মিলান কুন্ডেরার লেখায় দার্শনিক রূপান্তর

স্লোনেস নামক বইতে একজন দম্পতির চোখে দেখা বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করে উপন্যাসটিকে দাঁড় করিয়েছেন। তবে উল্লেখিত দম্পতি হলো তার স্ত্রী ও মিলান কুন্ডেরা নিজেই।
ছবি: সংগৃহীত

পৃথিবীর প্রায় সব ক্ষমতাসীনরাই লেখক-শিল্পীদের জুজুর ভয় দেখিয়ে আনন্দ পান। ফলে কাফকার দেশ চেকোস্লোভাকিয়ায় জন্ম নিয়েও সেখানে বেশিদিন থাকতে পারেননি মিলান কুন্ডেরা। তিনি চেক সরকারের রোষানলে দেশ ছাড়তেও বাধ্য হয়েছেন। ঠাঁই হয় ছবির দেশে কবিতার দেশে। ফ্রান্সে উঠে লিখেছেন ছোট্ট একটা উপন্যাস, যার বাংলা নাম- ধীরতা বা মন্থর। ফ্রান্সে এসেই যেন পাল্টে গেল তার উপন্যাসের ধরন। গল্পে নিয়ে এলেন তির্যক দর্শনের কথা।

সাহিত্য সমালোচকরা বলেন, 'মিলান কুন্ডেরার প্রথম দিকের লেখাগুলো কমিউনিস্ট দর্শন দ্বারা প্রভাবিত'। বুর্জোয়া পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তবে এতে বেশিদিন থাকতে পারেননি। পড়াশোনার জন্য পারি দিয়েছিলেন প্রাগে। সেখানের চার্লস ইউনিভার্সিটিতে সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে পড়ালেখা শুরু করেন। পরবর্তীতে প্রাগ শহরের 'ফিল্ম ফ্যাকাল্টি অব দ্য পারফর্মিং আর্টস'-এ তিনি চলচ্চিত্র ও চিত্রনাট্য বিষয় কোর্স করেন। পাঠ শেষে এই প্রতিষ্ঠানেই শিক্ষকতায় যোগ দেন। এই সেই প্রাগ, যেখান থেকে কাফকা ছড়িয়ে পড়েছিলেন পুরো পৃথিবীতে। কাফকার প্রাগকে বেশিদিন নিজের করে রাখতে পারেননি কুন্ডেরা। ১৯৫৬ সালে পুনরায় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং ৪ বছর পর বহিষ্কৃত হন।

মিলান কুন্ডেরা রাজনীতির দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে এনেছিলেন দর্শন চর্চায়। তবে লেখক হিসেবে তার দর্শন চর্চার মূল মাধ্যম ছিল লেখালেখি। বিশেষ করে দেশ ছাড়ার পর ফ্রান্সে থাকাকালীন তার লেখায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। উপন্যাসের মধ্যে রাজনৈতিক দর্শনের স্থান দিতে শুরু করেন। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, তিনি ফ্রান্সে এসে চেক ভাষায় লেখালেখি বাদ দেন। আগের লেখাগুলোকেও তিনি ফ্রান্সের ভাষায় অনুবাদ করেন। ফ্রান্সে থাকাকালীন ফ্রেঞ্চ ভাষায় প্রথম যেই উপন্যাসটি লেখেন, তার নাম ইংরেজিতে 'স্লোনেস'। বাংলায় ধীরতা। উপন্যাসটি আকারে অনেক ছোট বলা চলে। কিন্তু ফ্রেঞ্চ ভাষায় উপন্যাসের আড়ালে এটিই ছিল মিলান কুন্ডেরার প্রথম দর্শনের বয়ান।

'স্লোনেস' বইটি লেখার আগে মিলান কুন্ডেরার লেখায় বিভিন্ন ধরনের নিরীক্ষা দেখতে পাওয়া যায়। ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত হওয়া তাঁর প্রথম উপন্যাস 'দ্য জোক' (ঠাট্টা) মূলত ছিল কমিউনিস্ট সরকারের 'সর্বগ্রাসী' মনোভাবের কড়া সমালোচনা। এর যে ভঙ্গিম বেছে নিয়েছিলেন, তা তার অন্যান্য লেখা থেকে আলাদা। বলে রাখা ভালো, এক সময়ের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য মিলেন কুন্ডেরার এই বইয়ের জন্য ১৯৭৩ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় তার লেখা নিষিদ্ধ করা হয়।

তবে এই 'স্যাঙ্কশন' ঘোষণায় মিলেন কুন্ডেরার লেখালেখিতে তেমন পরিবর্তনটা আসেনি। পরের উপন্যাস 'লাইফ ইজ অ্যালসহোয়ার' বইতে এমন একটি গল্প লেখেন, যেখানে উঠে আসে একজন আদর্শবাদী কবির জীবনে রাজনৈতিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার গল্প। সেসময় অনেকে এটিকে মিলান কুন্ডেরার নিজের দশা হিসেবে গল্পটিকে দেখলেও ক্রমেই কুন্ডেরার সাহিত্যের বৈচিত্র্য সবার সামনে প্রকাশিত হতে শুরু করে।

আশির দশকে মিলান কুন্ডেরার লেখায় পরিবর্তন আসে। রাজনীতি থেকে বেরিয়ে দর্শনকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন রচনায়। মিলান এসব নিরীক্ষা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল বলেই গণ্য হয়েছিল। 'দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিয়িং' উপন্যাসটি প্রকাশের পর বিশ্বের সাহিত্য পাঠকদের মধ্যে বইটি নাড়া দেয়। তিনিকমিউনিজম রাজনীতির 'ক্রিটিক' নামক গণ্ডি থেকে বেরিয়ে দর্শনে প্রবেশ করেন। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মিলেন কুন্ডেরার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়া দেওয়া দর্শনগুলো অতটা মোলায়েম ছিল না। তাই ৯৪ বছরের দীর্ঘ জীবন শেষে বলতে হয়, মিলান কুন্ডেরা মূলত কিছু তীর্যক দর্শনই রেখে গেছেন।

স্লোনেস নামক বইতে একজন দম্পতির চোখে দেখা বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করে উপন্যাসটিকে দাঁড় করিয়েছেন। তবে উল্লেখিত দম্পতি হলো তার স্ত্রী ও মিলান কুন্ডেরা নিজেই। উপন্যাস শুরু হয় খুবই হালকা চালে 'আমাদের হঠাৎই মনে হলো, একটা বাগানবাড়িতেই তো আমরা সন্ধ্যা থেকে রাতটা কাটিয়ে ফেলতে পারি'। বাক্যটি থেকে রোমাঞ্চকর কোন গল্পের ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও ক্রমেই সেটি বর্ণনামূলক ঘটনার একটি যাত্রা হয়ে দাঁড়ায়। যেখানে গল্প কথক অর্থাৎ লেখক নিজেই বিভিন্ন জটিল দার্শনিক বিষয় নিয়ে মতামত দিতে থাকেন আর মাঝে মাঝে উপন্যাস নিয়েও আলোচনা করেন।

বইটির প্রথম একাংশ পড়তে পড়তেই দেখা যায় প্যারিস থেকে ঘুরতে বের হওয়া দম্পতির গল্প ধীরে ধীরে রূপ নেয় ধীরগতির দার্শনিক আলাপে। একসময় আলোচনায় আসে দু'টো উপন্যাস। সেই উপন্যাসের আলোচনাকে ছাপিয়ে ভোগবাদীতার দার্শনিক রূপও উঠে আসে। তাদের এই যাত্রায় দেখা বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে কথা হয় সোমালিয়ার শিশুদের নিয়েও।

ঘুরতে গিয়ে দার্শনিক গল্প বলার এই ভঙ্গিমা যেটা মিলান কুন্ডেরা 'স্লোনেস' বই লিখতে ব্যবহার করেছেন, এর সঙ্গে মিল পাওয়া যায় ইতালো ক্যালভিনোর লেখা 'ইনভিজিবল সিটিজ' বা 'গায়েবি শহর' বইয়ের সঙ্গে। যদিও সেই বইটিতে ভ্রমণ সাহিত্যকে আতশ কাঁচের নিচে ফেলে প্রায় ভেঙ্গে ফেলে নতুন একটি নকশায় লেখা হয়েছিল। তবে মিলানের 'স্লোনেস' বই লেখার সময় ইতালো ক্যালভিনোর পথে হাঁটেননি। বাস্তব জীবনেও মিলান ইতালো ক্যালভিনোর মত ওত সৌভাগ্যবান ছিলেন না। ২০১৮ সালে মহীবুল আজিজ লেখেন, 'ইতালো ক্যালভিনো হলেন সেই লেখক, যার মৃত্যুর পর ইতালির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট তার মরদেহ বয়ে আনবার জন্য একটি বিশেষ বিমান পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। মস্কোয় ইতালীয় ভাষায় লেখাপড়া করার একটি স্কুলের নাম তার নামে, 'স্কুলা ইতালিয়ানা ইতালো ক্যালভিনো'। আমাদের মিলান কুন্দেরার নামেও একটি লাইব্রেরি করা হয়েছে তার নিজের দেশ চেকোস্লাভাকিয়ায়। তবে দেশ থেকে এক ধরনের বিতাড়িত করার বহু পরে তারা বুঝতে পেরেছিলেন মিলান কুন্দেরা আমাদের সম্পদ। তার মিলান কুন্দেরার জীবনে কিছু দিতে না পারলেও মৃত্যুর খবরটা নিশ্চিত করেছিল চেকোস্লোভাকিয়ার বার্নো শহরের মিলান কুন্দেরা লাইব্রেরির'। (বাংলানিউজ টুয়েন্টিফোর)

'স্লোনেস' নিয়ে আলাপ করতে গেলে ইতালো ক্যালভিনোর প্রসঙ্গ বইয়ের কারণে প্রাসঙ্গিক তা নয়; বরং লেখক হিসেবেও দু'জনের মধ্যে খানিকটা সাদৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। লাতিন আমেরিকার লেখক ক্যালভিনো জীবনের শুরুর দিকে ছিলেন সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার। কিন্তু ক্যালভিনো শেষ পর্যন্ত শিল্প ও সাহিত্যের স্বাধীনতার জন্য কোন দাসত্বের পথে হাঁটেননি। এছাড়াও চলচ্চিত্র বিষয়েও ছিল তার অগাধ জ্ঞান। মিলান কুন্ডেরার চলচ্চিত্র বিষয়ে জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি ব্যক্তি স্বতন্ত্রতার দিক থেকে ক্যালভিনোর সঙ্গে ভালোই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। 

মিলান কুন্ডেরার ফ্রেঞ্চ ভাষায় লেখা প্রথম উপন্যাস 'স্লোনেস' বই প্রসঙ্গে আসি। এর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় গল্পের রূপান্তর ঘটে। প্রথমদিকে ভ্রমণ গল্প মনে হলেও একসময় গল্পটিকে দার্শনিক আলাপে ঠাসা বলে মনে হতে থাকে। তবে শেষে 'স্লোনেস' বইতে চমৎকার একটা ব্যাপার ঘটে। ধীরে ধীরে দার্শনিক বিভিন্ন মতামত প্রদান করে মিলেন কুন্ডেরা আমাদের নিয়ে যান পরাবাস্তব এক জগতে। একসময় বুঝতে পারি, এতক্ষণ আমরা যেই গল্পটি লেখকের অভিজ্ঞতা বলে ভাবছিলাম, সেটি আসলে তিনি কল্পনা করছেন। আসলে পুরো ভাবনাটা স্বপ্নে দেখছেন ভেরা অর্থাৎ তার স্ত্রী। গল্পের শেষে তিনি তিন পক্ষকে এক জায়গায় নিয়ে আসেন। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেভালিয়ে, বিংশ শতাব্দীর ভিনসেন্ট ও নিজেকে, যিনি কিনা এই গল্পটা লিখছেন বা ভাবছেন।

এই ধরনের পরাবাস্তব বৈশিষ্ট্য আমরা দেখতে পাই জাদুবাস্তব ঘরানার লেখাগুলোতে। হোর্হে লুইজ বোর্হেস তার লেখা 'পার্শিয়াল ম্যাজিক ইন দ্য কুইকসোট' প্রবন্ধে অদ্ভুত একটি বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি দেখান যে, ডন কুইকসোট নিজেই কুইকসোটের কাহিনি পাঠ করছে। বিশ্ববিখ্যাত নাটক 'হ্যামলেট' দেখতে গেলেও আমরা খেয়াল করি, যেখানে হ্যামলেট চরিত্রটি নাটক দেখতে থাকেন, যা তার নিজের জীবনের গল্পের মত। এছাড়াও ভারতীয় পুরাণ সাহিত্যে এ ধরণের জাদুবাস্তবতার চিত্র আসে। এমনকি আরব্য রজনীর মত সাহিত্যেও সুলতানকে প্রতি রাতে গল্প শোনাতে গিয়ে একদিন শাহেরজাদি সুলতানকে সুলনাতেরই গল্প শোনান।

মিলান কুন্ডেরার জীবন অবসান হবার আগে তাকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি 'জোক' করেছে হয়তোবা নোবেল কমিটি। প্রায় প্রতি বছর সাহিত্যে নোবেল পাবার গুঞ্জন শোনা গেলেও নোবেল পাননি তিনি। জন্মভূমি চেকোস্লোভাকিয়া থেকে বেরিয়ে সারাজীবন নিজেকে ফ্রান্সের লেখক হিসেবেই দাবি করেছিলেন। তার লেখায় রাজনীতি ও দার্শনিক রূপান্তর ঘটেছে। তবে স্লোনেস বইটির গল্প বলার ভঙ্গিমা আমাদের ঘোরের মধ্যে রাখে।

হোর্হে লুইজ বোর্হেজ বলেছিলেন, গল্পের চরিত্র নিজেই গল্পের শ্রোতা হয়ে যায়, তখন পাঠকেরা হয়ে যায় কল্পিত চরিত্র। স্লোনেস পড়তে পড়তে তাই আমাদের আর নিজেকে সত্যিকারের মানুষ বলে মনে হয় না। মনে হতে থাকে মিলান কুন্ডেরার 'স্লোনেস' বইটার জগতই হয়তোবা সত্যিকারের জগৎ।

Comments

The Daily Star  | English

The story of Gaza genocide survivor in Bangladesh

In this exclusive interview with The Daily Star, Kamel provides a painful firsthand account of 170 days of carnage.

1d ago