-রাষ্ট্র-সমাজের হৃদয়বিশেষ। হৃদয় ছাড়া যেমন দেহ বাঁচে না, তেমনি উনাদের ছাড়া রাষ্ট্র কল্যাণ রাষ্ট্র হয়ে উঠে না। এখানেই রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষণায়-সম্মাননায় উনারা অগ্রাধিকারে থাকেন।
বেদনার হল, আমাদের রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে তার চর্চা গৌণ। আবার এই গৌণ অংশ জুড়ে আছেন রাজধানীর নাগরিকজন যারা সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী, সরকারি আমলা ও উনাদের স্বজন এবং দলদাসেরা। রাষ্ট্রের এসব রাজনীতিতে রাধাপদদের জায়গা নেই। উনারা এসবের তোয়াক্কা করেন না, প্রতাশাও রাখেন না। তারপরও উনারা ন্যূনতম সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার অধিকারটুকু পান না। আশি বছর বয়সেও রক্তাক্ত হতে হয়। প্রশাসন ব্যর্থ হয় নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে। একজন স্বভাব কবির ওপর এরকম আঘাত, রাষ্ট্রের জন্যই কি অবমাননার নয়?
বেশ কয়েক বছর ধরে দেখা যাচ্ছে স্থানীয় পর্যায়ে কোনপ্রকার সাংস্কৃতিক কোন কর্মকাণ্ড নেই। অথচ স্থানীয় সংস্কৃতির রসদ নিয়েই পুষ্ট হয়-বাঁচার অক্সিজেন পায় কেন্দ্র-রাষ্ট্র ও দেশ। অনুমতির বেড়াজালে, নিরাপত্তার অজুহাতে সেই সকল অনুষ্ঠানাদিকে কেবল নিরুৎসাহিত করে রাখা হয়নি, বিবিধ নিষেধাজ্ঞার আওতায় আটকিয়ে তার প্রাণবায়ু নিঃশেষ করা হয়েছে।
স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়েও আমরা সেই রাষ্ট্র নির্মাণ করতে পারলাম না, যে রাষ্ট্রের প্রশাসনকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে তার নাগরিকেরা। নাগরিক-প্রশাসক সৌহাদ্যপূর্ণ সম্পর্ক নির্মাণ অধরা রয়ে গেছে। নাগরিকের কাছে শাসক-প্রশাসকের জবাবদিহি সরকারি চাকরিবিধির মৌলিক দায়িত্বরূপে চর্চায় আসেনি আজও। সংস্কৃতির চর্চার সকল অনষঙ্গকে নানা কারণ দেখিয়ে যদি বন্ধই করে দেয়া হয়, তা হলে প্রশাসনের কাজটা কি?
এই রাষ্ট্র কবে বুঝবে রাধাপদর ওপর আঘাত কেবল একজন ব্যক্তিকে অবমাননা বা আঘাত নয়, এ আঘাত রাষ্ট্রের হৃদয়ের ওপর, বাঙালিত্ব ও বাঙালি সংস্কৃতির ওপর।
Comments