শ্রদ্ধা

কিংবদন্তির কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ

"মাগো, ওরা বলে,/ সবার কথা কেড়ে নেবে।/ তোমার কোলে শুয়ে/ গল্প শুনতে দেবে না।/ বলো, মা, তাই কি হয়?/ তাইতো আমার দেরি হচ্ছে।/ তোমার জন্যে কথার ঝুড়ি নিয়ে/ তবেই না বাড়ী ফিরবো।/ লক্ষ্মী মা, রাগ ক'রো না,/ মাত্রতো আর কটা দিন।" —ভাষা আন্দোলনে শহীদ হওয়া কোনো এক সন্তানের পকেটে থাকা ছেঁড়া আর রক্তে ভেজা এই চিঠির রচয়িতা কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ। কবিতার নাম 'কোনো এক মা'কে'। 
১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ঐতিহাসিক 'একুশে ফেব্রুয়ারী' সংকলনের অন্যতম কবিতা এটি। ভাববৈচিত্র ও কলেবরে দীর্ঘকবিতা না হলেও কবিতাটির মধ্যে আবেগের গভীরতা আর বিষাদের দীর্ঘশ্বাস রয়েছে। সূচনা পর্বের এই আবেগের গভীরতা ও বিষাদের দীর্ঘশ্বাস পরিণত-পর্বে ওবায়দুল্লাহকে দীর্ঘকবিতার কবি করে তুলেছে।

আশির দশকে রচিত 'আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি' ও 'বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা' আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর অনবদ্য সৃষ্টি। কলেবর ও ভাববৈচিত্রে, দুর্দান্ত অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত শব্দবুননে, যূথবদ্ধজীবনের সত্যোন্মোচনে, এককজীবনের মাহাত্ম্যনির্মাণে, অথবা সিঙ্গেল ইমোশনকে অতিক্রমণের মানদণ্ডে কবিতা দুটি দীর্ঘকবিতা। কবিতা দুটির পাঠকপ্রিয়তাও আকাশস্পর্শী। যে-কারণে পঞ্চাশের দশকের স্বতন্ত্র কণ্ঠের কবি কিংবা মৌলিক কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ কিংবদন্তির কবি হিসেবেই পরিচিত।

দীর্ঘকবিতা 'বিদ্রোহী'র জন্য নজরুল যেমন বিদ্রোহী কবি, তেমনি 'আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি'র জন্য ওবায়দুল্লাহ কিংবদন্তির কবি। কবিতাটির সূচনায় কবি নির্দেশ করেছেন হাজার বছরের লোকজ ঐতিহ্য, কৃষিসভ্যতা, উৎপাদন, শ্রম, প্রতিকূলতা ও সৃষ্টির আনন্দ : 
'আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি/ আমি আমার পূর্বপুরুষের কথা বলছি।/ তার করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিল/ তার পিঠে রক্তজবার মত ক্ষত ছিল।/ তিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন/ অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন/ পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন/ তিনি কবি ও কবিতার কথা বলতেন।' এরপরই কবি উল্লেখ করলেন : 'জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি সত্য শব্দ কবিতা/ কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।' অর্থাৎ কবির চেতনায়, উচ্চারিত সত্য শব্দ= কবিতা = উৎপাদিত শস্যদানা।

সত্যোচ্চারণ ও শস্যউৎপাদন ব্যতীত জীবন ক্রীতদাসের নামান্তর; যা অভিশপ্ত ও বিভীষিকাময়। কবির এই জীবনচৈতন্য অভিব্যঞ্জিত হয়েছে পরবর্তী পঙক্তিমালায় : 'যে কবিতা শুনতে জানে না/ সে ঝড়ের আর্তনাদ শুনবে।/ যে কবিতা শুনতে জানে না/ সে দিগন্তের অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।/ যে কবিতা শুনতে জানে না/ সে আজন্ম ক্রীতদাস থেকে যাবে।' সত্য ও সৃষ্টিহীন কিংবা কর্ম ও উৎপাদনে অক্ষম জীবনের করুণ পরিণতি সম্পর্কে কবির উচ্চারণ কিংবা অভিজ্ঞতা : 'যে কর্ষণ করে তার প্রতিটি স্বেদবিন্দু কবিতা/ কর্ষিত জমির প্রতিটি শস্যদানা কবিতা।/ যে কবিতা শুনতে জানে না/ শস্যহীন প্রান্তর তাকে পরিহাস করবে।/ যে কবিতা শুনতে জানে না/ সে মাতৃস্তন্য থেকে বঞ্চিত হবে।/ যে কবিতা শুনতে জানে না/ সে আজন্ম ক্ষুধার্ত থেকে যাবে।' 

অপরদিকে, আজন্ম ক্ষুধার্ত কিংবা আজন্ম ক্রীতদাস থেকে উত্তরণের তত্ত্বকথায় কবি বলেন : 'যে কর্ষণ করে/ শস্যের সম্ভার তাকে সমৃদ্ধ করবে।/ যে মৎস লালন করে/ প্রবহমান নদী তাকে পুরস্কৃত করবে।/ যে গাভীর পরিচর্যা করে/ জননীর আশীর্বাদ তাকে দীর্ঘায়ু করবে।/ যে লৌহখণ্ডকে প্রজ্বলিত করে/ ইস্পাতের তরবারি তাকে সশস্ত্র করবে।' অর্থাৎ কবির চেতনায়, সাধনা = সাফল্য; পরিশ্রম = সফলতা = সমৃদ্ধ বা সমৃদ্ধি।

কবিতাটির শেষাংশে তারুণ্যের উচ্ছ্বাসস্বরূপ আন্দোলন-প্রতিবাদ-প্রতিরোধকে কবিতার সমার্থক বিবেচনা করে আরাধ্য কোনো পূর্বপুরুষকে কবিতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্ম করে তোলা এবং তাঁর মতো হওয়ার তাগিদ অনুভূত হয়েছে : 'সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান কবিতা/ সুপুরুষ ভালবাসার সুকণ্ঠ সংগীত কবিতা/ জিহ্বায় উচ্চারিত প্রতিটি মুক্ত শব্দ কবিতা/ রক্তজবার মত প্রতিরোধের উচ্চারণ কবিতা।/ আমরা কি তাঁর মত কবিতার কথা বলতে পারবো।/ আমরা কি তাঁর মত স্বাধীনতার কথা বলতে পারবো!'

'আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি' দীর্ঘকবিতাটি বিশ্লেষণ করলে যে দিকগুলো উঠে আসে, তা হলো : ক. জীবনচৈতন্যে কবিতার অপার্থিব শক্তি অবলোকন। কবি জীবনকে শিল্পের অনুগামী করে তুলেছেন; যেখানে জীবন ও শিল্পের ব্যবচ্ছেদ অসম্ভব। কবির চেতনায় কবিতা এবং সৃষ্টি, গতি ও অগ্রসরতা সমার্থক। খ. এ-কবিতায় কবির অভিসম্পাত বা অভিশাপ মূলত জীবনাভিজ্ঞতার কাব্যব্যঞ্জনায় উচ্চকিত ও উচ্ছ্বসিত। 

সমগ্র মানবজীবনের সার্বিক উত্থান-পতন, বিষাদ-আনন্দ, ক্ষত-পূর্ণের অভিজ্ঞান ও ইতিহাসচৈতন্য এ-কবিতার মর্মমূলে প্রোথিত। গ. এ-কবিতাটি একইসঙ্গে অতীত ও সমকালের, কোমল ও কাঠিন্যের, অভিশাপ ও আশাবাদের এবং আমি ও আমাদের; অর্থাৎ, ব্যক্তি ও সমষ্টিচেতনার। ঘ. এ-কবিতায় বাঙালি জাতির আর্থরাজনৈতিক ইতিহাস ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয় সুস্পষ্ট। ঙ. এ-কবিতায় একজন আজন্ম অনিচ্ছুক ক্রীতদাস থেকে উত্তরণের অনুপ্রেরণা ও স্বপ্নাকাঙ্ক্ষা প্রদীপ্ত ও প্রত্যয়িত হয়েছে। শেষপর্যন্ত কবিতাটি সংহতি ও যূথবদ্ধ আন্দোলনের, প্রবহমান প্রতিরোধের এবং সশস্ত্র অভ্যুত্থান ও স্বাধীনতা সংগ্রামের।

'আমি কিংবদন্তীর কথা বলছি'র অনুগামী আরেকটি মৌলিক দীর্ঘকবিতা হচ্ছে 'বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা'। যেখানে বর্ণিত ও ব্যঞ্জনাদীপ্ত হয়েছে ঊষর-বিবর্ণ-বন্ধ্যা সময়জ্ঞানে চোখ-গান-গোলাপ-ছায়াহীন শূন্য-রূঢ়-নিষিদ্ধ সমাজবাস্তবতায় সৃষ্টিশীল ব্যক্তিমানুষের হাহাকার ও নিঃসঙ্গতা এবং যুদ্ধভীরু কাপুরুষতার বঞ্চনা ও সাহসহীন ভীত-সন্ত্রস্ত জীবনে পরাজয়ের গ্লানি এবং নিজের অক্ষমতায় আরাধ্য সাহসী পুরুষের জন্য কাতরতা ও সশব্দ প্রতিবাদের অক্ষমতায় নিরুপায় মানুষের নিঃশব্দ প্রার্থনা : 'আমাদের বিশুষ্ক ভূমি/ তিমির মতন যেন জলে ভেসে ওঠে/ আমাদের তৃষ্ণার্ত ভূমি/ জননীর শিশু যেন স্তন্য পান করে/ আমাদের চিরবন্ধ্যা ভূমি বৃষ্টির আদরে যেন গর্ভবতী হয়।' 

প্রথম কবিতায় যার করতলে পলিমাটির সৌরভ ছিলো, যার পিঠে রক্তজবার মতো ক্ষত ছিলো, যিনি অতিক্রান্ত পাহাড়ের কথা বলতেন, অরণ্য এবং শ্বাপদের কথা বলতেন, পতিত জমি আবাদের কথা বলতেন—,  দ্বিতীয় কবিতায় তিনি বর্ণ ও বৃষ্টির সমার্থক, তিনি চির জয়ী ও সাহসী, তিনি যুদ্ধে গেছেন; কিন্তু ফিরে আসেন নি; তাঁর প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশায় উচ্চারিত হয়েছে কবির অনন্ত প্রার্থনা। 

সৃষ্টি ও উৎপাদন, সত্য ও সমৃদ্ধি, জীবন ও শিল্প, সাহস ও সংগ্রামের বার্তাবহ আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর দীর্ঘকবিতা। এতে অনুচ্চ স্বরে আদিম সারল্যে বিশিষ্ট মাধুর্যে কবি যে অনুর্বর বিরানভূমি ও কর্ষিত মৃত্তিকার চিত্রকল্প এঁকেছেন, তা শুধু তাঁর স্বদেশ ও সমকালে বৃত্তাবদ্ধ নয়। বস্তুত তা মুক্ত-স্বাধীন-সৃজনশীল জীবনের প্রশ্নে উন্নত-গতিময়-সভ্য সভ্যতার আকাঙ্ক্ষায় অন্ধকার ও আলোর চেতনায় যেকোনো সময়েই যেকোনো ভূগোলেই প্রযোজ্য। যে কারণে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ শুধু একজন ছড়াকার নন, তিনি কবি; কোনো সৌখিন কবি নন, তিনি দীর্ঘ মৌলিক কবিতার কবি।

Comments