মানবিক কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় জন্মেছিলেন রবীন্দ্র-প্রতাপকালে। তবু অনায়াসেই বাঙালি পাঠকের হৃদয় জয় করেছিলেন স্বমহিমায়। কথাসাহিত্যে এনেছিলেন অভূতপূর্ব জোয়ার। বঙ্কিমচন্দ্রের বহিরাঙ্গিক ঘটনাপ্রবাহ এড়িয়ে রবীন্দ্রনাথের কথাসাহিত্যে মনোজাগতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া কিংবা মনোবিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি চরিত্র-চিত্রণে ঠাঁই পেয়েছিল। শরৎচন্দ্র বাঙালির চিরায়ত ভাবাবেগের জায়গাটিকে আশ্রয় করলেন।
হুমায়ুন আজাদের ভাষায়, 'শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ই প্রথম বাঙালির ভাবাবেগের জায়গাটি খুলে দেন।' সম্ভবত অতি শৈশবে আমিও মজেছিলাম শরৎচন্দ্রে। বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও ভেতরে ভেতরে কব্জা করে নেন আমাকে। অনেকের মতে, আমাকে শেষ করে দিয়েছেন তিনি। এটি বলার পেছনে কিঞ্চিৎ যৌক্তিকতাও রয়েছে। ক্লাস সিক্সে পড়ার সময় বড় ভাইয়ের টেবিলে প্রথম দুটো বই পাই। একটি বঙ্কিমের 'কপালকুণ্ডলা' অপরটি শরৎচন্দ্রের 'দেবদাস।' প্রথমটিতে 'কাপালিক' চরিত্রের বিবরণ দেখে ভয় পেয়েছিলাম। আর 'দেবদাস', 'পার্বতী' এবং চন্দ্রমুখী'র জন্য কী যে মায়া আর সংবেদনা তৈরি হয়েছিল- এই হৃদয়াবেগ চরম বস্তুতান্ত্রিকতার একালেও ক্ষণে ক্ষণে প্রশান্তিময় বেদনার ক্ষতে আঁচড় কাটে। তারপর একে একে শরৎ-এর সব গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ আদ্যোপান্ত পড়ে ফেলেছি কলেজ পেরোনোর আগেই!
হুমায়ুন আজাদ যেটিকে 'ভাবাবেগ' বলছেন, আমি সেটিকে বলি 'হৃদয়াবেগ'- যা বাঙালির আজন্মের প্রাণসম্পদ। এই হৃদয়ধর্মই শরৎচন্দ্রের প্রতিটি চরিত্রের নিয়ামক শক্তি। 'বিলাসী' গল্পে জাত-পাত-বর্ণের বালাইয়ে জর্জরিত বাঙালি হিন্দু সমাজে প্রথাগত নিম্নবর্ণীয় সাপুড়ের মেয়ে বিলাসীর হৃদয়াবেগ, কোমলপ্রাণ মাধুর্যময় অকৃত্রিম জীবনাদর্শই অপক্ষোকৃত উচ্চবর্ণীয় কায়স্থ মৃত্যুঞ্জয়কে সম্প্রদায়ের নিগঢ় ছেড়ে বিলাসীকে বিয়ে করা শুধু নয়; স্বয়ং সাপুড়ে বনে গিয়েছিলেন। এই রূপান্তর আরোপিত নয়; মানুষের সহজাত-স্বতঃস্ফূর্ত হৃদয়াবেগেরই পরিণাম। 'মেজদিদি' গল্পে বৈমাত্রেয় ভগ্নি কাদম্বিনীর কাছে আশ্রয়প্রাপ্ত অনাথভ্রাতা কেষ্টার প্রতি নিজভগ্নির নির্মমতার উপশমে হেমাঙ্গিনীকে উদার-মানবিক-সহানুভূতিশীল হৃদয়াবেগ নিয়ে পাশে দাঁড়াতে দেখি। শুধু তাই নয়- কাদম্বিনীর অশোভন-অন্যায় কলহে প্রায় মুখদেখাদেখি বন্ধের কালে কাদম্বিনীর জা হেমাঙ্গিনকে কেষ্টার দায়িত্বভার গ্রহণ করার মতো অশ্রুসজল, মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপট রচিত হতে দেখি এই গল্পে! এটি তো কল্পিত কোনও গল্প নয়। বাঙালি সমাজেরই বাস্তবানুগ ঘটনা, কাহিনী কিংবা চরিত্রের যথার্থ রূপায়ণ এটি।
বস্তুবাদী ও পুঁজিবাদী জীবন ও সমাজব্যবস্থার অপ্রতিরোধ্য প্রভাবকালে বাঙালি সমাজজীবনে ফল্গুধারার মতো এখনও মানবহৃদয়ের এই সৌহার্দ্য করুণাধারা বয়। মানুষই মানুষের পাশে দাঁড়ায়। রক্তধারার সম্বন্ধ এই ক্ষেত্রে বিবেচিত হয় না। সাম্য, সম্প্রীতি-ভ্রাতৃত্ব সর্বোপরি মানবিক প্রেরণাই চিরায়ত মানবসম্পর্কের বুনিয়াদ। শরৎচন্দ্রের কালজয়ী গল্প 'মহেশ।' চাল-চুলোহীন দরিদ্র মুসলমান কৃষক গফুরের নিত্যদিনকার অভুক্ত-অনাহারী সংসারে অসীম মমতায় পালিত গবাদি পশু 'মহেশ' যেন যেন আর কেবল পশু থাকে না।
পশুর এই স্বতঃস্ফূর্ত রূপান্তরকে আমরা বলি 'পারসোনিফিকেশন।' নিজেদের পেটে আহার নেই। নিজেদের খাবার ফেনটুকুও মহেশকে খেতে দেওয়া কিংবা ভাঙাঘরের চাল ছিঁড়ে ছন খেতে দেওয়ার মতো মনোভাব নিশ্চয়ই মানবিকতারসে উত্তীর্ণ। শুধু তাই নয় দশ টাকায় অন্যের কাছে বিক্রি করা মহেশকে রশি ধরে নিয়ে যাবার কালে গফুরের আকস্মিক উন্মাদের মতো চিৎকার- টাকা ফেরত দেওয়া কেবল নাটকীয় ক্লাইম্যাক্স নয়; বরং পশুপ্রেমকে মানবিকপ্রেমের স্তরে উত্তরণ এবং এটি গোঁড়ামিপূর্ণ হিন্দুসমাজের প্রতি বহুমাত্রিক ইঙ্গিতবাহীও বটে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ প্রেম-প্রেরণা সর্বজনীন। প্রাণী বা পশুকে ব্যক্তি-সত্তার সমান তাৎপর্যে দেখার কিংবা ভালোবাসার এই দৃষ্টান্ত বাঙালি সমাজ থেকেই গ্রহণ করেছেন এই দরদী-শিল্পী।
শরৎচন্দ্র বাঙালির সেই চিরায়ত হৃদয়াবেগকেই চরিত্র-চিত্রণে সূত্রের মতো ব্যবহার করেছেন। সমকালীন মানুষকে রবোটিক করে তুলছে বটে- তবু মানুষ তো যন্ত্র নয়। সীমিত মাত্রায় হলেও হৃদয়াবেগ কাজ করবেই মানবচৈতন্যে। তা একালের পাঠক-সমালোচক যত আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়েই শরৎচন্দ্রকে উড়িয়ে দিতে চান না কেন- শরৎসাহিত্যে বাঙালির আজন্মের হৃদয়বৃত্তির বিচিত্র রূপ-রস-রহস্য উন্মোচিত হয়েছে। এই উত্তরাধুনিক কালে নবপ্রজন্ম নব নব তত্ত্ব-দর্শন-মতবাদের দ্বারা আলোড়িত হন। নতুন মতবাদে আবিষ্ট হয়ে পুরাতন শিল্পাদর্শকে অনেক ক্ষেত্রেই অগ্রাহ্য করে তাচ্ছিল্যভরে ছুঁড়েও ফেলে দেন। সাহিত্য-আড্ডায়, তর্কে-বিতর্কে হরহামেশাই এমনটি প্রত্যক্ষ করি। রবীন্দ্রনাথ নাকি নজরুল বড় প্রতিভা এসব নিয়েও বিভাজিত ভক্তকুল! সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিই হয়তো এসব তর্ককে উসকে দেয়।
নজরুল নিজেই রবীন্দ্রনাথকে যেখানে 'গুরুদেব' বলে সম্বোধন করতেন- সেখানে এসব প্রশ্ন অবান্তর। মূর্খতার পরিণাম। কোনও কোনও তারুণ্যদীপ্ত নবযুগের শিক্ষার্থীকে বলতে শুনি- নজরুল কোনও কবি নন! শামসুর রাহমান নাকি আল মাহমুদ বড়! শরৎ-সাহিত্য এযুগে অসাড়! অনেককে এমনও বলতে শুনি- আবেগ দিয়ে জীবন চলে নাকি! শরৎ অনেক অতিরিক্ত বিবরণ দিয়েছেন। যা না হলেও চলতো। এই সব মন্তব্য শুনে আমার প্রায়ই মনে হয়- সকলেই স্বীয় মহিমায় সমুজ্জ্বল। মাঝে মাঝে বলতে ইচ্ছে করে- সাতজনম লয়ে এই ধরায় এলেও নজরুলের একটি গানের পঙক্তির সমান্তরাল চরণ তুমি লিখতে পারবে না।
কাজেই কাজীর ওপর কাজীগিরি করো না। আর শরৎচন্দ্রের মতো গল্প বলার ক্ষমতা ক'জনের আছে! যে সক্ষমতা শরৎকে রবীন্দ্রনাথের চেয়ে জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছিল! 'বড়দিদি' ছদ্মনামে পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হাবার পাঁচ বছর পর গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়েছিল। পাঠকের ধারণা ছিল এটি বোধহয় রবীন্দ্রনাথেরই লেখা। বাংলা সাহিত্যের তাঁর লেখা অনন্য আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস 'শ্রীকান্ত' প্রথম খণ্ড ধারাবাহিকভাবে সাময়িক পত্রিকায় ছাপা হবার পর পাঠকের অনুরোধে 'শ্রীকান্ত' (চতুর্থ খণ্ড) পর্যন্ত তাঁকে লিখতে হয়েছিল। এতেই তার পাঠকপ্রিয়তা অর্জনের বিষয়টি সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হয়। ভবঘুরে স্বভাবের শরৎচন্দ্রের জীবন-অভিজ্ঞতার বৈচিত্র্যময় বিষয় ও ভাবনাই তাঁর সাহিত্যের মৌল ভিত্তি। তিনি নিজেই আমাদের জানান, 'জীবনে তিল তিল করে যে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি- এখন দেখি আমার সাহিত্যে তারই প্রতিফলন ঘটছে।' বাঙালি সমাজকে অবলোকনে এবং সাধারণ, মধ্যবিত্ত নারী-পুরুষ নির্বিশেষ মানুষের জীবনের বাস্তবানুগ রূপায়ণে আশ্চর্য-অকৃত্রিম তিনি।
শরৎ-সাহিত্যের পরতে পরতে তাই প্রত্যক্ষ জীবন-অভিজ্ঞতার সুতীক্ষ্ণ সুচারু ছাপ দেখতে পাই। বাংলা সাহিত্যের সর্বকালের সেরা/ অমর প্রেমকাহিনী 'দেবদাস' তারই সৃষ্টি। 'শ্রীকান্ত' উপন্যাসের ইন্দ্রনাথ আজও বাংলা সাহিত্যের সেরা কিশোর চরিত্র। ইন্দ্রনাথের মতো ডানপিটে, সাহসী, অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ক'টি আছে! রাত্রিকালে ইন্দ্রনাথের সাথে শ্রীকান্তের মাছচুরির এমন রোমাঞ্চকর এবং মনোরম দৃশ্য বাংলা উপন্যাসে বিরল। সেন্স অব হিউমারের বিরল দৃষ্টান্ত নতুন দা'র নাজেহাল হবার দৃশ্যটি। রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্তের প্রেমচেতনা স্বতন্ত্র ভাবমাধুর্যে উদ্ভাসিত।
বিশেষ করে মাছচুরির দৃশ্যের সূচনাতেই ইন্দ্রনাথের একটি মরা মানুষের লাশকে নৌকায় তুলে নেয়া, জাতপাতের বালাইকে প্রশ্রয় না দেয়া; শ্রীকান্তের কৌতূহলী প্রশ্নের জবাবে ইন্দ্রনাথের সুদৃঢ় মনোভঙ্গি- 'মরার আবার জাত কী রে!' আমাদের শুধু সচকিত করে না। ইন্দ্রনাথ চরিত্রের শক্তিমত্তাকেও জানান দেয়। তার সঙ্গে শরৎবাবুর ফল্গুধারার মতো প্রবহমান উদার-অসাম্প্রদায়িক মানবিকতাবোধেরও পরিচয় পাই আমরা। 'পল্লীসমাজ', 'দত্তা', 'বামুনের মেয়ে','শুভদা', 'বিরাজ বৌ', 'বিন্দুর ছেলে', 'পরিণীতা', 'নিষ্কৃতি', 'মামলার ফল', 'চরিত্রহীন', 'গৃহদাহ', 'শেষপ্রশ্ন', 'পথের দাবী' প্রভৃতি উপন্যাসে শরৎচন্দ্র ভারতবর্ষীয় বাঙালি সমাজেরই ছবি আঁকেন। এই ছবি যেনতেন ছবি নয়; বরং চরিত্র-নির্মাণের ভেতর দিয়ে তিনি সমাজকে বিচিত্রভাবে পাঠ করেন। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যা-সংকট থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতির শিকার পাত্র-পাত্রীরা ব্যক্তিক এবং সামষ্টিক সংকটের দুবৃহ ভার বহন করেন। ফলে শরৎচন্দ্রের সৃষ্ট চরিত্রেরা লেখকের সহানুভূতি লাভ করে বেশ।
বিশেষ করে তার সাহিত্যে নারী-চরিত্ররা নিঃশর্ত দরদ ও মমতা দিয়ে তৈরি হয়েছে। এমনকি তার সৃষ্ট অস্পৃশ্য, অন্ত্যজ, রূপজীবী (পতিতা) চরিত্রগুলোও কী স্নিগ্ধ আশ্চর্য মাধুর্যমাখা! আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো- কোনও মুহূর্তেই এই পতিতা চরিত্রের প্রতি তাচ্ছিল্য কিংবা ঘৃণার উদ্রেক করে না; বরং অনেকাংশেই পাঠকের মনে মায়া ও দরদ তৈরি করে! এই শক্তি সব লেখকের থাকে না।
শরৎচন্দ্রের এই ক্ষমতা তাকে স্বাতন্ত্র্যসূচক মর্যাদা দিয়েছে। অনেকে আবার এটিকে পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রভাবজাত মনে করেন। ওয়াল্ট হুইটম্যানের মতো পতিতাকেও তিনি মানব-মহিমা আরোপ করেছেন বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। এমিল জোলা, দস্তয়ভস্কির প্রভাব খুঁজেন অনেকে। আমরা মনে করি- শরৎচন্দ্র পাশ্চাত্য সাহিত্যাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত নন মোটেও। তিনি সহজাতভাবেই চিরায়ত বাঙালি সমাজ-জীবনের নিবিড় পর্যবেক্ষক। ফলে তার চিত্রিত দৃশ্যপট একান্তই এই সমাজের মৌল কাঠামো হতে সংগৃহীত।
তার সাহিত্যে প্রতিফলিত জীবন একান্তই আটপৌরেজীবন; সাধারণ বাঙালি জীবনের বহুবর্ণিল কিংবা আনন্দ-বেদনা, বিরহ-মিলনেরই অভিঘাত। প্রগাঢ় অনুভবের গভীরতায় এই রূপায়ণ কল্পনাজাত কোনও প্রলেপ নয়। জীবনের অন্তঃপুরে প্রবেশ করে এমন করে এই সমাজ, জীবনকে আর কে দেখিয়েছেন!
বাঙালি সমাজের প্রথাগত ধর্মান্ধতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কারকে তিনি নিপুণভাবে চিহ্নিত করেছেন। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন কোথায় গলদ-সূত্র। তবু বেশির ভাগ সমালোচকই মনে করেন- 'শরৎচন্দ্র সমস্যা চিহ্নিত করেছেন বটে, সংকট-উত্তরণের পত বাতলে দেননি।' সমস্যা চিহ্নিত হলে মুক্তির পথ আপনি রচিত হয়- এমনটি বলতেই পারি। লেখককেই কেন পথ বাতলে দিতে হবে, তাহলে আলোচকের কাজ কী? বঙ্কিমচন্দ্র 'কৃষ্ণকান্তের উইলে' বিধবার প্রেমকে শুধু নিরুৎসাহিত করেননি; রোহিণীকে গুলি করে হত্যা করিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ 'চোখের বালি'তে একধাপ রঙ চড়ালেন বটে কিন্তু বিধবা বিনোদিনীকে শেষ পর্যন্ত পাঠিয়ে দিলেন তীর্থস্থানে। 'ঘরে বাইরে'তে বিমলার স্খলনকালে হাল ধরলেন শক্ত হাতে!
'গৃহদাহ'তে শরৎবাবু তো বরং বেশ অগ্রসরতা দেখালেন। সম্ভাব্য সবকিছু ঘটনা-প্রবাহের অনিবার্য স্রোতে ঘটার পর মহিম-অচলা-সুরেশের ত্রিভুজপ্রেম গন্তব্য খুঁজে পায় স্বামীনিষ্ঠায়। ভারতীয় ঐতিহ্যে, বাঙালি সমাজব্যবস্থার দীর্ঘদিনের স্বামী-সংস্কারে অর্থাৎ 'পতি পরম গুরু' এই নিষ্ঠার কাছে সমাধান খোঁজাকেও অনেকে তীর্যকভাবে দেখেছেন।
মূল্যবোধগত একটু পিছুটান এখানে অবশ্যই রয়েছে। তবে পূর্ববর্তী ঔপন্যাসিকদের তুলনায় শরৎচন্দ্র এই উপন্যাসে কিছুটা প্রাগ্রসরতা দেখিয়েছেন। এই ধারায় বুদ্ধদেব বসুর 'রাতভরে বৃষ্টি' উপন্যাসটি পরিণাম বিবেচনায় নিঃসন্দেহে সবচেয়ে আধুনিক এবং অতীত-ঐতিহ্যকে অতিক্রম করা উপন্যাস।' বাস্তবতা নির্ভর জীবন-রহস্য বিশ্লেষণে ও জীবন্ত চরিত্র সৃষ্টিতে শরৎচন্দ্রের কৃতিত্ব বঙ্কিমের চাইতেও বেশি।'- শরৎসাহিত্য সম্পর্কে শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই মূল্যায়ন আমাদেরকে পুনর্বার ভাবায়।
শরৎকে পুনর্মূল্যায়নের ইশারা দেয়। বঙ্কিম সন্দেহাতীতভাবে বড় শিল্পী; কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার মনোভাবমুক্ত নন; কিন্তু শরৎচন্দ্র মানবিক-অসাম্প্রদায়িক মানবতাবাদী জীবনশিল্পী। মানুষই যেখানে শেষ কথা- সেখানে শরৎসাহিত্যের আবেদন কখনো অসাড় হতে পারে না। কেননা তিনি একজন মানবদরদী শিল্পী।
Comments