আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ

গর্ব করার মতো একজন শিক্ষক

স্বনামে সর্বজনবিদিত আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, একুশে পদকপ্রাপ্ত গবেষক, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, শিক্ষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার- কানো বিশেষণই তার জন্য যথেষ্ট নয়। বাংলাদেশের একজন সমাজচিন্তক ও গবেষক হিসেবে তিনি জ্ঞানের বিকাশ ঘটিয়েছেন বহুমাত্রিকতায়। তিনি সবার নিকট একজন নির্মোহ ও সজ্জন ব্যক্তি বলে সমধিক পরিচিত ছিলেন। সমাজে এমন মানুষের সংখ্যা হাতেগোনো কয়েকজন।  

তিনি জন্মগ্রহণ করেন রাজশাহীতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদানের পর উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যান। কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ এবং স্কটল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন। দেশের একমাত্র লেখক হিসেবে তার 'দ্য ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেম অব বাংলাদেশ', এন্ট্রি এনসাইক্লোপিডিয়া অব ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড লিঙ্গ্ইুস্টিক্সে প্রকাশিত হয়েছে। বর্ণাঢ্যময় জীবনে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবে বাংলাদেশের শিক্ষার উন্নয়নে কাজ করে গেছেন। 

'তুমি এমন জীবন করিবে গঠন, তুমি হেসে চলে যাবে কাঁদিবে ভুবন'-অধ্যাপক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ এমন জীবনের অধিকারী ছিলেন। সত্যিই তিনি সবাইকে কাঁদিয়ে ২০২৩ সালের ২৫ জুলাই পরপারে চলে যান। শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতির প্রতিটি ক্ষেত্রে তার অবদান অবিস্মরণীয়। তিনি দেহান্তরিত হয়েছেন মাত্র। তার স্মৃতি রয়েছে সবার মননে। মানুষ হিসেবে শ্রেষ্ঠ গুণের অধিকারী ছিলেন বলেই অনেকের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন। কাজের মধ্য দিয়েই তিনি সবার মাঝে বেঁচে থাকবেন যুগান্তরে।

সাহিত্য, ভাষাবিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিকাশে তার লেখাগুলো অনুপ্রেরণা জোগাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। মনজুর মোরশেদের শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানকে তিনভাগে ভাগ করে  আলোচনা করা যেতে পারে-১. সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা ২. ভাষাবিজ্ঞানচর্চা ৩. শিক্ষকতা। সাহিত্যে তার অবদান রয়েছে। একটি সমাজগঠনে সাহিত্যের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ সত্যকে অনুধাবন করেই তিনি সাহিত্যচর্চায় আত্মনিবিষ্ঠ ছিলেন। তাই তার সাহিত্যে জীবনের বিভিন্ন দিক উন্মোচিত হয়েছে। বর্তমানে সর্বনাশা মাদক আমাদের যুব সমাজকে বিপদে ঠেলে দিচ্ছে। 

মোরশেদ বিষয়টি অনুধাবন করেছিলেন আজ থেকে প্রায় ত্রিশবছর আগেই। তাই তো তিনি লিখেছেন-'ধুমপানে বিষপান' নামক শক্তিশালী প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে যুক্তিসহকারে ধূমপানের কুফল তুলে ধরেছেন। তিনি ছিলেন শিশু সাহিত্যিক। শিশুদের মননশীল সাহিত্য তার লেখায় সাবলীল হয়ে ওঠেছে। বাংলাদেশের ভাষাবিজ্ঞান চর্চায় তার অবদান চিরস্মরণীয়। ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ' প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদান ছিলো। বিদেশে ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্য অর্জনের পর তিনি উপলব্ধি করেন বাংলাদেশে ভাষাবিজ্ঞান চর্চার আবশ্যিকতা। দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভাষার প্রায়োগিকতা স্পষ্ট। ভাষা সংজ্ঞাপনের অন্যতম মাধ্যম। ভাষার সামাজিক গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভাষার সুষ্ঠু প্রয়োগের মাধ্যমে একটি জাতি সুশৃঙ্খল জাতিতে পরিণত হতে পারে। ভাষার বিকাশ মানে সমাজের বা রাষ্ট্রের বিকাশ। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগের সহকর্মীদের সঙ্গে ১৯৯৯ সালে বামথেকে সামনের সারিতে: অধ্যাপক মাহমুদা খাতুন, অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদ, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ। ছবি: সংগৃহীত

ভাষাবিষয়ক এ-সব জটিল সংশ্রয় গবেষণা করা হয় ভাষাবিজ্ঞানে। ভাষাকে সর্বজনগ্রাহ্য ও বিশ্বব্যাপী প্রয়োগোপযোগী করা যায় এই অন্বেষণের মধ্য দিয়ে। ভাষাবিজ্ঞানের জ্ঞান প্রয়োগ করে এ-কাজটি সুনিপুণ দক্ষতায় সম্পন্ন করা যায়। স্যারের দূরদর্শিতায় বাংলাদেশে ভাষাবিজ্ঞান চর্চার অবারিত সম্বাবনার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ বিভাগের শিক্ষার্থীরা দেশে-বিদেশে সাফল্যের সাথে ভাষাবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন। ভাষা ও ভাষাবিজ্ঞান গবেষণায় এ বিভাগের অবদানের সঙ্গে অপরিহার্য নাম যুক্ত হয়ে আছে অধ্যাপক আবুল কালাম মনজুর মোরশেদের নাম। ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের ইতিহাসের সঙ্গে এ-নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।

শিক্ষক জাতির নির্মাণের কারিগর। একজন শিক্ষক সমাজের দর্পণ, জাতির মননের দার্শনিক। প্রকৃত দেশপ্রেমিক এরূপ শিক্ষক বদলে দিতে পারেন সমাজের চিত্র। তিনি অনুসরণীয়, নমস্য। সমাজে তাই শিক্ষকের মর্যাদা ওপরে। আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ প্রথাবদ্ধ শিক্ষক ছিলেন না, তিনি ছিলেন শিক্ষার্থীদের অকৃত্রিম বন্ধু, অভিভাবক ও আস্থার প্রতীক। ফলবান বৃক্ষ যে নিচের দিকে নুইয়ে পড়ে তা মনজুর মোরশেদ স্যারকে দেখলে মনে হতো। এত বড় পণ্ডিত হয়েও তিনি কখনও গর্ববোধ করতেন না। তাকে নিয়ে শিক্ষার্থীরা গর্ববোধ করেন। তিনি ছিলেন সাদামাটা নির্ভেজাল একজন সদালাপী মানুষ। দুঃখভারাক্রান্ত মন ভালো হয়ে যেতো স্যারের সঙ্গে কথা বললে। বর্তমান সমাজে আদর্শ শিক্ষকের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে দিনের পর দিন।

মনজুর মোরশেদ স্যার ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক ও মেনটর। তাই তিনি পরিচিত হয়েছিলেন 'শিক্ষাগুরু' হিসেবে। জ্ঞানের বাতিঘর ছিলেন তিনি। ক্লাসের পাঠদানের সময় অত্যন্ত সময়নিষ্ঠ ও যত্নবান ছিলেন। অনর্গল বক্তার ন্যায় পাঠদান করেছেন সাবলীল শৈলীতৈ। ঘন্টা পেরিয়ে সময় যে কখন শেষ হতো তা টেরই পাওয়া যেতো না। তিনি সুশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন, ছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার অন্যতম প্রতিভূ। আমৃত্যু তিনি ভাষাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বিতরণ করেছেন। তার ছোঁয়ায় বাংলাদেশের ভাষাবিজ্ঞান অঙ্গন ঋদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশে চমস্কির 'রূপান্তরমূলক সৃষ্টিশীল ব্যাকরণ' চর্চার পথিকৃৎ তিনি। বাক্য বিশ্লেষণে চমস্কি প্রবর্তিত শিশুর ভাষা অর্জনের বিষয়টি তিনি এ অঞ্চলের পাঠকের কাছে প্রথম উপস্থাপন করেন। 

একজন শিক্ষক সমাজের সম্পদ। রাষ্ট্রের পরামর্শক ও জ্ঞানের বার্তাবাহক। মনজুর মোরশেদ স্যার একজন শিক্ষক হিসেবে সকল গুণের অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন সমাজচিন্তক। সমাজের করুণ চিত্র তাকে ব্যাথিত করতো। তিনি এ থেকে পরিত্রাণের উপদেশ ও নির্দেশনা দিয়ে কলম ধরেছেন। বস্তুনিষ্ঠ ও সত্যের প্রতীক এ-সব লেখনী পাঠকের কাছে আদৃত হয়েছে। তিনি হয়ে ওঠেছিলেন সবার শিক্ষক। ব্যক্তি থেকে সমাজের শিক্ষক হয়ে জ্ঞানের আলোয় আলোকিত করেছেন সমাজকে। জীবনানন্দ দাশের 'মানুষের মৃত্যু হলে কবিতায়' আছে- মানুষ মরে গেলেও মানব থেকে যায়। স্যারের মৃত্যু হলেও সমাজের দিশাবাহী লেখাগুলোর মৃত্যু হবে না। 

'কীর্তিমানের মৃত্যু নেই'-এ-সত্যটি অনুধাবিত হয় তার লেখাগুলো পড়ার মাধ্যমে। তিনি বেঁচে থাকবেন সাহিত্যে, ভাষাবিজ্ঞানে কিংবা সজ্জন ব্যক্তির দৃষ্টান্ত হিসেবে। পাঠের মাধ্যমে স্যারকে স্মরণ করা আমাদের কর্তব্য। পাঠ-চর্চার মাধ্যমে স্যার যেমন মননে অমর হয়ে রইবেন তেমনি আমরা আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবো নিজেকে। চিরায়ত আদর্শবান শিক্ষকের কখনও মৃত্যু হয় না। মনজুর মোরশেদ স্যার সেই ইতিবাচক আদর্শবান শিক্ষকের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কর্মের মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল। 

Comments

The Daily Star  | English

No place for Islamic extremism in Bangladesh: Yunus

Islamic extremism will never find a place in Bangladesh again, said Chief Adviser Muhammad Yunus recently

1h ago