বাবার সঙ্গে যন্ত্রণার স্মৃতি

আব্বির প্রয়াণের এক বছর আজ। অনেক সতর্কতা ও যত্নে আগলে রাখার পরও ২০২১ সালের জুলাই-আগস্টে কোভিডে আক্রান্ত হন তিনি। এর মাস খানেক পর তাকে আর আমরা ধরে রাখতে পারিনি। মনে পড়ছে সেই দিনটির কথা—৩১ আগস্ট ২০২১।

মৃত্যুর কদিন আগে থেকেই আব্বির অক্সিজেন সাচুরেশন কমে আসছিল। বাড়ির অক্সিজেন কনসেনট্রেটরটি অত্যধিক ব্যবহারের ফলে গোলমাল শুরু করে। তাই আরেকটি মেশিন দৈনিক হিসেবে ভাড়া করে আনা হয়েছিল। পালা করে দুটো মেশিনে আব্বিকে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টাই অক্সিজেন দিয়ে রাখতে হচ্ছিল। তিনি প্রায় তিন বছর আগ থেকেই শয্যাশায়ী ছিলেন। এ সময় তিনি আমাদের চিনতে পারতেন কিনা, তা আমরা জানিনি। কথা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আগেই। কণ্ঠ থেকে কিছু দুর্বোধ্য আওয়াজ বের হতো—হয়তো কথা বলবার প্রয়াস ছিল সেসব। গোঙাতেন। মাঝে মাঝে অনেক শব্দ করে গোঙাতেন। সেই শব্দে বাড়ির লোকদের ঘুমও ভেঙে যেত। কোথায়, কী যন্ত্রণার জন্য এমনভাবে গোঙাতেন, তা জানবার সুযোগ হয়নি আমাদের।

২০১৭ সালের দিকে—তিনি তখন হাঁটতে পারতেন, যদিও এলোমেলো ভাবনাগুলো তাকে বোধ হয় কাবু করে ফেলেছিল। জানতেন না কোথায় আছেন, বুঝতেন না দিন, কি রাত। সে সময় হঠাৎ হঠাৎ হেঁড়ে গলায় গেয়ে উঠতেন, 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে…'। রীতিমতো তাল দিয়ে, তালের ঝোঁক দিয়ে গাইতেন, 'একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে, যদি তোর ডাক শুনে কেউ…'। তার এই গান আমরা, অর্থাৎ তার স্ত্রী ও দুই সন্তান খুব উপভোগ করতাম। 

সস্ত্রীক বশীর আল-হেলাল। কোলে লেখিকা লায়েকা বশীর। ছবি: বাংলাদেশ অন রেকর্ড

গান বড় ভালবাসতেন আব্বি। যেবার প্রথম অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলেন এবং বাড়ি ফিরে এসে বিছানায় বাঁধা পড়লেন, তখন তাকে মাঝে মাঝে গান শোনাতাম। চুপচাপ শুনতেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল বেশি প্রিয়, তাই সেটাই শোনাবার চেষ্টা করতাম। খুব আশ্চর্যের বিষয় ছিল, যখনই 'আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি' গাইতাম, তার ফরসা মুখমণ্ডল কান্নায় লাল হয়ে উঠত। উত্তেজিত হলে, শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হতো। কী যেন বলতে চাইতেন, পারতেন না! ততদিনে ভাষা হারিয়ে ফেলেছেন। কী নির্মমতা- যিনি ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন সারাজীবন, তিনিই আজ ভাষাহীন...। 

অদ্ভুত মানুষের আবেগ! ভালো-মন্দ বোধ কতটা তখন তার কাজ করত, জানি না, কিন্তু জাতীয় সঙ্গীত শোনার সঙ্গে সঙ্গে আব্বি আবেগে এতটাই জর্জরিত হতেন যে, আমরা স্তম্ভিত হয়ে প্রতিক্রিয়া দেখতাম। তার অশ্রুসজল চোখ দেশপ্রেমকেই প্রকাশ করত। 

বিষয়টা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি। আব্বির জন্ম ওপার বাংলার মুর্শিদাবাদে। এপার বাংলায়, অর্থাৎ সে সময়কার পূর্ব পাকিস্তানে পাকাপোক্তভাবে যখন তিনি তার মা-কে নিয়ে চলে এলেন (বড় দুই ভাই এর কিছু আগে থেকেই ঢাকায় বাস করতেন), সেটা ছিল ১৯৬৮ সাল। ১৯৬৯ সালে বিয়ে করলেন মা-কে। সেই থেকে এই ঢাকায়। মাঝে গেছে মুক্তিযুদ্ধ। হয়েছে নতুন দেশের জন্ম। তার কিছু আগে তিনি কাজ পেয়েছিলেন বাংলা একাডেমিতে। এরপর একে একে দুই সন্তানের জন্ম। সেই সঙ্গে চলল তার লেখনী অনর্গল।

একটা সময় ছিল, যখন আমি ভাবতাম, কোনটি তার দেশ! ভারত? নাকি বাংলাদেশ? জীবনের শুরুর দিককার বত্রিশটি বছর ভারতে থেকেছেন (যদিও বিচ্ছিন্নভাবে কিছুকাল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানেও কেটেছে), শেষের পঞ্চাশ বছর বাংলাদেশে এবং মধ্যবর্তী দুই-তিন বছর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। নিবিড়ভাবে সাক্ষী হয়েছেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের। যুদ্ধের সময় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এই ভূখণ্ডেই রয়ে গেছেন। যুদ্ধের পরপরই তার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গল্প সংকলন 'প্রথম কৃষ্ণচূড়া' প্রকাশিত হয়।

প্রসঙ্গটি উত্থাপনের কারণ হলো, এই যে পূর্বপুরুষের ভিটে ছেড়ে নতুন ভূখণ্ডে পাকাপাকিভাবে তার আগমন—আগমনের কিছুদিন বাদে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম—সেই নতুন রাষ্ট্র, বাংলাদেশকে তিনি কেমন করে নিজের এতো আপন করে নিলেন, এটা আমাকে ভাবায়। এই সদ্যজাত দেশটিকে এতই ভালবাসলেন যে, চেতনাহীন অবস্থাতেও এদেশের জাতীয়সঙ্গীত চোখে জল এনে দিল! তার অর্থ এই নয়, শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য পার করা দেশ ওপার বাংলাকে তিনি ভালোবাসতেন না। আমরা দেখেছি, কী অসীম ভালোবাসা তাকে ঘিরে ধরত যখন তিনি সেখানে বিভিন্ন সময়ে ভ্রমণ করবার সুযোগ পেতেন, অথবা যখন এপারে বেড়াতে আসা ওপারের কোন সুহৃদকে কাছে পেতেন।

মনে পড়ে, পরিবারের সকলে মিলে ওপার-বাংলায় যাওয়া হয়েছিল। আমি তখন ছোট—চার, কি পাঁচ বছরের শিশু। সেবার আব্বির জন্মস্থান ও বেড়ে ওঠার জায়গাগুলোতে আমাদেরকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ফলে কিছু টুকরো-টুকরো স্মৃতি এখনও মনে জেগে আছে। বেশ পরে আব্বির সঙ্গে একা আমি একবার মাত্র ঘুরতে গিয়েছিলাম মুর্শিদাবাদ। সম্ভবত সেটা ছিল ১৯৯৬ সাল। মনে পড়ে, আব্বি ঘুরে ঘুরে তার গ্রাম সম্পর্কে কত কথা বলেছিলেন!

পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্গত মুর্শিদাবাদ জেলার বৃহৎ ও বিখ্যাত গ্রাম তালিবপুরের মীরপাড়ায় তাদের এই পৈতৃক নিবাস। প্রখ্যাত পল্লীগীতি শিল্পী আব্দুল আলিমের বাড়ি ছিল তালিবপুর গ্রামে, আর পাশের গ্রাম বাবলায় জন্মেছিলেন ভাষা-আন্দোলনের বীর শহিদ আবুল বরকত। এসব কত কথা যে বলেছিলেন?

সেবার বাড়ির রাস্তায় ঢোকার মুখে পারিবারিক কবরস্থানটা খুব যত্ন করে দেখিয়েছিলেন, যেখানে পরিবারের গত হয়ে যাওয়া সদস্যরা চিরশায়িত আছেন। যে স্কুলে শৈশবে আব্বি পাঠ গ্রহণ করেছিলেন, সেই তালিবপুর স্কুলে নিয়ে গিয়েছিলেন। আত্মীয়স্বজন তখনও যারা ছিলেন, তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। 

বশীর আল-হেলাল ও তার ভাইয়েরা পিতার কঠোর শাসনে ছিলেন আশৈশব। বিদ্যানুরাগী ও সংস্কৃতিবান পরিবারে বিত্ত-ঐশ্বর্য না থাকলেও শিক্ষার আভিজাত্য ছিল। সেবার আব্বির সঙ্গে কলকাতাও বেশ ঘুরে বেড়িয়েছিলাম। খুব সম্ভবত কলকাতার বাংলা একাডেমিতে সেবার তিনি কোন সাহিত্য আলোচনা কিংবা প্রবন্ধপাঠে অংশ নিয়েছিলেন। সেখানে আব্বির তারুণ্যের উল্লেখযোগ্য সময় কেটেছে যখন তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যক্ষভাবে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই সময়কার অনেক গল্প বলছিলেন আমাদের। স্মৃতিজড়িত বিভিন্ন জায়গা ঘুরিয়ে দেখিয়েছিলেন।

সেবার আমরা শান্তিনিকেতনেও গিয়েছিলাম। আব্বি তার প্রিয় বন্ধুদের বাড়িতেও নিয়ে গেছেন। মনে আছে, লেখক প্রলয় সেন আমাদের পেয়ে মহা উৎসাহে বাজারে নিয়ে গিয়ে কত কিছু যে কিনে দিয়েছিলেন—আমার জন্য কাপড়, মায়ের জন্য কাশ্মীরী শাল, ভাইয়ের জন্য শার্টের কাপড় আর আব্বির জন্য একটা মেরুন রঙের জওহর-কোট। এরপর বাড়িতে নিয়ে গিয়ে কতই না আপ্যায়ন করেছিলেন! এসব আন্তরিকতা আজও মনে আছে।

আব্বির সঙ্গে শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেনে বেলঘরিয়ায় গিয়েছিলাম তার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধুদ্বয় গোপাল মুখোপাধ্যায়-ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে। তারা আব্বিকে দেখে যারপরনাই খুশি হয়েছিলেন। তাদের ছোট পরিপাটি ও যত্নে গড়া গৃহটিতে আব্বি আর আমি কয়েকদিন কাটিয়ে এসেছিলাম। আব্বির আরেক সুহৃদ ভাস্কর মুখোপাধ্যায়। কলকাতায় তার বাড়িতেও ছিলাম আমরা কদিন। আব্বির এই সকল বন্ধুকে দেবতাতুল্য মনে হতো। তাদের আন্তরিকতা আর ভালোবাসা আমি আকণ্ঠ পান করতাম অশেষ মুগ্ধতায়।

আব্বির এ বন্ধুরা আমাদের ঢাকার বাড়িতে সস্ত্রীক এসেছেন একাধিকবার। তাদের গল্পে আর আড্ডায় মেতে থাকত বাড়ি। মা-কেও তারা বড় ভালোবাসতেন। মা তার নিজ কর্মজীবনের ব্যস্ততা থেকে কিছু সময় বের করে তাদেরকে যে আতিথেয়তা উপহার দিতেন, তাতে তারাও মুগ্ধ হতেন। তাদের ভালোবাসায় আমাদের হৃদয় হতো রঞ্জিত।

আগেই বলেছি, আব্বির পিতামহ ও মাতামহের নিবাস ছিল যথাক্রমে মুর্শিদাবাদের তালিবপুর ও বর্ধমান জেলার করজগ্রামে। সেখানকার আত্মীয়রাও আমাদের বাবা-চাচাদের সঙ্গে দেখা করতে মাঝে মাঝে বাংলাদেশে আসতেন। রক্ত-সম্পর্কের আত্মীয়-স্বজন তারা, অথচ দুই ভিন্ন দেশের নাগরিক ছিলেন। দেখার জন্য প্রাণ কাঁদলেও হুট করে চলে যাবার উপায় ছিল না। পাসপোর্ট-ভিসা-সরকারের অনুমতি—আরও কত কী ঝঞ্ঝাট! আপন ভিটায় আপনি অতিথি! বাপ-দাদার ভিটার মমতা, শৈশব-কৈশোরের উত্তাল আনন্দ স্মৃতি– সকল পুরোনো টানকে অগ্রাহ্য করে নতুন মাটিতে নতুন নিবাস গড়ে তোলার চেষ্টা। আব্বিকে পূর্বপুরুষের নিবাস ছেড়ে আসতে হয়েছিল চিরতরে। তাই পরবর্তী প্রজন্মের নিবাস গড়ায় মনোযোগী হয়েছিলেন বাংলাদেশের মাটিতে।

বশীর আল-হেলালের একমাত্র কন্যা আমি, দুইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠ সন্তান। আমার জন্ম বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রায় চার বছর পর। আমরা বরাবর ঢাকাতেই ছিলাম। শৈশবে যখন আমাকে লোকে জিজ্ঞাসা করত, তোমার বাড়ি কোথায়, তখন বেশ বিপদে পড়তাম, কারণ আমি তখনও জানতাম না 'বাড়ি' কাকে বলে। তখনও বুঝতাম না, পূর্বপুরুষের ভিটার ঠিকানা—সেই ভিটা কেবল আমার পূর্বপুরুষেরই ভিটা, সেই ভিটা আমার নয়। আব্বিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, 'আমার বাড়ি কোথায়?' তিনি বলেছিলেন, 'তোমার বাড়ি বাংলাদেশে—ঢাকায়'। বলেছিলেন, 'আমার বাড়ি যেখানেই হোক, তোমার বাড়ি এদেশে'।

এই বাংলাদেশে আমাদের কোন স্থায়ী ঠিকানা ছিল না। হয়ত সেজন্যই আব্বি চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর পূর্বে-ক্রীত এক খণ্ড জমিতে বাড়ি বানানোর ব্রত গ্রহণ করেন। এই বাড়ি পিতার কাছ থেকে পাওয়া সন্তানদের অমূল্য উপহার— বলার মতো একটা ঠিকানা। তিনি নিজের ঠিকানা বিসর্জন দিয়ে আমাদেরকে উপহার দিলেন এক নতুন ঠিকানা।

এই বাড়িতেই কথাসাহিত্যিক ও গবেষক বশীর আল-হেলাল ৩১ আগস্ট দুপুরবেলা শেষবার শ্বাস নেন। চোখের সামনে অক্সিমিটারে হৃদকম্প কমতে কমতে শূন্যে এসে মিলিয়ে যায়। একটি প্রাণের হয় অবসান। সেই প্রাণ জগতের কোথায় হারিয়ে গিয়ে কোন প্রাণে ঠাঁই করে নেয়, তা থেকে যায় অজানা।

লায়েকা বশীর: বশীর আল-হেলালের কন্যা, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক 

 

Comments

The Daily Star  | English
The Indian media and Bangladesh-India relations

The Indian media and Bangladesh-India relations

The bilateral relationship must be based on a "win-win" policy, rooted in mutual respect, non-hegemony, and the pursuit of shared prosperity and deeper understanding.

11h ago