প্রত্যক্ষদর্শীদের চোখে আজও ভাসে জিঞ্জিরা গণহত্যার ভয়াল দৃশ্য
'খালের পাড় ধরে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে ঢুকল পাকিস্তানি সেনারা। আমার ৪ ভাতিজার মধ্যে ৩ ভাতিজা ছিল এক ঘরে, আরেক ভাতিজা ভয়ে পালিয়ে গেছে তখন। বাকি ৩ জন আর পালানোর সুযোগ পায়নি। মিলিটারি ঘরে ঢুকেই ব্রাশফায়ার শুরু করে। এক একজন শব্দ করে কলাগাছের মতো লুটিয়ে পড়ল। পাশেই ছিল আমার ভাবি। ৩ ছেলের লাশ দেখেই ভাবি অজ্ঞান হইয়া গেলেন।
মিলিটারি আসার খবর পেয়ে আমি আগেই লুঙ্গি কাছা মেরে খালি গায়ে পাশের ঘরের চৌকির তলে ঢুকে গেছি। আমার সামনে হাড়ি-পাতিল থাকায় আমারে দেখতে পারল না। এদিকে পানির পিপাসায় আমার জান যায়, মনে মনে খালি আল্লাহরে ডাকতাছি। এরপর ওরা পাশের ঘরে গিয়ে ব্রাশফায়ার করল আরেক চাচাতো ভাতিজারে। সেও জায়গায় শেষ।'
'ওই যে ওর বাপের কথা বলছি', বলেই ঘরের দাওয়ায় বসা একজনকে দেখিয়ে দিলেন এরশাদ সরদার।
ফের বললেন, 'ব্যায়াম করা পেটানো শরীর, দেখার মতো শরীর ছিল ওর বাপের। তাজা রক্তে পুরো ঘর যেন ভেসে গেল।'
বলতে বলতে চোখ ভিজে এল এরশাদ সরদারের। উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন ঘরের দাওয়ায় বসা ওবায়দুল হক সরদার। বাবাকে কখনো দেখার সৌভাগ্য হয়নি ওবায়দুলের। ভয়াল সেই সকালে বাবাকে যখন চিরতরে হারিয়েছিলেন, তখন তিনি মায়ের গর্ভে। মায়ের কাছেই শুনেছেন বাবার কথা।
পরিবারের এই ৪ জনের মরদেহ ছাড়াও সেদিন এরশাদ সরদার একাই মাটিচাপা দিয়েছেন অন্তত ২০ জনের মরদেহ।
শুধু এক সরদার বাড়ির দৃশ্যই এটি। ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিলের ভোর যেন কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরা, কালিন্দী ও শুভাঢ্যা ইউনিয়নের গ্রামগুলোর জন্য এসেছিল মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে।
২৫ মার্চ কালরাতের গণহত্যার পর ঢাকা ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া বহু মানুষই প্রাণের ভয়ে আশ্রয় নিয়েছিলেন বুড়িগঙ্গার অপর পাড়ের জিঞ্জিরা, শুভাঢ্যা ও কালিন্দী ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে।
হিন্দু অধ্যুষিত এই অঞ্চলটি ছিল আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রধান দুর্গ। জিঞ্জিরা দিয়েই ঢাকা ছেড়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমেদের মতো আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন শাজাহান সিরাজ, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম খানের মতো প্রভাবশালী ছাত্রনেতারাও।
গোয়েন্দা মারফত পাকিস্তানি বাহিনী জানতে পারে, জিঞ্জিরায় ছাত্রনেতাদের মাধ্যমে গোপনে সংগঠিত হচ্ছে আওয়ামী লীগ।
ফলে অপারেশন সার্চলাইট পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জাহানজেন আরবাব জিঞ্জিরায় অপারেশন চালানোর সিদ্ধান্ত নেন। অপারেশনের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বশিরকে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ১ এপ্রিল মধ্যরাতে পাকিস্তানি বাহিনী ভারি গোলাবারুদ নিয়ে ঘাঁটি গড়ে বুড়িগঙ্গা তীরবর্তী মিটফোর্ড হাসপাতালে। মর্টার আর মেশিনগান বসানো হয় পরীবিবির মসজিদের ছাদে। ভোরের আগেই গানবোট দিয়ে সেনা নামানো হয় জিঞ্জিরা, কালিন্দী ও শুভাঢ্যা ইউনিয়নে।
আনুমানিক ভোর ৫টার দিকে পরীবিবির মসজিদের ছাদ থেকে ফ্লেয়ার ছুড়ে অপারেশন শুরুর সংকেত দেন ব্রিগেডিয়ার রশিদ। এরপর প্রথমেই হানাদার সেনারা জিঞ্জিরা ও বড়িশুর বাজার গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। শুরু হয় ইতিহাসের এক ভয়াল হত্যাযজ্ঞ।
গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী ও দক্ষিণ মান্দাইলের বাসিন্দা জুলহাস মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, '২৫ মার্চ গণহত্যার পর মিলিটারি আসার খবর আগে পেতে গ্রামের ঘাটগুলোতে আমরা পাহারা বসিয়েছিলাম। সেদিন ভোরে পাহারা দেওয়ার জন্য ঘাটে গিয়ে দেখি, সদরঘাটের দিক থেকে মিলিটারির পাঁচটি গানবোট আমাদের ঘাটে এসে থামল। বোট থেকে নেমেই তারা জিজ্ঞেস করল, ''নারিকেলবাড়িয়া কিধার হ্যায়? মন্টু বাড়ি কিধার হ্যায়?'' ওরা ছাত্রনেতা মোস্তফা মহসীন মন্টুর বাড়ির খোঁজ করছিল।'
'আমি পরিস্থিতি বুঝতে পেরে দৌড়ে বাড়িতে এসে দেখি সবাই পালাচ্ছে। আমিও পালিয়ে বোরহানীবাগ গ্রামের মসজিদে যাই। মসজিদে তখন হাজার হাজার মানুষ। মসজিদের পাশের বাড়িতে তখন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে মিলিটারি।'
'একজন দৌড়ে এসে বলল, ওই বাড়িতে মিলিটারি ৭ জনকে হত্যা করেছে। আমি তখন বাড়ির দিকে পালাতে গিয়ে দেখি চারপাশে খেতে-মাঠে শুধু মানুষের মরদেহ আর মরদেহ। বাড়িতে এসে দেখি পুকুরপাড়ে বেশ কয়েকটি মরদেহ পড়ে আছে। আহতদের আমরা ঘাটে নিয়ে নৌকা দিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে পাঠালাম। ফিরে গিয়ে বাকি মরদেহগুলোকে মাটিচাপা দিলাম,' বলেন জুলহাস মিয়া।
জিঞ্জিরা গণহত্যার অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী ও পূর্ব মান্দাইল গ্রামের বাসিন্দা সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'সে দৃশ্য আসলে বর্ণনা করার মতো না। কেউ দৌড়াতে গিয়ে গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ছে, কেউ জীবনের শেষ মুহূর্তে পানি পানি করে চিৎকার করছে। বুলেটের আঘাতে কারও পেটের ভুঁড়ি বের হয়ে গেছে। আমাদের বাড়ির পাশের হিন্দু বসতি পুরোটাই জ্বালিয়ে দেয় মিলিটারি।'
'মিলিটারি আসার খবর পেয়ে বেশ কয়েকজন দৌড়ে গিয়ে পুকুরের পাশে জঙ্গলে লুকায়। আমার আব্বা বারবার বলা সত্ত্বেও তারা আসেনি। মিলিটারি চলে যাওয়ার পর আমরা গিয়ে দেখলাম, তাদের একজনও বাঁচতে পারেনি। সবার মরদেহ পড়ে আছে,' বলেন তিনি।
সাইফুল ইসলামের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেদিন অন্তত ৫ হাজার লোককে হত্যা করেছে পাকিস্তানি বাহিনী।
১৯৭২ সালের ৩ এপ্রিল দৈনিক বাংলায় 'জিঞ্জিরায় নারকীয় তাণ্ডব' শিরোনামে প্রকাশিত হয় সাইফুল ইসলামের একটি প্রতিবেদন। পরে প্রতিবেদনটি স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের অষ্টম খণ্ডে সংযুক্ত করা হয়।
প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, 'অবশেষে ভোর হলো। কেরানীগঞ্জবাসী তখন ঘুমে অচেতন। সহসা শোনা গেল কামান আর মর্টারের শব্দ। …গ্রামের পর গ্রাম তারা জ্বালিয়ে দিল। মেশিনগান আর টমিগানের প্রচণ্ড আওয়াজে সকলে বিচলিত। সমানে চললো জিঞ্জিরা সুভাড্যা ও কালিন্দী ইউনিয়নের লোকদের উপর গুলী, অগ্নিসংযোগ লুণ্ঠন, ধর্ষিতা হলো কেরানীগঞ্জের মা বোনেরা। প্রত্যেকটি ঘর আক্রান্ত হলো তিনটি ইউনিয়নের। অবশেষে হত্যাযজ্ঞের সমাপ্তি ঘটলো। বর্বর বাহিনী কুখ্যাত ব্রিগেডিয়ার বশীরের নির্দেশ মতো থেমে গেল। রেখে গেল এক রক্তাক্ত কাহিনী।'
২ এপ্রিল জিঞ্জিরার মনু মিয়ার ঢালে হানাদাররা লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে ৪০০ জনের বেশি মানুষকে। পরে মনু মিয়ার ঢালেই মুক্তিযুদ্ধে কেরানীগঞ্জের শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়।
এ ছাড়া মান্দাইল ডাক সড়কের পাশে এক পুকুর পাড়ে একসঙ্গে ব্রাশফায়ারে হত্যা করা হয় ৬০ জনকে। কালিন্দীর এক বাড়িতে ১১ জন নারীকে হত্যা করে হানাদার বাহিনী।
মুক্তিবাহিনীর ঢাকা জেলা কমান্ডার ও তৎকালীন ছাত্রনেতা মোস্তফা মোহসীন মন্টু ডেইলি স্টারকে বলেন, '২৫ মার্চ গণহত্যার পরপরই আমি কেন্দ্রীয় ছাত্রনেতা ও জাতীয় নেতাদের নিয়ে কেরানীগঞ্জে চলে আসি। জাতীয় নেতারা চলে গেলেও, ছাত্রনেতারা তখনো আমার সঙ্গে ছিলেন। তারা আমাদের সংগঠিত হওয়ার খবর পেয়েছিল। ১ এপ্রিল সন্ধ্যার দিকে মিটফোর্ড হাসপাতালের এক ডাক্তারের মাধ্যমে গোপনে খবর পেলাম, বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি অফিসার হাসপাতাল রেকি করে দূরবীন দিয়ে কেরানীগঞ্জ পর্যবেক্ষণ করেছে। ছাদে প্রচুর গোলাবারুদও তুলেছে। শুনেই আমরা আমাদের পয়েন্টগুলোতে খবর পৌঁছালাম। বুঝলাম আক্রমণ আসন্ন, কিন্তু বুঝতে পারিনি এত দ্রুত আক্রমণ চালাবে।'
মোস্তফা মোহসীন মন্টু আরও বলেন, 'রাত ২টার দিকে মিলিটারি গোপনে গানবোট নিয়ে খাল দিয়ে ঢুকে অবস্থান নিয়ে নেয়। রাত ৩টার দিকে খবর পেলাম জিঞ্জিরার দিকে আর্মি নামছে। ভোর ৪টার দিকে পরীবিবির মসজিদের ছাদ থেকে ফ্লেয়ার ছুড়ে অপারেশন শুরুর সিগনাল দিলো। ওরা ততক্ষণে কাঁটাতার আর বাঁশ দিয়ে অস্থায়ী ঘেরাওয়ের মতো করে রেখেছিল, যেন সামনের দিক থেকে আর্মি গুলি করলে মানুষ পেছন দিকের বিলের দিক দিয়ে পালাতে না পারে।'
'কিছু আর্মি তখন কাঁটাতার বরাবর দাঁড়িয়ে ফায়ার শুরু করল। মানুষজন যখন প্রাণের ভয়ে গুলির মুখে একদিক থেকে অন্যদিকে যাচ্ছে, তখন অপরদিক থেকেও ফায়ারিং চলছে। একটানা ৩ ঘণ্টা গুলি চালাল ওরা। এরপর সকাল সাড়ে ১১টা পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি গিয়ে তল্লাশি করেও বহু মানুষকে হত্যা করল,' বলেন তিনি।
জিঞ্জিরা গণহত্যায় জিঞ্জিরা ইউনিয়নের পরে হানাদাররা সবচেয়ে বেশি মানুষ হত্যা করে শুভাঢ্যা ইউনিয়নে। গণহত্যার সময় মধ্য শুভাঢ্যা গ্রামের মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিলেন গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী কবি নির্মলেন্দু গুণ।
'জিঞ্জিরা জেনোসাইড ১৯৭১' এ তিনি লিখেছেন, 'আমি যখন মসজিদের প্রাঙ্গনে পৌঁছলাম ততোক্ষণে সেই মসজিদটি লোকে লোকারণ্য মসজিদের সামনের পাকা উঠানের ওপর বেশ ক'টি মৃত ও অর্ধমৃত পুরুষের দেহ পড়ে আছে। কেউ চিৎ হয়ে, কেউ বা উবু হয়ে আছে। কারও দিকে কেউ তাকাচ্ছে না। ঐ সব মৃত বা অর্ধমৃতরা যেন জীবিতদের কেউ নয়। তাদের দেহ থেকে রক্ত বেরুচ্ছে অঝোরে।'
মধ্য শুভাঢ্যা গ্রামেরই গণহত্যার প্রত্যক্ষদর্শী সহদেব চন্দ্র মণ্ডল ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ভোরের দিকে জিঞ্জিরা খাল দিয়ে মিলিটারি গ্রামে ঢুকেই ব্রাশফায়ার শুরু করল। আমরা পালাতে শুরু করি। আমাদের মধ্যেই অনেকে মারা পড়ে। কয়েকদিন পর বাড়ি ফিরে এসেও খালের পাশে কয়েকটা মরদেহ দেখেছিলাম। বাকিগুলোর মধ্যে কিছু খালের স্রোতে ভেসে গেছে। কিছু মাটিচাপা দিয়েছে গ্রামের মানুষ।'
শুভাঢ্যা ইউনিয়নের পার গেণ্ডারিয়া গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলমাস জানান, তিনি বাড়ির আশেপাশে অন্তত ৩০টি মরদেহ পেয়েছিলেন।
পৈশাচিক এই গণহত্যার পর পাকিস্তানি সামরিক প্রশাসন মিথ্যাচার চালায়। ২ এপ্রিল রাতে পাকিস্তানি টেলিভিশন প্রচারিত সংবাদে বলা হয়, 'বুড়িগঙ্গা নদীর অপর পাড়ে কেরানীগঞ্জের জিঞ্জিরায় আশ্রয় গ্রহণকারী বিচ্ছিন্নতাবাদী দুষ্কৃতিকারীদের কঠোর হাতে দমন করা হয়েছে।' ৩ এপ্রিল পাকিস্তানি সামরিক পক্ষপাতদুষ্ট মর্নিং নিউজ পত্রিকায় শিরোনাম ছিল 'Action against miscreants at Jinjira'।
এ প্রসঙ্গে জাহানারা ইমাম 'একাত্তরের দিনগুলি' বইয়ে লিখেছিলেন, 'মর্নিং নিউজ- এর একটা হেডলাইনের দিকে তাকিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম। অ্যাকশন এগেইনস্ট মিসক্রিয়ান্টস অ্যাট জিঞ্জিরা- জিঞ্জিরায় দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ। গতকাল থেকে লোকের মুখে মুখে যে আশঙ্কার কথাই ছড়াচ্ছিল, সেটা তাহলে সত্যি? ক'দিন ধরে ঢাকার লোক পালিয়ে জিঞ্জিরায় গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছিল। গতকাল সকাল আর্মি সেখানে কামান নিয়ে গিয়ে গোলাবর্ষণ করেছে। বহু লোক মারা গেছে।'
জিঞ্জিরা গণহত্যায় ঠিক কত জন শহীদ হয়েছেন তা কখনোই পুরোপুরি জানা যায়নি। কেউ দাবি করেন ৩ হাজার, আবার কেউ কেউ বলেন ৪ বা ৫ হাজার নিরীহ মানুষকে নৃশংস কায়দায় হত্যা করেছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। সংখ্যা যেটাই সঠিক হোক, শহীদ স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীদের আজও তাড়িয়ে বেড়ায় নির্মম সেই গণহত্যার দৃশ্য।
Comments