১১ মার্চ: প্রথম রাষ্ট্রভাষা দিবস
ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় অধ্যায় দখল করে আছে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। ১৯৪৯, ১৯৫০ ও ১৯৫১ সালে এই দিনটি পূর্ব পাকিস্তানে পালিত হয়েছিল 'রাষ্ট্রভাষা দিবস' হিসেবে। ভাষা আন্দোলনের প্রথম রাষ্ট্রভাষা দিবসের ৭৫তম বছরে রইল আজকের আয়োজন।
`সকাল ন'টা বাজিবার সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান, আবদুল ওয়াদুদ এবং আমি সেক্রেটারিয়েট ভবনের প্রথম গেইটে উপস্থিত হই। তখনও সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীবৃন্দ আসেন নাই। ইতিমধ্যে তরুণ জননেতা জনাব শামসুল হক কয়েকজন কর্মীসহ আমাদের সঙ্গে যোগ দিলেন। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, তিন হইতে পাঁচজন সেক্রেটারিয়েটের গেটগুলির প্রত্যেকটিতে পিকেটিং করিব এবং এক গ্রুপ ধরা পড়িলে পরবর্তী গ্রুপ পিকেটিং করিবে। পূর্বাহ্ণ বেলা ৯-৩০ মিনিট হইতে ১০টার মধ্যে সেক্রেটারিয়েটগামী কর্মচারীদিগকে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে বাধা দিতে শুরু করিলাম। সিটি এসপি আবদুল গফুরের হুকুমে পুলিশ তৎপর হয়ে উঠিল। ইংরেজ ডিপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ মিঃ চ্যাথাম লাঠি চালনার আদেশ দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যে শামসুল হক ও তাঁহার গ্রুপের কতিপয় কর্মী গ্রেফতার হইলেন। ইহার পর শেখ মুজিবুর রহমান আর এক গ্রুপসহ গ্রেফতার হইলেন। পুলিশ বাহিনী অধৈর্য হইয়া উথিল এবং বেপরোয়া লাঠি চালনা আরম্ভ করলো। জনাব আবদুল ওয়াদুদ ও আমি পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হই। পুলিশ আমাদের আহত অবস্থায়ই জীপে বস্তাবন্দী করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়া তথাকার হাসপাতালে ভর্তি করাইল।…সন্ধ্যা নাগাদ ৬৯ জনকে গ্রেফতার করিয়া সরকার ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক করিল।'
'জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫' বইয়ে এমনটাই লিখেছিলেন অলি আহাদ। ভাষা আন্দোলনের সব তেজোদীপ্ত প্রতিবাদের সূতিকাগার বলা যায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চকে। এদিনই প্রথম রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে রাজপথে ঝরেছিল ছাত্র জনতার রক্ত। প্রদেশব্যাপী একসঙ্গে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে গর্জে উঠার প্রথম নজির পাওয়া যায় এদিনটিতেই।
যেভাবে গড়ে উঠে ১১ মার্চের প্রেক্ষাপট
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলায় বক্তব্য প্রদান ও সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব দাখিল করেন গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। ২৫ ফেব্রুয়ারি এটি গণপরিষদে আলোচিত হয়। এদিন তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে গণপরিষদের মুসলিম লীগের সব মুসলিম সদস্য একযোগে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।
খাজা নাজিমুদ্দিন এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করে গণপরিষদে দেওয়া বক্তব্যে বলেন, 'পূর্ব বাংলার অধিকাংশ মানুষই চায় রাষ্ট্রভাষা উর্দু হোক।' তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের বিরোধিতায় সংশোধনীটি গণপরিষদের ভোটে বাতিল হয়ে যায়।
গণপরিষদের এমন সব ঘটনার প্রথম প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছিল ফেব্রুয়ারি মাসেই। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ক্লাস বর্জন কর্মসূচি পালন করেন। ছাত্ররা ২৯ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেন। ২৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ সব জায়গায় প্রতিবাদ দিবস ও ধর্মঘট পালিত হয়। পুলিশ এদিন ছাত্রদের মিছিলে লাঠিচার্জ করে বহু নেতাকর্মীকে আটক করে।
এ পরিস্থিতিতে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে কামরুদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে তমদ্দুন মজলিস ও মুসলিম ছাত্রসমাজের এক যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়। সেই সভায় শামসুল হককে আহ্বায়ক করে গঠন করা হয় 'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'। এ সময় পরিষদ থেকে অন্যান্য সংগঠনগুলো থেকে ২ জন করে প্রতিনিধি রাখার প্রস্তাব গৃহীত হয়। ওই বৈঠক থেকেই ১১ মার্চ ধর্মঘটের আহ্বান করা হয়। বৈঠকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ধন্যবাদ জানানো হয়।
১১ মার্চের মূল কর্মসূচির দিনকে সামনে রেখে ১০ মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে এক সভায় পরদিনের কর্মসূচির কার্যক্রম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১১ মার্চ ভোর থেকেই পিকেটিংয়ের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসেন। ছাত্ররা ভোর ৫টার আগেই রেলওয়ে ওয়ার্কশপের পূর্ব নির্ধারিত ৩টি স্থানে উপস্থিত হন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল অফিসগামী কর্মচারীরা কোনোভাবেই যেন নীলক্ষেত, পলাশী ব্যারাক থেকে না বের হতে পারে সেটি নিশ্চিত করা। আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ও তমদ্দুন মজলিস।
ভোর থেকেই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতারা আন্দোলনকর্মীদের নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে পিকেটিং শুরু করেন। পিকেটিংয়ের নেতৃত্বে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, আবুল কাসেম, মোহাম্মদ তোয়াহা, শওকত আলী, অলি আহাদ, শহীদুল্লা কায়সার, আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব, এম এ ওয়াদুদ, নঈদ্দীন আহমদ, খালেক নেওয়াজ খান, এম এ ওয়াদুদ।
সকাল ৮টায় জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে পুলিশ আন্দোলনকারী ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে। লাঠিচার্জের বিপরীতে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু করে আন্দোলনকারী ছাত্ররা। এক পর্যায়ে ছাত্ররা টিকতে না পেরে সরে যান। এরপরই ছাত্রদের আরেকটি গ্রুপ এসে আন্দোলনে যোগ দেন। সকাল ৯টার দিকে ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনে পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জে আহত হন খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার, শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ ওয়াদুদ।
তোপখানা রোডে পুলিশের বেড়ধক লাঠিচার্জে আহত হন কাজী গোলাম মাহাবুব, শওকত আলীসহ অনেকে। জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনেও বেশ কয়েকজন আন্দোলনকর্মী আহত হয়েছিলেন। এক পর্যায়ে শামসুল হকের নেতৃত্বে থাকা দলটিকে ঘিরে ফেলে পুলিশ। তখন শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একদল আন্দোলনকর্মী ইডেন বিল্ডিংয়ের দিকে ছুটতে থাকেন। পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ শুরু করে।
দুপুর ২টার দিকে আন্দোলনকর্মীরা সচিবালয়ের দিকে মিছিল নিয়ে যাত্রা শুরু করলে পুলিশ হাইকোর্ট গেটের কাছে বাধা দেয়। এক পর্যায়ে পুলিশ সেখানে লাঠিচার্জ শুরু করে। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররাও ইট-পাটকেল ছুড়ে পাল্টা হামলা চালায়। এ সময় পুলিশি লাঠিচার্জে আহত হন মোহাম্মদ তোয়াহাসহ অনেকে। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক উপস্থিত হলে তিনিও পুলিশের লাঠিচার্জে আহত হন।
বিকেলে ছাত্ররা প্রতিবাদ সভার আয়োজন করলে পুলিশ সভা পণ্ড করে দেয়। এদিন মোট ৬৯ জন নেতাকর্মীকে আটক করে পুলিশ। আটকদের মধ্যে ছিলেন অলি আহাদ, শেখ মুজিবুর রহমান, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুবসহ অনেকে। এক পর্যায়ে আন্দোলনকারীরা খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজল ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদকে পদত্যাগ পত্রে সই করতে বাধ্য করেন। বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকার সেনাবাহিনী তলব করে। পরদিন পদাতিক সেনারা গণপরিষদে গিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনকে বাবুর্চিখানা দিয়ে গোপনে বের করে আনে।
প্রদেশজুড়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয় ১১ মার্চ
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ছাত্র ধর্মঘট ও হরতাল পালিত হয় পূর্ব বাংলার প্রায় সবগুলো জেলা শহরেই। তবে এক্ষেত্রে কিছু জেলা ও মহকুমা শহর রেখেছিল অগ্রগামী ভূমিকা।
১১ মার্চ রাজশাহীতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয় হরতাল। এদিন নগরীর ভুবনমোহনপার্কে আয়োজিত হয় প্রতিবাদসভা। রাজশাহী কলেজ থেকে আন্দোলনকারী ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। ছাত্রদের মিছিলটি যখন বরেন্দ্র জাদুঘরের সামনে পৌঁছায় তখন পুলিশ মিছিলে গুলি চালায়, যা ছিল ভাষা আন্দোলনে প্রথম রক্ত ঝরার ঘটনা।
২ পর্বের ভাষা আন্দোলনের মধ্যে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনেই সব জেলা সর্বাত্মকভাবে বিক্ষোভে শামিল হয়েছিল। তবে ব্যতিক্রম ছিল যশোর। যশোরে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তৈরি হয়েছিল প্রথম পর্বের ভাষা আন্দোলনে অর্থাৎ ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। ১১ মার্চ ছাত্রদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি বানচাল করার জন্য আগের দিন ১০ মার্চ যশোরের জেলা প্রশাসক নোমানী যশোর শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে। তখন ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেয়। ১১ মার্চ যশোর শহরে পালিত হয় বিক্ষোভ মিছিল ও ধর্মঘট।
ছাত্র জনতার খণ্ড খণ্ড মিছিলে স্লোগান ছিল একটাই, 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।' বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যশোর পরিণত হয় মিছিলের নগরীতে। এদিন যশোরে মিছিল থেকে পুলিশ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ৫০ জন নেতাকে গ্রেপ্তার করেছিল।
১১ মার্চ চট্টগ্রাম নগরীতেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয়েছিল ধর্মঘট ও প্রতিবাদ সমাবেশ। একইসঙ্গে ছিল বিক্ষোভ মিছিল, যা চলে ১৪ মার্চ পর্যন্ত।
আটচল্লিশের ভাষা আন্দোলনে পূর্ববাংলায় মহকুমা শহর হিসেবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল ফেনী। ওই সময় ফেনী ছিল নোয়াখালীর সবচেয়ে ছোট মহকুমা শহর। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন নোয়াখালী জেলা শহরকে তেমন একটা স্পর্শ না করতে পারলে, তুমুলভাবে আলোড়িত করেছিল ফেনীকে।
বরিশালও তুমুলভাবে আলোড়িত হয়েছিল এই পর্বের ভাষা আন্দোলনে। ১১ মার্চ বরিশালে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হয় ছাত্র ধর্মঘট। বরিশালের দিপালী সিনেমা হলের সামনে ও ফকিরবাড়ীতে আয়োজিত হয় পৃথক ২টি ছাত্র সমাবেশ।
১১ মার্চের বিক্ষোভ কর্মসূচি, ছাত্র ধর্মঘটের মধ্য দিয়েই পাকিস্তানের মৃত্যুঘণ্টা বেজে গিয়েছিল। ১১ মার্চের ঘটনার প্রেক্ষিতে ১২ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত ধর্মঘট পালন করে ছাত্র-জনতা। তীব্র আন্দোলনের মুখে খাজা নাজিমুদ্দীন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর আসন্ন ঢাকা সফরকে কেন্দ্র করে সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে ৮টি বিষয়ে সমঝোতা চুক্তি সই করতে বাধ্য হন।
পরে ১৯৪৯, ১৯৫০ ও ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় প্রতিটি শহরেই ১১ মার্চ 'রাষ্ট্রভাষা দিবস' হিসেবে পালিত হয়।
তথ্যসূত্র:
জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫ থেকে ৭৫/ অলি আহাদ
অসমাপ্ত আত্মজীবনী/ শেখ মুজিবুর রহমান
তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি
পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি ১ম খণ্ড/ বদরুদ্দীন উমর
দৈনিক আজাদ ১২, ১৩ মার্চ ১৯৪৮
ahmadistiak1952@gmail.com
Comments