শতবর্ষী জাহান আরা রহমানের ত্রিকালদর্শী জীবন

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এ অঞ্চলে নারী শিক্ষার বিস্তারে বড় বাধা ছিল কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস। এই বাধা পেরিয়ে সে সময় যে অল্পসংখ্যক নারী নিজেরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে অন্য নারীদের জাগরণের পথ তৈরি করেছিলেন, জাহান আরা রহমান তাদের অন্যতম। নারী শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি সমাজসেবায় অবদান রাখা এই মহীয়সীর আজ শততম জন্মবার্ষিকী।

বিংশ শতাব্দীর শুরুতে এ অঞ্চলে নারী শিক্ষার বিস্তারে বড় বাধা ছিল কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাস। এই বাধা পেরিয়ে সে সময় যে অল্পসংখ্যক নারী নিজেরা শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়ে অন্য নারীদের জাগরণের পথ তৈরি করেছিলেন, জাহান আরা রহমান তাদের অন্যতম। নারী শিক্ষা বিস্তারের পাশাপাশি সমাজসেবায় অবদান রাখা এই মহীয়সীর আজ শততম জন্মবার্ষিকী।

জীবদ্দশায় ব্রিটিশ ভারত, দেশভাগ ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের মতো গুরুত্বপূর্ণ কালপর্বের স্বাক্ষী জাহান আরা রহমান। শততম জন্মদিন উপলক্ষে  এই আলোকপ্রাপ্ত নারী দ্য ডেইলি স্টারের কাছে খুলে দিয়েছেন তার মনের আগল। কথা বলেছেন নিজের জীবন-কর্মসহ অতীত ও বর্তমানের নানা প্রসঙ্গে।

শিক্ষক ও সাহিত্যিক জাহান আরা রহমান ছিলেন কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের প্রথম ব্যাচের ছাত্রী, যেখানে পড়েছেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, লেখিকা হেলেনা খানসহ বাংলাদেশের আরও অনেকে। লেডি ব্রেবোর্নের প্রথম ব্যাচের ছাত্রীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই এখন বেঁচে আছেন।

১৯২২ সালের ২৭ আগস্ট কুমিল্লা শহরে নানার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন জাহান আরা রহমান। তার পৈতৃক বাড়ি চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় চিওড়া ইউনিয়নের সাস্তানগর গ্রামে। বাবা মফিজউদ্দিন আহমদ ছিলেন বাংলা প্রদেশের সিভিল সার্ভিসের সদস্য। তিনি ১৯৫০-এর দশকে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের রিলিফ কমিশনারের পদ থেকে অবসর নেন।

জাহান আরা রহমানের মায়ের নাম ছালেহা খাতুন। তারা ৩ ভাই, ৩ বোন। তিনি ও তার এক বোন ছাড়া এখন আর কেউ বেঁচে নেই। মা-বাবা গত হয়েছেন অনেক আগেই। স্বামী ড. মুজিবুর রহমান মারা যান ১৯৯১ সালে। নিজের ১ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে মেয়ে মারা গেছেন। ছেলে এহসানুর রহমান একজন নামকরা চিকিৎসক। দেশের বাইরে থাকেন।

সম্প্রতি ঢাকার গুলশানের বাসভবনে জাহান আরা রহমানের সঙ্গে কথোপকথনের সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন তার মেয়ের (হামীম খান) জামাই সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক সচিব আকবর আলি খান। তিনি জানালেন, শারীরিকভাবে কিছুটা অসুস্থ থাকলেও এখনো মানসিকভাবে সক্রিয় জাহান আরা রহমান।

শিক্ষাজীবনের শুরুতে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসে ঢেকে থাকা সে সময়ের বাধা কীভাবে দূর করলেন—জানতে চাইলে জাহান আরা রহমান বলেন, 'আমার বাবা সরকারি আমলা ছিলেন। মা শিক্ষায় সচেতন ছিলেন; আমার জীবন ও স্বপ্ন নিয়ে ভাবতেন। তাই অন্যদের মতো আমার কোন অসুবিধা হয়নি। বাবার চাকরির সুবাদে পরিবারের সঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরে বেড়ানোর সুযোগ পেয়েছি।'

নিজের মায়ের প্রসঙ্গে মহীয়সী এই নারীর ভাষ্য, 'আমার মা কোন পাস করা মহিলা ছিলেন না। তবে রাত জেগে মশারির তলায় শুয়ে তাকে বই পড়তে দেখেছি; যতক্ষণ বাবা ক্লাব থেকে ফিরে না আসেন। ইংরেজিতে কথা বললে বুঝে নিতে দেরি হতো না। যদিও (ইংরেজি) বলতে পারতেন না। তার ঘরে বেগম ফজিলতুন্নেসার বাঁধানো একটি ছবি টাঙানো দেখে পড়ালেখার প্রতি তার আসক্তির প্রমাণ পেয়েছিলাম। সে সময় সমাজের ঘরে ঘরে একজন বিদুষী নারী হিসেবে ফজিলতুন্নেসার পরিচিতি ছিল। তাই আমার মায়েরও মনের কোণে একটা সুপ্ত  ইচ্ছা ছিল যে, তার নিজের জীবনে যা সম্ভব হয়নি, সেটা তিনি তার সন্তানকে দিয়ে পূরণ করবেন এবং তাই-ই করেছেন।'

এ সময় আরও কিছু বলতে চাইলেও আটকে যান জাহান আরা রহমান। তখন তার হয়ে আকবর আলি খান বলেন, 'আম্মা যেখানে যেখানে গেছেন তার সব জায়গায় মেয়েদের স্কুল ছিল না। তাই কখনো স্কুলের বদলে তাকে প্রাইভেট পড়তে হয়েছে। যেমন ১৯৩৮ সালে তার বাবা দার্জিলিং থেকে বদলি হয়ে গেলেন এমন এক স্থানে, যেখানে কোনো মেয়েদের স্কুল ছিল না। আম্মা তখন দশম শ্রেণির ছাত্রী। ফলে জলপাইগুড়ির মেয়েদের স্কুলে আবাসিক ছাত্রী হিসেবে হোস্টেলে ভর্তি করিয়ে দেন তাকে। তখনকার দিনে প্রত্যেক ছাত্রীকে আরবি, ফারসি, সংস্কৃত বা পালি—এসব ভাষার মধ্যে একটি ভাষায় পরীক্ষা দিতে হতো। জলপাইগুড়ি স্কুলে আরবি বা ফারসি পড়ানোর কোনো শিক্ষক ছিলেন না। তাই তাকে সংস্কৃত ভাষায় পরীক্ষা দিতে হয়। অসুবিধা সত্ত্বেও তার প্রধান শিক্ষিকা সুনীতিবালা চন্দ্রের বিশেষ তত্ত্বাবধানে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় ১৯৩৯ সালে প্রথম বিভাগে পাস করেন এবং প্রথম শ্রেণির বৃত্তি পান।'

প্রিয় শিক্ষকের কথা মনে করে জাহান আরা বলেন,  '১৯৩৯ সালে ফার্স্ট গ্রেড স্কলারশিপ পেলাম। আমার এই কৃতিত্বের পেছনে ছিলেন হেডমিস্ট্রেস ও তার স্বামী, যিনি আমাদের গণিতের শিক্ষক ছিলেন। আমি অঙ্ক ভয় পেতাম। মাষ্টার (গণিতের শিক্ষক) সময়ে-অসময়ে আমাকে ডেকে নিয়ে পড়াতে বসাতেন। হোস্টেলে থাকতাম বলেই এটা সম্ভব হয়েছিল। তারা স্বামী-স্ত্রী আমাকে তাদের নিজের মেয়ের মত স্নেহ করতেন। তাদের কোন মেয়েও ছিল না।'

স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে জাহান আরা রহমান ১৯৩৯ সালে কলকাতায় মুসলমান ছাত্রীদের জন্য প্রতিষ্ঠিত লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে ভর্তি হন। এখানকার হোস্টেল ও ক্যাম্পাসে তখন ছাত্রীরা পর্দা মেনে পড়াশোনা করতেন। জাহান আরা রহমানের ভাষায়, তাই এটি 'পর্দা কলেজ' নামে পরিচিত ছিল। কলেজটির প্রতিষ্ঠায় নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তৎকালীন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক।

কলেজের স্মৃতিচারনা করতে গিয়ে জাহান আরা বলেন, 'বাংলাদেশের মফস্বল থেকে ভালো রেজাল্ট করা মেয়েরা হোস্টেলে থেকে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার আশায় ভর্তি হতে লাগল পর্দা কলেজে। বাংলার মুসলমান মেয়েরা যেন একটা নতুন চেতনায় উদ্বুদ্ধ হল। আমরা বোর্ডাররাও একটা সুন্দর পরিবেশে পড়াশোনা করার সুযোগ পেলাম। বেগম রোকেয়ার বোনও এলেন হোস্টেলের মেট্রোন হিসেবে।'

কথোপকথনে জানা যায়, ১৯৪৬ সালে কলকাতার ট্রপিক্যাল মেডিকেল স্কুলের চিকিৎসক, সন্দ্বীপের বাসিন্দা মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বিয়ে হয় হোসনে আরা রহমানের। দেশভাগের পর রহমান পরিবার ঢাকায় চলে আসে। তখন ঢাকায় বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে যুক্ত হন তিনি। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মালিক ফিরোজ খান নূনের স্ত্রী ভিকারুননিসা নূনের নেতৃত্বে ঢাকায় ভিকারুননিসা নূন স্কুল প্রতিষ্ঠায় বিশেষ অবদান রাখেন তিনি।

অন্যদিকে ১৯৪৭ সালে নুরজাহান বেগমের সম্পাদিত 'বেগম' পত্রিকায় প্রথম থেকেই জাহান আরা রহমান কবিতা, গল্প এবং প্রবন্ধ প্রকাশ করেছেন। গত শতকের আশির দশক পর্যন্ত লেখালেখি চালিয়ে যান তিনি। এরপরও অনেক কিছু লিখেছেন তিনি, যা এখন পর্যন্ত অপ্রকাশিত বলে জানান আকবর আলি খান। 

হোসনে আরা রহমান ১৯৬০-এর দশকে অল পাকিস্তান উইমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের (এপিডব্লিউএ) পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন। তার মেয়াদকালে পশ্চিম পাকিস্তানের মারি শহরে অনুষ্ঠিত এপিডব্লিউ'র সাধারণ সভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান দলের নেতৃত্ব দেন। ষাটের দশকে উইমেন্স ভলান্টারি অ্যাসোসিয়েশনের (ডব্লিউভিএ) সঙ্গে কাজ শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশে ডব্লিউভিএ'র সভাপতি নির্বাচিত হন এবং লালমাটিয়ায় মেয়েদের জন্য ডব্লিউভিএ কলেজ স্থাপনে নেতৃত্ব দেন। তার ছোট বোন নার্গিস খান এই কলেজে অর্থনীতির অধ্যাপক ও কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে কাজ করেছেন।

কথা প্রসঙ্গে আরও জানা যায়, জাহান আরা রহমান ঢাকায় লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের প্রাক্তন ছাত্রীদের সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন ১৯৯৪ সালে। তার নেতৃত্বে 'ব্রেবোর্ন বিচিত্রা' নামে একটি বই প্রকাশিত হয়। মিসেস আকতার ইমামের সভাপতিত্বে বর্ষীয়ান মহিলাদের জন্য 'হৈমন্তিকা' নামে একটি সংগঠন গড়ে ওঠে এবং জাহান আরা রহমান এই প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকেই উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন।

শেষ কবে গেছেন লেডি ব্রেবোর্নে?  আপনার সহপাঠীদের কেউ বেঁচে আছেন?– এমন প্রশ্নের জবাবে হোসনে আরা রহমান বলেন, 'সহপাঠীদের সবাই মারা গেছেন। আমি ২০১৪ সালে কলকাতা গেলে ব্রেবোর্ন কলেজের প্রথম ব্যাচের একমাত্র জীবিত ছাত্রী হিসেবে বিশেষ সংবর্ধনা দেওয়া হয় আমাকে।'

তিনি আরও বলেন, 'ব্রেবোর্নের স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলো এই বয়সে এসেও মনে আনন্দের ঢেউ তোলে। ফিরে যাই হারানো দিনে। তখনকার মেয়েরা অনেকে বাংলাদেশে এসে নিজেদের কীর্তিতে স্মরণীয় হয়ে আছেন।'

দেশভাগের স্মৃতির কথা জানতে চাইলে এ ব্যাপারে তেমন কিছু বলতে পারেননি হোসনে আরা রহমান। তবে একাত্তরের ভয়ানক সময়ের কথা স্মরণ করেন তিনি।

এ ছাড়া নিজের দীর্ঘ জীবনের নানা সময়ে দেখা হওয়া অনেক বরেণ্যদের কথা শোনা যায় তার মুখে। এই তালিকায় আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া, সুফিয়া কামালসহ আরও অনেকে। রাজনীতিবিদদের মধ্যে আছেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান, আইয়ুব খান ও মোনায়েম খান ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা হওয়ার স্মৃতি প্রসঙ্গে হোসনে আরা রহমান বলেন, 'শেয়ালদা স্টেশনে একবার আমার ট্রেন থেকে নামার সময় লাগেজ হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে বলতে কুলি হাতে নিয়েছে, তারপর ভিড়ের মধ্যে তাকে আর পাইনি। আমি স্টেশনে বসে আছি। আমার এক আত্মীয় তখন বুদ্ধি করে শেখ মুজিবকে বিষয়টা জানায়। শেখ মুজিব তখন কলকাতায় পরিচিত। রাজনীতি করে। শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে তার ভাব ছিল। সে শুনেই দ্রুত ব্যবস্থা নেয়। ২-৩ ঘন্টা পর আমি বাসায় চলে যাই। বিকালে লাগেজ বাসায় পৌঁছে দেয়। মনে হয় মুজিব না থাকলে লাগেজটি পেতাম না।'

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ২ বার গিয়েছি। ওনার কবিতা শুনেছি। চা-নাস্তা করেছি। কবির উপস্থিতিতে আড্ডা দিয়েছি অন্যদের সঙ্গে। প্রথমবার তার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম।'

হোসনে আরা রহমান যখন এ কথা বলছিলেন, তখন তার দিকে একইভাবে বিস্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে ছিলেন এই সাক্ষাৎকার গ্রহীতাও। সামনে বসে আছেন ত্রিকালদর্শী একজন মানুষ! কত গল্প তার, কত স্মৃতি!

শতবর্ষে এসে জীবন নিয়ে নিজের উপলব্ধি কথা জানতে চাইলে মহীয়সী বললেন, 'আমি আল্লাহর কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। এত বছর বাঁচব আশা করিনি কখনো। আমাদের বংশে এত বছর কেউ-ই বাঁচেনি। আজ আমার মা-বাবা নেই, স্বামী নেই, কোন বোন বেঁচে নেই। কিন্তু আমি বেঁচে আছি।'

Comments