প্রান্তিক মানুষের কথাকার অদ্বৈত মল্লবর্মণ

অদ্বৈত মল্লবর্মণ। তার কোনো ছবি পাওয়া যায় না। এটি ছিল হাতে আঁকা স্কেচ। সংগৃহীত

২০১৪ সালের কথা। এক টিভি অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত সাহিত্যিক হরিশংকর জলদাসকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, 'মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মা নদীর মাঝি এবং অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের মধ্যে জেলেজীবন ও সমাজচিত্র উপস্থাপনের মৌলিকতা আর আন্তরিকতায় কোন উপন্যাসটি সেরা?'

জবাবে হরিশংকর জলদাস বলেছিলেন, 'অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম জেলে জীবনের পাঁচালি। শুধু পদ্মা নদীর মাঝি কেন, পরে গঙ্গা, গহিন গাঙ, গঙ্গা একটি নদীর নাম, অবগাহন—এসব জেলে জীবনভিত্তিক যে যে উপন্যাস রচিত হয়েছে, এদের কোনোটিই তিতাসের সমতুল্য নয়। নদীপাড়ের কৈবর্তজীবনের অনুপুঙ্খ দলিল বলা যেতে পারে তিতাসকে। আমার মতে, অদ্বৈতের তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাস এখনও একক এবং তুলনাহীন।'

'তিতাস একটি নদীর নাম' যখন গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় তখন আর বেঁচে ছিলেন না অদ্বৈত মল্লবর্মণ। তার মৃত্যু হয় তারও বছর পাঁচেক আগে।

মাত্র ৩৭ বছরের আয়ু পেয়েছিলেন তিনি। এই ক্ষুদ্র জীবনে তিতাস একটি নদীর নাম বাদেও লিখেছেন 'সাদা হাওয়া' 'রাঙামাটি' নামের আরও ২টি উপন্যাস। যদিও এর কোনোটিই তিনি বেঁচে থাকা অবস্থায় গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। আর্ভিং স্টোনের 'লাস্ট ফর লাইফ'থেকে তার অনূদিত 'জীবনতৃষ্ণা' প্রকাশিত হয়েছিল দেশ পত্রিকায়।

অদ্বৈত মল্লবর্মণের জীবনটাই ছিল আদ্যোপান্ত সংগ্রামে পরিপূর্ণ। জন্মেছিলেন তিতাস তীরবর্তী ধীবর সম্প্রদায়ের অতি দরিদ্র এক পরিবারে। শৈশবে হারিয়েছিলেন বাবা-মাকে। হারিয়েছেন তার বাকি ৩ ভাইবোনকেও।  

ভীষণ মেধাবী হওয়ায় তার পড়াশোনা চলেছিল তিতাস পাড়ের ধীবর সম্প্রদায় অর্থাৎ মালোদের চাঁদা উঠানোর টাকায়। কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় এক পর্যায়ে আর্থিক পরিস্থিতির কারণে পড়াশোনায় ইতি টানতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি।

এক সময় জীবিকার তাগিদে কলকাতা যাত্রা করেন। মাসিক ত্রিপুরা পত্রিকার মাধ্যমে শুরু করেন সাংবাদিকতা। সেখান থেকে পরবর্তীতে নরেন দত্তের 'নবশক্তি' পত্রিকায় যোগদান। সেই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন প্রখ্যাত কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র। কিন্তু হুট করে নবশক্তির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেলে অদ্বৈত মল্লবর্মণ যোগ দেন মওলানা আকরাম খাঁয়ের সম্পাদনায় প্রকাশিত মাসিক মোহাম্মদীতে। একই সঙ্গে তিনি কাজ করতেন দৈনিক আজাদ পত্রিকায়ও। পরে নানা পদে তিনি কাজ করেছিলেন 'নবযুগ', 'কৃষক', 'যুগান্তর'পত্রিকায়।

অদ্বৈতর সাহিত্যে হাতেখড়ি হয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাইনর স্কুলে পড়ার সময়েই। তখন হবিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয় তার প্রথম কবিতা।

গোকর্ণহাটে পৈত্রিক বাড়ির সামনে অদ্বৈত মল্লবর্মণের আবক্ষ মূর্তি। ছবি: সংগৃহীত

মাইনর স্কুল থেকে বৃত্তি পেয়ে তিনি ভর্তি হন অন্নদা হাইস্কুলে। অগ্নিযুগের বিপ্লবী সুবোধ চৌধুরী পড়তেন অদ্বৈত মল্লবর্মণের এক ক্লাস ওপরে। তিনি লিখেছিলেন, 'অদ্বৈতের সঙ্গে আমার পরিচয় সম্পর্ক তখন থেকে। একটানা নয়। কারণ মাঝখানে আমরা জুড়ে গেলাম বৈপ্লবিক রাজনীতিতে, টানা ৬ বছর বিনা বিচারে বহরমপুরসহ বিভিন্ন বন্দিশালায় থাকতে হলো। তারপর আমাদের জীবনের বাঁক ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ল কলকাতা মহানগরীতে। সে চল্লিশের দশক।'

বলে রাখা ভালো, অদ্বৈত কলকাতা যাওয়ার পরেই বিপ্লবী অনুশীলন সমিতির সদস্য হয়েছিলেন। কারণ বৈপ্লবিক দলে নাম লেখালে বা কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত হলে বৃত্তি বাতিল হয়ে যেত।

সুবোধ চৌধুরী লিখেছিলেন, '১৯২৮-২৯ নাগাদ আমাদের স্কুলে ধর্মঘট হয়। স্কুল প্রায় জনমানবশূন্য। ফাঁকা স্কুল ঘরের কোথাও কেউ আছে কি না দেখতে গিয়ে বড় হলঘরের এক কোণায় দেখতে পেলাম অদ্বৈতকেও। কাঁদছেন। কারণ তার ধারণা ধর্মঘটে যোগ দিলে তার স্কলারশিপ চলে যাবে। তাহলে তো পড়তেই পারবে না। আর ধর্মঘটে যোগ না দেওয়া তো মানতে পারছে না।'

চল্লিশের দশকের প্রথম ভাগে অদ্বৈত মল্লবর্মণের গল্প ছাপা হয়েছিল বুদ্ধদেব বসুর 'এক পয়সার একটি গল্প' সিরিজে। সেই গল্পটি ছাপা হওয়ার পরপরই অদ্বৈত মল্লবর্মণের অসামান্য গদ্য নজরে আসে সবার। গল্পকার হিসেবে অদ্বৈত মল্লবর্মণ ছিলেন অসামান্য। চল্লিশের দশকের প্রথম ভাগে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখ সম্পাদিত 'এক পয়সায় একটি' শীর্ষক ধারাবাহিকে লিখে অদ্বৈত মল্লবর্মণ পাঠকসমাজে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন।

গদ্যকার এবং কবির বাইরে অদ্বৈত মল্লবর্মণ ছিলেন অনুসন্ধানী এক গবেষকও। তার লেখা ২৪টি প্রবন্ধ-নিবন্ধ আছে।

তার লেখায় এসেছে অপ্রকাশিত পল্লী গীতি, ত্রিপুরার বারোমাসি গান থেকে সীতার বারোমাসি পল্লী সঙ্গীতে পালা গান। অপ্রকাশিত পুতুল বিয়ের ছড়া সংগ্রহের মাধ্যমে অদ্বৈত নানা গ্রাম্য পালা ও সঙ্গীতকে পরম মমতায় তুলে এনেছেন পত্রিকা ও পাণ্ডুলিপির পাতায়। ঐতিহ্য, সঙ্গীত, আর লোকগীতির এক স্বর্ণভাণ্ডারকে তিনি উপস্থাপন করেছেন নিখুঁত বয়ানে। অদ্বৈতের 'বর্ষা মঙ্গল', 'আম্রতত্ত্ব' লেখাগুলো স্থানকাল পাত্র ভেদে হয়ে উঠেছিল অনন্য।

অদ্বৈত মল্লবর্মণ উঠে এসেছেন ধীবর সম্প্রদায় থেকে, দারিদ্রতার নির্মমতম অভিযাত্রা পাড়ি দিয়ে। পরবর্তী জীবনে আপন সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনচর্চা, সংগ্রামী জীবনকে পরম যত্নে সাহিত্যের পাতায় তুলে এনেছেন তিনি।

যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ তার তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি। উপন্যাসটিতে উঠে এসেছে মৎস্যজীবী মানুষের কাহিনী, যারা অদ্বৈত মল্লবর্মণের আত্মার আত্মীয়। অদ্বৈত তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও সুগভীর অন্তদৃষ্টিতে উপন্যাসটিতে ধীবর সমাজের নিষ্ঠুর জীবন সংগ্রামের সাধারণ কাহিনীকে দিয়েছেন অবিনশ্বর এক মাত্রা।

উপন্যাসটির ভূমিকাংশে অদ্বৈত লিখেছিলেন, 'তিতাস একটি নদীর নাম। তার কূলজোড়া জল, বুকভরা ঢেউ, প্রাণভরা উচ্ছ্বাস। স্বপ্নের ছন্দে সে বহিয়া যায়। ভোরের হাওয়ায় তার তন্দ্রা ভাঙে, দিনের সূর্য তাকে তাতায়; রাতে চাঁদ ও তারারা তাকে নিয়া ঘুম পাড়াইতে বসে, কিন্তু পারে না।'

অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখা তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের প্রচ্ছদ। ছবি: সংগৃহীত

তিতাস জীবনের শেকড় প্রাকৃত জীবনের গভীরে প্রোথিত। এই প্রাকৃত জীবনকে বাইরে থেকে যতই সরল দেখাক, এর ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যাবে তা বহু ভঙ্গিমা ও বৈচিত্র্যের অধিকারী।

তিতাস একটি নদীর নাম প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল মওলানা আকরাম খাঁ সম্পাদিত মাসিক মোহাম্মদীতে। তবে উপন্যাসটির প্রথম কয়েক কিস্তি মোহাম্মদীতে প্রকাশিত হওয়ার পরে উপন্যাসের মূল পাণ্ডুলিপি হারিয়ে গিয়েছিল। এক পর্যায়ে উপন্যাসটির প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। তখন মোহাম্মদীর পাঠকরা উপন্যাসের বাকি অংশ প্রকাশ করার দাবি জানান। বন্ধু ও পাঠকদের একের পর এক অনুরোধে উপন্যাসটির অবশিষ্ট অংশ লিখতে বাধ্য হন অদ্বৈত মল্লবর্মণ। যক্ষ্মায় মৃত্যুর আগে হাসপাতালে যাওয়ার সময় উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি বন্ধুদের হাতে দিয়ে গিয়েছিলেন তিনি।

অদ্বৈত মল্লবর্মণকে বলা যায় সময় কিংবা কালের প্রতিনিধিও। চল্লিশের দশকের শুরু থেকে মধ্যভাগে তার নিয়মিত কোনো চাকরি ছিল না। ততদিনে নবশক্তি পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেছে। কয়েকটি পত্রিকায় অদ্বৈত অনিয়মিতভাবে লেখা পাঠাতেন। সেই টাকায় তার কোনোভাবে দিন চলত। সেই সময়ই অদ্বৈতের লেখা কয়েকটি গল্পের একটি ছিল 'স্পর্শ দোষ'।

এটি প্রকাশিত হয় ১৯৪১-৪৩ সালের মধ্যে কোনো এক সময়ে। যেখানে উঠে এসেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা। যেখানে অদ্বৈত তুলে ধরেছেন হিটলারের তাণ্ডব। অদ্বৈত তার সংক্ষিপ্ত জীবনে লিখেছেনই মাত্র ৫টি গল্প। স্পর্শদোষ ছিল অদ্বৈতের লেখা সবশেষ গল্প।

অদ্বৈত তার প্রথম গল্প 'সন্তানিকা' লিখেছিলেন ত্রিশের দশকের শেষভাগে। কেউ কেউ বলে থাকেন প্রথম গল্পটিতে অদ্বৈত মল্লবর্মণ যেন তার নিজের জীবনেরই একটি কাহিনীর বয়ান করেছেন। এর কারণ কুমিল্লার ভিক্টোরিয়া কলেজে পড়ার সময় ছাত্রকে ধরে লজিং হিসেবে আশ্রয় জুটিয়েছিলেন তিনি। ঠিক তেমনি গল্পের কাহিনীতেও আমরা দেখি ধনঞ্জয় নামের এক বৃদ্ধ এক স্কুলশিক্ষার্থীর পেছনে এসে আশ্রয় জুটায় তার পরিবারে।

অদ্বৈতের লেখা ১৪টি কবিতার প্রতিটিতেই এসেছে তার জীবনের বয়ান। ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত 'ভারতের চিঠি —পার্লবাককে' ছাড়া আর কোনো প্রকাশিত গ্রন্থই দেখে যেতে পারেননি অদ্বৈত। প্রকাশিত সেই গ্রন্থও ছিল মাত্র ২৫ পৃষ্ঠার। তার সব লেখাই প্রকাশিত হয়েছিল বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।

ব্যক্তিগত জীবনে অদ্বৈত মল্লবর্মণ ছিলেন অকৃতদার। সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মাধ্যমে নিজের উপার্জিত অর্থের অধিকাংশই তিনি ব্যয় করতেন কলকাতার জেলেপাড়ার ছাত্রদের কল্যাণে। স্বল্প আয়ের অদ্বৈত মল্লবর্মণ নিজের সাহিত্য আর জীবন দিয়ে তুলে এনেছিলেন নিম্নবর্গের মানুষদের আত্মকথা। ক্ষুদ্র জীবনে তিনি হয়ে উঠেছেন সাহিত্যে নিম্নবর্গের মানুষদের সবচেয়ে বড় প্রতিনিধি।

১০৯তম জন্মদিবসে বাংলা সাহিত্যের অনন্য কথাশিল্পী অদ্বৈত মল্লবর্মণের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।

তথ্যসূত্র:

জন্মশতবর্ষে অদ্বৈত মল্লবর্মণ/ শান্তনু কায়সার

অদ্বৈত মল্লবর্মণ ব্রাত্য জীবনের ব্রাত্য কথাকার/ বিমল চক্রবর্তী

Comments

The Daily Star  | English
government decision to abolish DSA

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

12h ago