বেগম মুজিবের জীবন সংগ্রাম

বেগম মুজিব
স্টার অনলাইন গ্রাফিক্স

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার কর্মের জন্য পৃথিবীতে অমর হয়ে থাকবেন। মানুষের মুক্তির জন্য অবিরাম সংগ্রাম করে গেছেন তিনি। বছরের পর বছর জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময় তাকে জেলে কাটাতে হয়েছে। সংসার নিয়ে ভাবার প্রয়োজন হয়নি কারণ, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের মতো একজন অসাধারণ ও দেশাত্মবোধ সম্পন্ন মানুষ তার পাশে ছিলেন। শত প্রতিকূলতায় পরিবারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন বেগম মুজিব। 

অন্য রাজনীতিবিদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর যে পার্থক্য ছিল তা হলো, বঙ্গবন্ধু সবকিছু বাদ দিয়ে রাজনীতিতে মনপ্রাণ উজাড় করে দিয়েছিলেন। বঙ্গমাতার মতো এক শুদ্ধময় ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধুর জীবনকে স্বপ্নময় এবং দৃঢ়তায় শক্তিশালী করে তোলেন। রাজনীতির বাইরে তার কোনো জগত ছিল না। বাকি সবকিছু দেখাশোনা করেছেন বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। এমনকি সন্তান জন্মদানকালেও অনেকসময় বঙ্গবন্ধুকে পাশে পাননি বেগম মুজিব। কী নির্মম সময়! 

বেগম মুজিবকে লেখা একটি চিঠিতে এমনটাই জানতে পারি। তৃতীয় সন্তান শেখ জামালের জন্মের খবর পেয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, স্নেহের রেণু। আজ খবর পেলাম তোমার একটি ছেলে হয়েছে।  তোমাকে ধন্যবাদ। খুব ব্যস্ত, একটু পরে ট্রেনে উঠব। ইতি তোমার মুজিব।' বঙ্গবন্ধু পাবনার এডওয়ার্ড কলেজের জনসভায় যোগদানের জন্য ট্রেনে উঠেছিলেন। সে সময় ফুলবাড়িয়ায় ছিল রেলস্টেশন। (প্রেস ইনস্টিটিউট থেকে প্রকাশিত 'বাঙ্গালির আরাধ্য পুরুষ')। 

পিতা হওয়ার পরম আনন্দ তিনি ভাগাভাগি করে নিয়েছেন জনতার সঙ্গে। বেগম মুজিবও তাকে কিছু বলেননি। কেননা বঙ্গবন্ধুর কাছে দেশ ও দেশের জনগণ কত প্রিয় ছিল, তা তিনি খুব ভালো জানতেন। এ রকম অসংখ্য উদাহরণ আছে, যার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে অন্য নেতাদের থেকে খুব সহজেই আলাদা করা যায়। এ সব সবকিছু সম্ভব হয়েছে তিনি বেগম মুজিবের মতো একজন মহান নারীকে স্ত্রী রূপে পেয়েছিলেন বলে। 

রাজনীতি-নিবেদিত জননেতা স্বামীর দীর্ঘ রাজনৈতিক দুর্যোগপূর্ণ সময়ের সহযাত্রী ও সহকর্মী ছিলেন বেগম মুজিব। স্বামীর জীবন যুদ্ধে, আদর্শে সংগ্রামে, এমনকি জনসম্পৃক্ততায় তার একটি অপ্রকাশ্য ভূমিকা সবসময়ই ছিল। 

পারিবারিক জীবনে সুখ-দুঃখের ভাগীদার যেমন ছিলেন, তেমনি রাজনৈতিক জীবনে ছিলেন তার আদর্শের 'প্রেরণাদাত্রী বিজয়লক্ষ্মী একজন নারী'। বঙ্গবন্ধুর মতো এমন বিরাট নেতার স্ত্রী হতে হলে যেমন ব্যক্তিত্বপূর্ণ হওয়া জরুরি ছিল, ফজিলাতুন্নেছা রেণুর ব্যক্তিত্ব ছিল তার চেয়েও অনেক বেশি। দুঃখ-কষ্ট-বেদনার উপলব্ধিতে সর্বজয়ী এক বিরাট আত্মত্যাগী নারী তিনি।

শৈশব-কৈশোর থেকেই শেখ মুজিবের স্বভাব ও চরিত্রের দৃঢ়তা, চিন্তাভাবনা, মেজাজ-মর্জির সঙ্গে তিনি ভালোভাবে পরিচিত ছিলেন। শৈশবে বাবা-মাকে হারিয়ে বঙ্গমাতা রেণু হৃদয়বান এক স্বামী পেয়েছিলেন, যার প্রেম-ভালোবাসা-স্নেহ-মমতায় তিনি ছিলেন বিমুগ্ধ।

বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব। ছবি: সংগৃহীত

স্বামীর প্রতি কর্তব্যপরায়ণ, সাংসারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনে তিনি ছিলেন জাতির জনকের যোগ্য স্ত্রী। বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার শৈশবের এই বিবাহিত জীবনের গাঁটছড়া আমৃত্যু অটুট ছিল। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব একজন সাধারণ গৃহবধূ হয়েও রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে বা প্রকাশ্যে সংশ্লিষ্ট না থেকেও, অন্তরালে থেকে যে অবদান রেখেছিলেন তার বিবরণ সবার জানা নেই।

আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। ঢাকা সেনানিবাসে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা'র বিচার চলছে। সারা দেশে আগুন জ্বলছে, 'জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব'। এই স্লোগানে রাওয়ালপিন্ডির ক্ষমতার মঞ্চ কেঁপে উঠেছে। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে বিধ্বস্ত ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক ডাকলেন। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদী নেতা শেখ মুজিবকে বাদ দিয়ে গোলটেবিল বৈঠক হয় কী করে? শেষ পর্যন্ত আইয়ুব খান বৈঠক সফল করতে রাজনৈতিক নেতাদের চাপে বাধ্য হলেন কারাবন্দী শেখ মুজিবুর রহমানকে আমন্ত্রণ জানাতে। কিন্তু দেশদ্রোহের দায়ে বিচারের আসামি, ক্যান্টনমেন্টে বন্দি আসবেন কীভাবে? অবশেষে আইয়ুব খান সিদ্ধান্ত নিলেন, প্যারোলে মুক্তি দিয়ে তাকে রাওয়ালপিন্ডি নিয়ে যাওয়া হবে। ফেব্রুয়ারির ১৭ বা ১৮ তারিখ বিভিন্ন মহল থেকে বঙ্গবন্ধুর কাছে প্যারোলে যাওয়ার প্রস্তাব যেতে থাকে। 

গোলটেবিল বৈঠক থেকে তৎকালীন রাজনৈতিক ফ্রন্ট এনডিএফের নেতা মৌলভী ফরিদ আহমদ সরাসরি তার সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুরোধ জানান প্যারোলে মুক্তি নিতে। এর সঙ্গে ঢাকায় তার অন্তরঙ্গ দুজন প্রভাবশালী সম্পাদক জেলে দেখা করে একই অনুরোধ জানান। ঢাকায় তখন তার মুক্তির দাবিতে কারফিউ ভেঙে রোজ রাতে মানুষের ঢল নামছে রাস্তায়। এরই মাঝে প্যারোলের বার্তা রটে গেল জনগণের মধ্যে। চলছে জল্পনা-কল্পনা শেখ সাহেব কি প্যারোলে মুক্তি নিয়ে আইয়ুবের বৈঠকে যাবেন? ক্যান্টনমেন্টে শেখ মুজিব কী ভাবছেন, কেউ তা জানে না। সারাদেশের মানুষ কিছুটা বিভ্রান্ত। তারা প্রাণ দিচ্ছে, রক্ত দিচ্ছে প্রিয় নেতাকে মুক্ত করে আনার জন্য, মুচলেকা দিয়ে আইয়ুবের দরবারে যাওয়ার জন্য নয়। 

কিন্তু এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন যিনি তিনিও ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। সেদিন মুচলেকা দিয়ে, নাকি নিঃশর্ত মুক্তি-সেই যুগান্তকারী সিদ্ধান্তটি নিয়েছিলেন এবং জানিয়েছিলেন বেগম মুজিব। 

মুজিবের সহধর্মিণী রাজনীতি বুঝতেন না হয়তো, কিন্তু নিজের স্বামীকে জানতেন। বুঝতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধুর মানসিক দ্বন্দ্ব। বন্দি স্বামীকে খবর পাঠালেন, 'প্যারোলে মুচলেকা দিয়ে বত্রিশ নম্বরে আসবেন না'। একজন সাধারণ গৃহবধূ সেদিন একটি রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন।

অন্যদিকে বেগম মুজিব নিজেকে একজন সাধারণ গৃহবধূ হিসেবেই মনে করতেন। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে দৈনিক বাংলার বাণীতে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী হিসেবে আমার পরিচয় নয়, আমি বাংলাদেশের একজন বধূ, একজন মা।' 

বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য সংগ্রাম করেছেন, আর বেগম মুজিব সংগ্রাম করেছেন তাদের নেতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। নেতার সংগ্রামী পথে কোনোদিন কোন অন্তরায় সৃষ্টি হতে দেননি তিনি। 

বেগম মুজিব বলেন, 'বঙ্গবন্ধু যখন কারাগারে থাকতেন, আমি তখন থাকতাম খোলা কারাগারে।'

এই কথাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আপনাদের নেতা (বঙ্গবন্ধু) যখন জেলে যেতেন তখন কেউ আমার খোঁজে আসত না। সবাই আমাকে এড়িয়ে চলত। তখন আমার ছেলেমেয়েকে কলেজে-স্কুলে ভর্তি করতেও সমস্যা হয়েছে।' 

এসব ঘটনা থেকেই আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি কেমন প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে বেগম মুজিবকে পথ চলতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে দীর্ঘ সময় জেলে কাটাতে হয়েছে। আইনজীবীদের খরচ বহনের অর্থ যোগানোর পুরো দায়িত্ব বেগম মুজিবের ওপর এসে পড়েছিল। 

এক সময় আগরতলা মামলার প্রধান কৌঁসুলি তার বকেয়া ফি পরিশোধ না করায় কোর্টে যাওয়া বন্ধ করে দেন। এই পরিস্থিতিতে বেগম মুজিব খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র' মামলার খরচের অর্থ সংগ্রহ করতে কুপন ছাপায়। বেগম মুজিব তার সম্পর্কে ছোট ভাই, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত শেখ আকরাম হোসেন ও বঙ্গবন্ধুর আপন ফুপাতো ভাই মোমিনুল হক খোকার মাধ্যমে অতি কষ্টে ও গোপনে কিছু টাকাপয়সা সংগ্রহ করেন। এরপর প্রধান কৌঁসুলির বকেয়া ফি কিছুটা পরিশোধ করেন। (এম ও ওয়াজেদ মিয়ার 'বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা বাংলাদেশ')।

বঙ্গবন্ধু তার 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' এবং 'কারাগারের রোজনামচা'র পাতায় পাতায় স্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা মুজিব রেণুর অবদানের স্বীকৃতি দিয়ে গেছেন। দুজনের বোঝাপড়া খুব ভালো ছিল। তারা ছিলেন একে অপরের পরিপূরক। এক কথায় বেগম মুজিব ছিলেন অসীম ধৈর্য, উপস্থিত জ্ঞানসম্পন্ন এক প্রেমময়ী স্ত্রী ও মমতাময়ী জননী।

Comments